যত মাসুল দেশবাসীর by রাজীব আহমেদ

চার বছর আগে রাজধানীর বাংলামোটর সিগন্যালে একটি কাভার্ড ভ্যানের চাপায় পা হারিয়েছিলেন রংপুরের পীরগঞ্জ থানার কোচারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আশরাফ হোসেন। এখন সেই সিগন্যালেই ভিক্ষা করে সংসার চলে তাঁর। একটি হুইল চেয়ারের মতো ভ্যানের পাশাপাশি তাঁর আছে বিয়ারিং দিয়ে তৈরি ছোট বাহন।


এটাতে চড়েই তিনি সিগন্যালে আটকে থাকার সময় গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে ভিক্ষা চান। গতকাল রবিবার হরতালের দিনে রাস্তায় কোনো সিগন্যাল পড়েনি, আশরাফ হোসেনের ভিক্ষার ঝুলিতে তাই একটিও পয়সা পড়েনি। বিকেল ৫টা পর্যন্ত তাঁর আয়ের অঙ্ক ছিল শূন্য; অন্য দিন যেখানে আয় হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় দিনের পর দিন চলতে থাকা হরতাল মানুষের জীবনে বহুমাত্রিক দুর্ভোগ বয়ে এনেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের আয়ের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বাহন না থাকায় অতিপ্রয়োজনে যাতায়াতেও বিরাট দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ভাড়া গুনতে হচ্ছে অনেক বেশি। সরবরাহ সংকটে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান ব্যাহত হচ্ছে। পেছাতে পেছাতে পরীক্ষা কবে শেষ হবে, তা অনিশ্চিত হয়ে গেছে।
গতকাল আশরাফ হোসেন জানান, সকালে তিনি ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন ঠিকই কিন্তু রাস্তা ছিল ফাঁকা। দ্রুত-পায়ে হাঁটতে থাকা মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইলেও পাওয়া যায় না। তাই সকাল থেকে কারো কাছে ভিক্ষাও চাননি তিনি। দুপুরে পরিবাগের একটি দোকান থেকে রুটি আর সবজি খেয়েছেন আগের জমানো ২০ টাকা দিয়ে। তিনি বলেন, সিগন্যাল ছাড়া অন্য কোথাও ভিক্ষা করে সুবিধা করা যায় না। এতে ভিক্ষার স্থান হাতছাড়া হওয়ার ভয়ও থাকে। সিগন্যালে গাড়ির জানালায় টোকা দিয়ে ভিক্ষা চাইলে কখনো কখনো ১০০ টাকাও ভিক্ষা পাওয়া যায়। গড়ে দিনে ৩০০ টাকার মতো আয় হয়। কিন্তু হরতাল হলে একলাফে তা অনেক অনেক নিচে নেমে যায়।
শিক্ষা ভবনের গেটে মুচির কাজ করেন মতিলাল। গতকাল সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তাঁর আয় হয়েছে মাত্র ৫০ টাকা। এর ৪০ টাকাই আবার খাওয়ার পেছনে ব্যয় হয়ে গেছে। মতিলাল জানান, হরতাল না থাকলে শিক্ষা ভবন এলাকা মানুষে মানুষে ভরা থাকে। তখন দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। নিজের খরচ আছে দৈনিক ১০০ টাকার বেশি। গতকাল আয় একেবারে কম হয়েছে বলে খরচও কমিয়ে দিয়েছেন। মতিলাল বলেন, আয় ভালো হলে দিনে চার-পাঁচবার চা-বিস্কুট খেতে যান। কিন্তু গতকাল একবারও খাওয়া হয়নি।
মতিলালের মতো অনেকেই খরচ কমিয়ে দিয়েছেন বলে চা-বিস্কুট বিক্রেতা কিশোর আলমগীর হোসেনের বিক্রিও অর্ধেকে নেমেছে। গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আলমগীর বিক্রি করেছেন ৫০০ টাকার চা-বিস্কুট। অন্যদিন সেটা ৮০০-৯০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আলমগীর জানান, সিলেটের গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় এসে তিনি চা বিক্রি করেন। ১৫-২০ দিন বিক্রি করার পর চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আবার বাড়িতে যান তিনি। এভাবে হরতাল হলে বাড়ি যাওয়ার সময় দুই আড়াই হাজার টাকাও জমানো যাবে না বলে আশঙ্কা তাঁর।
অন্য দিন না এলেও ক্ষতি কম, কিন্তু হরতালে অফিসে যেতেই হয় সরকারি কর্মকর্তাদের। তবে সরকারি পরিবহন বন্ধ থাকে বলে যাতায়াতের দুর্ভোগ দ্বিগুণ হয় তাঁদের। খাদ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাঁদের সরকারি গাড়ি বন্ধ রাখা হয়েছে। এ জন্য আজিমপুর থেকে তাঁকে রিকশায় অফিসে যেতে হয়েছে। এতে ভাড়া লেগেছে ২৫ টাকা। তিনি বলেন, সরকারি পরিবহনে তাঁদের মাসে ১৬ টাকার মতো খরচ হয়। পাঁচ দিনের হরতালে তাঁকে রিকশাভাড়া বাবদ অতিরিক্ত ৩০০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এই অতিরিক্ত খরচটি একজনের বাসার ডিশ সংযোগের বিলের সমান।
বরিশালের আগৈলঝাড়া থানা থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসতে হয়েছে আকবর হোসেনকে। ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে তিনি এনজিওগ্রাম করে দেখতে চান হার্টে কোনো ব্লক রয়েছে কি না। হরতাল না হলে তিনি বাসেই আসতেন। এতে সন্তান ও নিজের খরচ হতো ৮০০ টাকা। কিন্তু হরতালের কারণে তাঁকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আসতে হয়েছে। ভাড়া লেগেছে ৯ হাজার টাকা।
আকবর হোসেনের ছেলে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আসগর হোসেন বলেন, হৃদরোগের রোগী নিয়ে হরতাল শেষ হওয়ার অপেক্ষা করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বরিশাল শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের আগৈলঝাড়া থানায় অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসতে হয়েছে। সেখান থেকে আবার ঢাকায় আসতে হয়েছে।
এদিকে হরতালে ঢাকার বাজারে বিক্রি হয় বিবর্ণ সবজি আর মান নষ্ট হয়ে যাওয়া মাছ। তা কিনতেও আগের দিনের চেয়ে হরতালের দিনে বেশি দাম দিতে হয় ক্রেতাকে। কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার বাজারে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মাছ-সবজিসহ ট্রাক আসার সংখ্যা একেবারেই কমে যায়। কারওয়ান বাজারে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার ট্রাক আসে। কিন্তু হরতাল হলে সে সংখ্যা ৫০০-তে নেমে আসে।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব ট্রাক আসে তারা আবার ঢাকা থেকে পণ্য নিয়ে ফেরত যায়। হরতালে ঢাকার দোকানপাট বন্ধ থাকায় তারা কোনো ট্রিপ পায় না। এই অনিশ্চয়তার কারণে বেশির ভাগ মালিক হরতালে ট্রাক পাঠাতে চান না। সরবরাহ সংকটে দাম বেড়ে যায় মাছ ও সবজির।
কাপ্তানবাজারের ফরিদপুর মাছের আড়তের বিক্রেতা মো. মামুন বলেন, হরতাল হলে সবার মধ্যেই একটা ভয় থাকে। এতে মাছের সরবরাহ কমে যায়। পাইকার কম থাকে। বিক্রি কম হয়। এটা হরতালের একটি সাধারণ চিত্র।
রাজধানীর কাজীপাড়ার একটি ছোট বাজার বউবাজারের সবজি বিক্রেতা জাকির হোসেন জানান, তাঁরা সবজি কেনেন মিরপুর এক নম্বর সেকশনের কাঁচাবাজার থেকে। হরতালের দিনে বিভিন্ন বাজারের খুচরা বিক্রেতাদের পক্ষে সবজি ও মাছ কিনে সকাল সকাল ফেরত যাওয়া সম্ভব হয় না বলে অনেকে কিনতে যায় না। বিশেষ করে ভ্যানে করে যাঁরা সবজি বিক্রি করেন, তাঁরা অনেকেই হরতালে ব্যবসা বন্ধ রাখেন।
পচনশীল পণ্য হওয়ায় ফল ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগেরও কমতি নেই। বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হারুন অর রশিদ বলেন, ফল পচনশীল পণ্য। হরতাল হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ফল ব্যবসায়ীদের। বন্দর থেকে ফল খালাসে যেমন অসুবিধা, তেমনি গুদামে এনে রাখাও দুষ্কর। কারণ ফল কিনতে আসা পাইকারের সংখ্যা কমে যায় বলে বিক্রিও কমে যায়। টানা হরতাল হলে ফল পচে গিয়ে অনেক সময় ব্যবসায়ীদের বিরাট লোকসান দিতে হয়। তিনি জানান, বাদামতলীর ফলের বাজারে দৈনিক সাত থেকে আট কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু হরতালের দিনে সকালে কিছু বিক্রি হয়। লেনদেন এক কোটি টাকারও কম হয় বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকার বহু মার্কেটের ব্যবসায়ীরা কো-অপারেটিভ সোসাইটি থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন। দিন শেষে সমিতির লোকেরা এসে দৈনিক কিস্তির টাকা নিয়ে যান। হরতালের কারণে দোকানে বেচাকেনা না থাকলে ঋণ পরিশোধে দুর্ভোগে পড়েন ক্ষুদ্র দোকান মালিকরা।
হরতালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাণিজ্য ও পরিবহন খাত। গত অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্যের অবদান ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। পরিবহন ও যোগাযোগ থেকে ছিল প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা। আর হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের অবদান ছিল পাঁচ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এ তিন খাতে প্রতিদিনের উৎপাদন প্রায় ৫৫৮ কোটি টাকা। দেশের জিডিপির আকার প্রায় সাত লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। দৈনিক উৎপাদনের মূল্য প্রায় দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে যখন এর পরিমাণ অর্ধেক ছিল তখন এক দিনের হরতালে ৫৫৪ কোটি টাকার ক্ষতি হতো বলে ইউএনডিপির এক গবেষণায় উঠে এসেছিল।
ঢাকার অন্য মার্কেট খোলা রাখা সম্ভব হলেও পলওয়েল মার্কেট হরতালে কোনোভাবেই খোলা রাখা সম্ভব হয় না। ওই মার্কেটের কাছেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। মার্কেটটির দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম তালুকদার মনি বলেন, হরতালে কোনোভাবেই দোকান খোলা রাখা সম্ভব হয় না। খোলা রাখলে কোনো ক্রেতা আসতে পারেন না। টিয়ারশেল এসে দোকানে পড়ে। চলতি মাসে হরতাল, সাপ্তাহিক বন্ধ মিলিয়ে ১০-১২ দিন বন্ধ ছিল। এতে ব্যবসায়ীদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ব্যবসা বলতে কিছু থাকছে না।
তিনি বলেন, বেশির ভাগ দোকান ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে। তাঁদের সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ভিত্তিতে ঋণের কিস্তি দিতে হয়। দোকান বন্ধ থাকলে ব্যবসা হবে না। ঋণ শোধ হবে না। ব্যবসায়ীরা খেলাপি হবেন।

No comments

Powered by Blogger.