লেডিস ক্লাবের ফওজিয়া সামাদ by সালাম মাহমুদ

আকাশের চাঁদের মতো কিছু মানুষ আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নেন এবং যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে আলোর মশাল প্রজ্বলিত করে যান। এমনই একজন মহীয়সী নেত্রীর নাম বেগম ফওজিয়া সামাদ। তিনি ব্রিটিশ আমলে আসামের তদানীন্তন রাজধানী শিলংয়ে ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রয়াত সফর আলী ও মা প্রয়াত আজিজুননেছা।


বাবা চাকরি করতেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে উচ্চপদে। বাবার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর বেগম ফওজিয়া সামাদ সপরিবারে মাতৃভূমি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার থইগাঁও গ্রামে চলে আসেন। বেগম ফওজিয়া সামাদ ১৯৪৬ সালে সিলেট মুকুল ফৌজ গঠন করেন এবং মুকুল ফৌজের পরিচালক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রী উভয় শাখারই দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৭ সালে সিলেট গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষয়িত্রী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে সর্বপ্রথম সিলেটে বেগম ফওজিয়া সামাদের নেতৃত্বে এইডেড হাইস্কুলে তিন দিনব্যাপী মুকুল ফৌজের সাহিত্য সম্মেলন ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪৮ সালে এ দেশের বিখ্যাত বীমা বিশেষজ্ঞ বিজিআইসির প্রতিষ্ঠাতা এমএ সামাদের সঙ্গে বেগম ফওজিয়া সামাদ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৯ সালে বেগম ফওজিয়া সামাদ এ দেশের প্রথম শিশু-কিশোরদের নির্ভীক সাহিত্য পত্রিকা মাসিক 'মিনার' সম্পাদনা করেন। শিশু-কিশোরদের বিনোদন ও জ্ঞান বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে মিনার ছিল অনন্য। সে সময় মিনারে লিখতেন উভয় বাংলার তদানীন্তন অগ্রসারির মনীষী লেখকরা। মিনারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শিশু-কিশোরদের প্রিয় সংগঠন 'চাঁদের হাট'। আর এ চাঁদের হাটের নেতৃত্ব দিতেন বেগম ফওজিয়া সামাদ।
উল্লেখ্য, মিনারের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন এ দেশের বিখ্যাত বীমা দার্শনিক এমএ সামাদ। একই সময় বেগম ফওজিয়া সামাদ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন রেডিও পাকিস্তানে শিশু-কিশোরদের অনুষ্ঠান 'খেলাঘর' পরিচালনা করে। তারপর ধারাবাহিকভাবে পরিচালনা করতেন মহিলা বিভাগের অনুষ্ঠান 'মহিলা মাহফিল'। চাকরি সূত্রে এমএ সামাদের সঙ্গে চট্টগ্রামে যাওয়ার পর ১৯৫৩ সালে নারী সমিতি গঠন করেন এবং তিনি সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাচিত হন। অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে নারী সমিতি পরিচালন করা অবস্থায় মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত হন এবং সাধ্যাতীত দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি সূত্রেই ১৯৬৩ সালে এমএ সামাদের সঙ্গে আবার ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৭৩ সালে বেগম ফওজিয়া সামাদ বাংলাদেশের বিখ্যাত নারী সংগঠন ঢাকা লেডিস ক্লাবের সভানেত্রীর গুরুদায়িত্ব হাতে নেন। সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে লেডিস ক্লাবের উন্নয়নের ধারা সূচনা করলেন। লেডিস ক্লাবের আর্থিক সচ্ছলতার জন্য তিনি ঐতিহাসিক কাজ করে গিয়েছিলেন। আর্থিক আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লেডিস ক্লাবের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন তিনি দ্বিগুণ করে দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশের কথা চিন্তা করে লেডিস ক্লাবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্ববীণা সঙ্গীত একাডেমী। ১৯৮৪ সালে এমএ সামাদ জীবন বীমা করপোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদ থেকে অবসরের পর একটি সাধারণ বীমা কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ নেন। আর এ মূল্যবান সময়ে বেগম ফওজিয়া সামাদ প্রাণান্ত উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে এমএ সামাদকে কোম্পানি গঠনে সার্বিক সহযোগিতা করেন। ফলে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠান বিজিআইসি ১৯৮৫ সালের ২৯ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ১৯৮৫ সালে বেগম ফওজিয়া সামাদ বঞ্চিত দরিদ্র শিশু-কিশোরদের শিক্ষা অর্জনের কথা চিন্তা করে 'কুসুমকলি' নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। কুসুমকলি স্কুলের ৯টি শাখা রয়েছে। শাখাগুলো হলো_ ঢাকার লালমাটিয়ায় দুটি, ধানমণ্ডির রায়ের বাজারে একটি, শ্যামলীতে একটি, ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে একটি, রামপুরা উলনে দুটি, খিলগাঁও গোড়ানে দুটি। বেগম ফওজিয়া সামাদের নেতৃত্বে কুসুমকলি স্কুলের শিক্ষার্থীরা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন। পড়ালেখা শেষে তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন, এমন স্বপ্নও দেখছেন। বেগম ফওজিয়া সামাদের ইন্তেকালের পর কুসুমকলি স্কুলের কোনো ক্ষতি যেন না হয়, সে ব্যবস্থাও তিনি করে গেছেন। ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন এ দেশের বেগম ফওজিয়া সামাদ একজন কিংবদন্তি নারীনেত্রী হিসেবে। একটানা ৩৮ বছর লেডিস ক্লাবের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এক বিরল সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন তিনি। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় এক ছেলে ও তিন মেয়ে এবং নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে বেগম ফওজিয়া সামাদ এ বছরের ২৫ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের গ্গ্ন্যানিকেল হসপিটালে সকাল ৫টা ৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
 

No comments

Powered by Blogger.