নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-কেন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন তাহের? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মই হয়নি তাহেরের। দেশ স্বাধীন হওয়ার আরও ছয় বছর পর ১৯৭৭ সালে তাঁর জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর কোনো স্মৃতি থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার কাছে শুনেছেন নিজের পরিবারের দুর্ভোগ-লাঞ্ছনা ও দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা।


বাবা মমতাজউদ্দিনের আবাস ও সামান্য জমি ছিল রাউজানের ইদিলপুর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগে ও মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস রাউজানের মানুষ কী দুঃসহ জীবন কাটিয়েছে, তার সাক্ষ্য আজও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেখানকার বিভিন্ন পরিবারে, গ্রামের পথে-ঘাটে-প্রান্তরে। মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ও পাকিস্তানের তৎকালীন স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা) অনুগত বাহিনীর হত্যা-নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের কারণে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক মানুষজন ও সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর জন্য দোজখে পরিণত হয়েছিল রাউজান।
যারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছিল, তাদেরই একজন মমতাজ উদ্দিন। ভিটেমাটি ফেলে তিনি সপরিবারে চলে গিয়েছিলেন রাঙামাটি। এ সময় তাঁর অসুস্থ সদ্যোজাত কন্যাসন্তানটি মারা গিয়েছিল বিনা চিকিৎসায়। রাঙামাটিতে গিয়ে পুরোনো শহীদ মিনার এলাকায় বাসস্ট্যান্ডে একটি ঝুপড়ি তুলে ভাতের হোটেল দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি তাঁর। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করেন—এই অভিযোগে তাঁর হোটেলটি পুড়িয়ে দিয়েছিল রাজাকাররা। আবু লাইনম্যান নামের একজন মুক্তিযোদ্ধার নিয়মিত যাতায়াত ছিল এই হোটেলে। তাঁকে খুঁজতে এসে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা বেধড়ক পিটুনি দেয় তাঁকে। অশীতিপর বৃদ্ধ মমতাজউদ্দিন আহমদ এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই স্মৃতি। বাবার কাছে সেই দিনগুলোর কথা শুনে দেশ, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা নিয়ে এক ধরনের আবেগ ও ভালোবাসার অনুভূতি জন্ম নিয়েছিল তরুণ তাহেরের মনে, পাশাপাশি রাজাকার-আলবদরের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা।
বঙ্গবন্ধুর কথা শুনেছিলেন বাবার কাছে, ইতিহাস পড়ে জেনেছিলেন, তাঁর নেতৃত্বে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল পুরো জাতি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড তাই ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে তাহেরকে। স্কুলজীবনে জড়িয়ে পড়েছিলেন এক-আধটু রাজনীতির সঙ্গে। কোনো পদ-পদবি ছিল না, জাতীয় ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি। এইচএসসি পাস করে দায় নিতে হয়েছে সংসারের। গাড়ি চালানো শিখে চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাটে এসে নিয়মিত মাইক্রোবাস চালানোর কাজ নিয়েছেন। এর মধ্যে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন, জনক হয়েছেন সন্তানের। এভাবে চলতে থাকলে মো. আবু তাহের উদ্দিনকে নিয়ে নতুন করে কিছু লেখার ছিল না। কিন্তু তাহেরের জীবনটি হঠাৎ পাল্টে গেল একটি ঘটনার সূত্রে।
২০০৯ সালের ২০ নভেম্বর কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রামে আসছিলেন তাহের। পথে ফটিকছড়ির বিবিরহাটে নেমেছিলেন চা খাওয়ার জন্য। সেখানে শুনলেন, বিএনপির স্থানীয় একটি সমাবেশে বক্তব্য দেবেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিন বন্ধু হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন, সভায় যোগ দিয়ে শুনবেন কী বলেন সাকা। সেদিন তাঁর বক্তব্য শুনে ক্ষোভে-বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন তাহের ও তাঁর বন্ধুরা।
মাত্র এক দিন আগে বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় ঘোষণা হয়েছে। এর এক দিন পরই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, তাঁর হত্যাকাণ্ডের রায় নিয়ে প্রকাশ্যে এ রকম কটূক্তি করার, বিদ্রূপ ও ব্যঙ্গ করার সাহস স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত একজন রাজনীতিক কোথায় পেলেন তা ভেবে পাননি তাঁরা। মুঠোফোনে পুরো বক্তৃতার ভিডিও ধারণ করলেন তাহের। ঠাট্টা-তামাশা করে অনেক কথা সাকা বলেছেন। বলেছেন, ১৫ আগস্ট জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিন; ১৫ আগস্ট না হলে বাংলাদেশের জনগণ ভোটের অধিকার ফিরে পেত না; বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় জাতি মেনে নেয়নি; প্রয়োজনে ১৫ আগস্ট থেকে শিক্ষা নিতে হবে ইত্যাদি।
তাহের ঠিক করলেন, এই ঔদ্ধত্যের প্রতিবাদ জানাবেন। নভেম্বরের ২৯ তারিখ আদালতে গেলেন তিনি। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেই বলে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা নেওয়া হলো না। ডিসেম্বরের ১ তারিখ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাকার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অনুমতি চেয়ে আবেদন করলেন। ৩ ডিসেম্বর মামলা উঠল আদালতে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন সাকার বিরুদ্ধে। তিনি বিদেশে ছিলেন, ফিরে এসে ৬ ডিসেম্বর জামিন নিলেন হাইকোর্ট থেকে।
এর পর থেকে শুরু হলো হুমকি-ধমকি-নির্যাতন। সাকার বাহিনী পিছু নিল তাহেরের। চট্টগ্রাম শহরের বাদুড়তলায় তাঁর ভাড়া বাসায় হামলা করল তারা। সৌভাগ্যক্রমে বাসায় ছিলেন না তাহের। কিন্তু ঘরের মালপত্র ভেঙেচুরে কর্মফল ভোগ করার বার্তা দিয়ে গেল তারা। এরপর এক বছরের মধ্যে ১১ বার বাসা বদল করতে হয়েছে তাঁকে। স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ছদ্মবেশে আজ এখানে, কাল ওখানে থেকেও রেহাই পাননি তাহের। অন্তত ১৮ বার হামলার শিকার হয়েছেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে নগরের বিভিন্ন থানায় ১০টি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন তিনি। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি, এমনকি গেল বছরের ২৬ মার্চ রাঙামাটির শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে সরকারি গানম্যানের উপস্থিতিতেই শিকার হয়েছেন সাকা বাহিনীর।
তাহের ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা থাকবেন তাঁর পাশে। কিন্তু সে রকম সাহায্য-সহযোগিতা তো পানই নি, বরং সেখানেও আছে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা। মুঠোফোনে উপর্যুপরি হুমকি পেয়ে পাঁচলাইশ থানায় গিয়েছিলেন অভিযোগ জানাতে। পুলিশের কর্মকর্তা হুমকিদাতার ফোন নম্বর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে জানতে পারেন, নম্বরটি চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের একজন নেতার ছেলের। পুলিশের কর্মকর্তা ওই ছেলের সঙ্গে কথা বললে তিনি ফোন করার কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘জাস্ট ফান।’
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অসহযোগিতা বা কারও কারও বিরূপ আচরণের পেছনে কী মনস্তত্ত্ব কাজ করছে জানতে চেয়েছিলাম। তাহের জানিয়েছেন, ‘হয়তো তাঁদের ধারণা, আমি সাকার বিরুদ্ধে মামলা করে দলে পদ-পদবি পাওয়ার বা নেতা হওয়ার চেষ্টা করছি।’ বিষণ্ন কণ্ঠে তাহের বললেন, ‘আমি তো নেতা হতে চাই না, সে যোগ্যতাও আমার নেই। আমি শুধু চেয়েছি, যাদের হাতে এ দেশের মানুষ নির্যাতিত হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা খুন হয়েছেন, যারা স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে দেশের স্থপতির সম্পর্কে প্রকাশ্যে কটূক্তি করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে, তাদের বিচার হোক।’
ঘরে-বাইরে এ রকম শত্রুতা, হুমকি-হামলা-মামলার শিকার হয়ে পর্যুদস্ত তাহের গত ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যদি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গ্রেপ্তার না হন, তাহলে ওই দিন রাতেই আত্মহত্যা করবেন তিনি। বলেছেন, ‘আমার জীবন দিয়ে যদি এই ঘাতকের বিচার হয়, তাহলে আমি জীবন দিতে চাই। এতে শহীদদের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।’
৩১ ডিসেম্বরের আগেই সাকা চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ায় জীবন দিতে হয়নি তাহেরকে। কিন্তু জীবন এখনো তাঁর শঙ্কামুক্ত নয়। ১৯ জানুয়ারি সাকার বিরুদ্ধে ফটিকছড়ি থানা পুলিশের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম আদালত ভবন প্রাঙ্গণে সাকার সমর্থকদের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি। পুলিশের উপস্থিতিতেই এই সমর্থকেরা বারবার হামলা করতে চেয়েছে তাঁর ওপর। এমনকি পুলিশ তাঁকে রক্ষা করতে গেলে পুলিশের ওপরও হামলা চালিয়েছে সাকার বাহিনী। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন সাকার স্ত্রী-পুত্র-কন্যারাও।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সালাউদ্দিনের স্ত্রী-কন্যারা আবেগময় বক্তব্য দেন, তাঁদের স্বামী বা বাবার প্রতি অমানবিক আচরণের অভিযোগ করেন। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোও তাঁর প্রতি মানবিক আচরণের আবেদন জানিয়েছে। আমাদের এতে দ্বিমত নেই। কিন্তু সালাউদ্দিনের বিরোধিতা করেন যাঁরা, যাঁরা তাঁর কৃতকর্মের বিচার চান, তাঁদের প্রতি মানবিক আচরণ হচ্ছে কি না, তাঁরা নিঃশঙ্কচিত্তে বিচার প্রার্থনা করতে পারছেন কি না, সেই নিশ্চয়তা দেবে কে? তাঁদের ওপর হুমকি-হামলার প্রতিকার করা, অনুগত সন্ত্রাসী বাহিনীর হাত থেকে তাঁদের রক্ষা করাটাও নিশ্চয়ই মানবাধিকারের পর্যায়েই পড়ে?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.