পানি ব্যবস্থাপনা-ঢাকার নদী-খাল সংরক্ষণের দায়িত্ব কার? by ম. ইনামুল হক

ঢাকার ভেতরের এবং আশপাশের নদী, খাল ও জলাভূমি দখল ও দূষণ নিয়ে লেখালেখির শেষ নেই। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। ওয়াসা ও বিআইডব্লিউটিএ খাল উদ্ধার ও নদী খননের প্রকল্প হাতে নিচ্ছে, ঘটা করে তার উদ্বোধনও হচ্ছে, পত্রপত্রিকা-টেলিভিশনে ফলাও করে প্রচারও হচ্ছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য বা বিপরীত।


হচ্ছে আরও দখল, আরও দূষণ। সবই কি দুর্নীতির কারণে, নাকি গোড়ায় গলদ? কারণ, আমরা ভুল পথে চলছি। আমরা কাজটা যার নয়, তাকে টাকা দিচ্ছি আর সে বাহাদুরি নিতে গিয়ে সব লেজেগোবরে করে দিচ্ছে।
মূল প্রশ্ন হলো, ঢাকার নদী, খাল, জলাভূমি সংরক্ষণের দায়িত্বটা কার? সঠিক উত্তর হলো, পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কিন্তু আমরা তার জবাবদিহি চাই না। প্রশ্ন উঠতে পারে, অভিযোগের ভিত্তি কী? উত্তর হলো, এসব প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রের আইন এবং মন্ত্রণালয়গুলোর ওপর অর্পিত কার্যপ্রণালিবিধিই প্রমাণ। আইন অনুয়ায়ী, ওয়াসার দায়িত্ব বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং পয়োবর্জ্য শোধন করে নদীতে ফেলা। বিআইডব্লিউটিএর দায়িত্ব নদীপথের ঘাটগুলো পরিচালনা ও সংরক্ষণ এবং নদীপথ সচল রাখা। নিষ্কাশন বা নদী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এ দুই প্রতিষ্ঠানের কারোরই নয়। রাষ্ট্রীয় আদেশে এ দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের।
২০০০ সালের ২৬ নম্বর আইনের ৬(ক) ধারায় নদী ও নদী অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন, সেচ ও খরা প্রতিরোধের লক্ষ্যে জলাধার, ব্যারাজ, বাঁধ, রেগুলেটর বা অন্য যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। এর ১৫ ধারায় এক হাজার হেক্টরের অধিক এলাকার নিষ্কাশন প্রকল্প গ্রহণ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওপর ন্যস্ত আছে। বাংলাদেশে সরকারের চলতি কার্যবিধি অনুযায়ী, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওপর অর্পিত দায়িত্বের মধ্যে ২ ধারায় সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, নিষ্কাশন ও ভূমিক্ষয় রোধে সাধারণ নীতিমালা প্রণয়ন এবং কারিগরি সহায়তা এবং ৮ ধারায় ভূমি সংরক্ষণ, নিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা দূর ইত্যাদি কথা বলা আছে। এসব কারণেই পানি উন্নয়ন বোর্ড ঢাকা মহানগরকে পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশে ভাগ করে নিষ্কাশন প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। এর পূর্বাংশের এলাকা ১২ হাজার ৪০০ হেক্টর, পশ্চিমাংশের ১৩ হাজার ৬০০ হেক্টর। এর মধ্যে পশ্চিমাংশের কাজ অনেক এগিয়েও গেছে। কিন্তু এ দুটি প্রকল্পের প্রধান কাজ বাঁধের ব্যাপারেই আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের খবরদারি করি, নিষ্কাশনের বেলায় খোঁজ নিই না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় একটা বড় সুবিধা হলো, খাল-নদী জরিপের জন্য এর একটি মরফোলজি সার্কেল আছে এবং ছয়টি ডিজাইন সার্কেলের অধীনে একটি বড় ডিজাইন দপ্তর আছে। ঢাকার নদী ও নিষ্কাশন খালগুলো পুনরুদ্ধারে এসব জরিপ ও ডিজাইন দপ্তরের মাধ্যমে প্রবাহপথের নকশা করা দরকার। উল্লেখ্য, একটি নিষ্কাশন খালের পাড় থাকে, বৃষ্টিপাতের সময় যা উপচে পানি প্রবাহিত হয়। ঢাকার খালগুলোর পাড় এমনকি তলাও ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টিপাতের সময় পানিপ্রবাহপথ না পেয়ে শহরের ভেতর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে রাস্তাঘাট তলিয়ে দেয়। তাই শুধু খাল উদ্ধার করেই নয়, এর প্রবাহপথ পুনরায় ডিজাইন করে পুনর্বহাল করা দরকার। না হলে খাল উদ্ধার হলেও বর্জ্য, মাটি ও বালুতে ভরাট হয়ে থেকে প্রবাহপথের উন্নতি করতে পারবে না। এ রকম বেহাল দশাই বরং পুনরায় দখলদারদের প্রলুব্ধ করবে। ঢাকার জেলা প্রশাসক ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসেবে কেবল ইজারা দিতে পারেন, আবার খাল পুনরুদ্ধার করার মহড়া করতে পারেন, কিন্তু নগরের জলাবদ্ধতা দূর করা তাঁর কম্ম নয়। তবে তিনি যদি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুপারিশমতো খালগুলোর নকশা অনুযায়ী প্রবাহপথ বজায় রাখতে আইন প্রয়োগ করেন এবং প্রবাহপথের জমি ইজারা দেওয়া বন্ধ করেন, তাহলে কাজ হবে। প্রশ্ন হলো, পানি উন্নয়ন বোর্ড তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে কতটা আগ্রহী?
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রতিদিনের চাহিদা ১৮০ কোটি লিটার পানির বিপরীতে ওয়াসার শোধন কারখানা থেকে আসে সর্বোচ্চ ২৭.৫ কোটি লিটার। বাকিটা আসে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর থেকে; এই পানি শোধন করা লাগে না। এ দুই নগরের পয়োবর্জ্যের পরিমাণ দৈনিক দেড় হাজার টন। ওয়াসা তার পাগলার একমাত্র পয়োবর্জ্য শোধনকেন্দ্র থেকে শোধন করে সর্বোচ্চ ১২০ হাজার টন, বাকিটা কাভার্ড ড্রেন ও স্টর্ম সিউয়ারের মাধ্যমে খাল আর নদীতে পাঠিয়ে দেয়। এ দুই নগরে এখন প্রতিদিন ছয় হাজার টন কঠিন বর্জ্য এবং ৫০ হাজার টন তরল শিল্পবর্জ্য সৃষ্টি হয়। কঠিন বর্জ্যের অর্ধেকের মতো আশপাশে ছড়িয়ে গেলেও বাকিটা এবং শিল্পবর্জ্যের পুরোটাই চলে যায় নদী, খাল ও জলাভূমিতে। বিআইডব্লিউটিএ বুড়িগঙ্গা নদীর বর্জ্য তোলার প্রকল্প হাতে নিয়ে এক তামাশা শুরু করেছে। এতে যে পরিমাণ কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন তোলা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব কে রোধ করবে?
আশি ও নব্বইয়ের দশকে ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্য ঢাকাসহ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে ঢাকা মহানগর, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ তথা সরকারি জমির জবরদখল ঠেকাতে জারি হয় ২০০০ সালের ৩৬ নম্বর আইন। কিন্তু কোনো শহরে এ আইন কার্যকর করার জন্য অবশ্যই পৌর এলাকার একটি মাস্টারপ্ল্যান থাকার প্রয়োজন ছিল, যা কেবল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী মহানগরের আছে। দেশের অধিকাংশ পৌর এলাকার কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় আইনটি সেখানে অকার্যকর হয়ে যায়। এদিকে ঢাকা মহানগরের ১৯৯৭ সালের মাস্টারপ্ল্যানও কাজে এল না। কারণ সড়ক, শিল্প এলাকা, আবাসিক এলাকা, উদ্যান, জলাভূমি ও বিপণি এলাকার বিস্তারিত নগর পরিকল্পনার কিছুই তার মধ্যে ছিল না।
ঢাকা মহানগরের আশপাশের সরকারি জমি জবরদখল ঠেকাতে হাইকোর্ট ২৫ জুন ২০০৯ সিএস ম্যাপের ভিত্তিতে ঢাকার নদী ও জলাভূমির সীমানা নির্ধারণের আদেশ দেন। কিন্তু ২০১০ সালে রাজউকের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ প্রণয়ন করা হয় আরএস ম্যাপের ভিত্তিতে, যাতে নদী, খাল ও জলাভূমির অবৈধ দখলকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এতে হাইকোর্টের আদেশ মোটেই কার্যকর করা যাবে না। তা ছাড়া ১৯৯৭ সালের মাস্টারপ্ল্যানে ‘ফ্লাড প্লেইন’ বা প্লাবনভূমি হিসেবে চিহ্নিত পূর্ব দিকের নিম্নভূমি এলাকাকে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে শহর হিসেবে দেখিয়ে বালু নদের তীরের বেরাইদ, সাঁতারকুল, বালুরপাড় গ্রামগুলো বরাবর উঁচু জায়গায় নতুন করে হ্রদ সৃষ্টি করার নকশা দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং উদ্দেশ্যমূলক এই নকশার মাধ্যমে ঢাকার চারদিকে ভূমিদস্যুদের দখলকৃত ও বালু দিয়ে ভরাটকৃত বিস্তীর্ণ জলাভূমি দখল করাকে বৈধতা দেওয়া হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ সৃষ্টি করে। কার্যপ্রণালিবিধি অনুযায়ী এই বোর্ডকে কার্যকর করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনেক দায়িত্ব একে দেওয়া যেত। কিন্তু এই বোর্ড কোনো আইনের মাধ্যমে গঠিত না হওয়ায় এখনো সাবালকত্ব অর্জন করতে পারেনি। এই বোর্ডের নাম পাল্টে ‘হাওর ও জলাভূমি সংরক্ষণ বোর্ড’ করে এবং পানিসম্পদমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে একে এখনই কার্যকর করা দরকার। ঢাকা মহানগরের জলাভূমিগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব একটি নির্দিষ্ট সংস্থার হাতে পড়লে জবাবদিহি বাড়বে।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে সরকার যতই প্রকল্প গ্রহণ করুক বা সেসবের অগ্রগতির প্রচার করুক না কেন, জনগণের দেওয়া রাজস্বের টাকা অপচয় আর লুটপাট হয়ে দুর্বৃত্তদের পেটে যাবে ও যাচ্ছে। ফলে সমস্যা তো দূর হবেই না, বরং বাড়বে এবং বাড়তি হিসেবে জনগণের ঘাড়ে চাপবে প্রকল্প গ্রহণ বাবদ অতিরিক্ত ঋণের বোঝা।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক: সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা।
minamul@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.