খোলা চোখে-দিন বদল হয় যেভাবে by হাসান ফেরদৌস

লেনিন বলেছিলেন, বিপ্লব হতে হলে দুটি জিনিস দরকার। এক. শাসিত, অর্থাৎ দেশের সাধারণ মানুষ এমন একটা অবস্থায় পৌঁছাবে যে তারা পুরোনো ব্যবস্থার অধীনে দেশ চলুক, তা আর মানতে চাইবে না; এবং দুই. যাঁরা শাসক, তাঁদের পক্ষে আর পুরোনো কায়দায় দেশ চালানো সম্ভব হবে না। এই দুই পরিস্থিতি যখন এক বিন্দুতে এসে মেলে, তখন সৃষ্টি হয় বৈপ্লবিক পরিস্থিতির।


আর বৈপ্লবিক পরিস্থিতি থেকে ঘটনা গড়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনে।
তিউনিসিয়ায় যা ঘটছে, অনেকেই তাকে বলছেন বিপ্লব। এর একটা নামও দেওয়া হয়েছে—জেসমিন রেভল্যুশন। সে দেশের জাতীয় ফুল জুঁই, সেই থেকে জুঁই বিপ্লব। শোষিত ফুঁসে উঠেছে, ভয়ে পালিয়েছেন শাসক। লেনিন তো এমন পরিস্থিতির কথাই বলেছিলেন। কিন্তু এর ফলে যে পরিবর্তন ঘটছে অথবা পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা ধরে রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। গত এক দশকে আমরা নানা বিপ্লব দেখেছি—চেকোস্লোভাকিয়ার ভেলভেট বিপ্লব, মিয়ানমারের স্যাফরন বিপ্লব, উক্রাইনের অরেঞ্জ বিপ্লব, জর্জিয়ার রোজ বিপ্লব। আমেরিকায় ওবামার উত্থান, সেটাও এক রকমের বিপ্লব বলেই তাকে আমরা অভিনন্দিত করেছিলাম। একটিও শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। তার বড় কারণ, বিপ্লবের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতা। অন্য কারণ বিপ্লব সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই জনতার রাজনীতির মধ্যমাঠ ছেড়ে দেওয়া।
গত কয়েক সপ্তাহ তিউনিসিয়ার খবর জানার জন্য আমরা সবাই টিভির পর্দায় হাঁ হয়ে তাকিয়ে রয়েছি। বড় ধরনের কোনো রক্তারক্তি ছাড়াই জনতার প্রাথমিক বিজয় হয়েছে। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ, মাঝেমধ্যে পুলিশের লাঠিপেটা, টিয়ারগ্যাস—এসব আছে, কিন্তু চারদিকে উৎসবের এমন সাজ তিউনিসিয়া কখনো দেখেনি। টিয়ারগ্যাসে চোখ জ্বলছে, এক নারী চোখে পানি দিতে দিতে বললেন, ‘এমন সুন্দর দিন আগে কখনো দেখিনি।’ রাস্তায় ট্যাংক, এক সৈনিকের টুপিতে লাল টুকটুকে একটি ফুল গুঁজে দিচ্ছে এক তরুণ। দুই আঙুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে সে বলল, মুক্তি, মুক্তি!
এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে, তাও এই তিউনিসিয়ায়—কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। ২৩ বছর একটানা ডান্ডা হাতে নিয়ে দেশ শাসন করেছেন বেন আলী একাই। বিরোধী কোনো দলকে, কোনো নেতাকে মাঠে জায়গা দেননি। সেই বেন আলী স্ত্রী নিয়ে বাপ বাপ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সঙ্গে সুটকেস-বোঝাই সোনা ও নগদ টাকা। চেয়েছিলেন ফ্রান্সে আশ্রয় নিতে, কিন্তু ফরাসি সরকার তাঁর বিমান নামার অনুমতি দেয়নি। শোনা যাচ্ছে, লোটা-কম্বল নিয়ে তিনি এখন সৌদি আরবে। মজার ব্যাপার হলো, একদম গরিব দেশ নয় তিউনিসিয়া, লোকজন সেখানে না খেয়ে মরেছে, তাও নয়। বেন আলী একনায়ক ছিলেন বটে, কিন্তু আফ্রিকার অন্য অনেক দেশের তুলনায় দেশটা সবার চোখে ভদ্র, সভ্য ছিল। আইনশৃঙ্খলা ছিল, রাস্তাঘাট সব সাফ-সুতরো। অধিকাংশ আরব দেশে বড় ভয় ইসলামি মৌলবাদীদের নিয়ে। বেন আলীর তিউনিসিয়ায় সে ভয়ও ছিল না। সব মৌলিবাদীকে একদম ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন তিনি। এই সভ্য ও আধুনিক তিউনিসিয়া পশ্চিমের কাছে ছিল ‘মডেল কান্ট্রি’। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে এই সেদিনও আমেরিকা প্রায় দেড় শ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠানোর কথা দিয়েছে। ফ্রান্স তিউনিসিয়ার সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু; বেন আলীর প্রশংসা করে তাঁর সমর্থন জানিয়েছে রাস্তায় জনতা নামার পরও। অথচ তাঁর পায়ের নিচে যে মাটি নেই, কেউ টের পায়নি।
বেন আলীর মতো অধিকাংশ আরব শাসকের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখার প্রধান অস্ত্র হলো নিজের তাঁবেদার সেনা ও পুলিশ বাহিনী। এর বাইরেও রয়েছে তাঁদের ব্যক্তিগত পেটোয়া বাহিনী। যে কাজ পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে করা কঠিন, যেমন—দিনদুপুরে আগুন জ্বালানো, রাজনৈতিক বিরোধীদের সবার সামনে পিটিয়ে লাশ বানানো, চোখের সামনে কাউকে তুলে নিয়ে গুম করা—সেসব কাজ করানো হয় ওই পেটোয়া বাহিনী দিয়ে। যেমন হয় হোসনি মোবারকের মিসরে, বাদশা হাসানের মরক্কোতে, আহমাদিনেজাদের ইরানে। এরশাদ বা খালেদা জিয়ার আমলে বাংলাদেশেও সেই অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। আরব একনায়কদের একটি বাড়তি সুবিধা, তাঁদের পেছনে ছাতি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আমেরিকা ও তাঁর পশ্চিমা মিত্ররা। গণতন্ত্রের জন্য তাদের মায়াকান্না দেখে মনে হয় পাথরও বুঝি গলে জল হবে। অথচ সত্যি সত্যি যখন গণতন্ত্রের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, যেমন হয়েছিল ফিলিস্তিনে বা লেবাননে, তা ঠেকানোর জন্য হেন ব্যবস্থা নেই, তারা করতে পারে না। সেই বড় ভাইদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিউনিসিয়ার মানুষ টেনে নামাল পশ্চিমের আরেক অনুগত একনায়ককে।
এর পেছনে অন্ততপক্ষে দুটি কারণ রয়েছে। তাঁর পুলিশ ও পেটোয়া বাহিনী অনুগত থাকলেও সেনাবাহিনী রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। বিপদের সময় তাদের দিকে হাত বাড়ালেও সেনাবাহিনী সদুত্তর দেয়নি। সেনাপ্রধান রাশিদ আমারকে বেন আলী নির্দেশ দিয়েছিলেন গুলি চালাতে, তিনি রাজি হননি। উল্টো তিনি বেন আলীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সময় থাকতে কেটে পড়তে। তাঁকে বদল করা হয়েছিল, তার পরও সেনাবাহিনী রাজনৈতিক কোন্দলে নাক গলাতে রাজি হয়নি। না, অন্যান্য আরব দেশের তুলনায় তিউনিসিয়ার সেনাবাহিনী আকারে ছোট, কিন্তু পুরোদস্তুর পেশাদারি। তার চেয়েও বড় কথা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তারা তুলনামূলকভাবে কম সংযুক্ত। অর্থাৎ সেনাকল্যাণের নামে তারা মিল-কারখানা বগলদাবা করেনি, ব্যাংক বানায়নি, পারমিটবাজির ইঁদুর-দৌড়ে যুক্ত হয়নি। ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক প্রশাসনের ওপর তাদের নির্ভরশলীতা কম। অবশ্য সেনাবাহিনী যে নাক গলায়নি তার আসল কারণ অন্যখানে। বেন আলীর দিন ফুরিয়েছে—এ কথা বুঝেই সেনাবাহিনী তাঁর পক্ষে বন্দুক তোলেনি। (একই রকম ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে, স্বৈরশাসক এরশাদের বেলায়।)
অন্য কারণ যুবক শ্রেণীর আশ্চর্য উত্থান। বেন আলীর দীর্ঘ শাসনের সময় অন্য আর কিছু না হোক, সে দেশে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। মোট জনসংখ্যার আনুপাতিক হিসাবে তিউনিসিয়ায় রয়েছে আরব বিশ্বে সবচেয়ে শিক্ষিত ও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর নাগরিক সমাজ। শিক্ষিত অথচ বেকার, প্রধানত এমন তরুণ ও যুবকদের হাতেই এই বিপ্লবের শুরু। ছেলেমেয়ে সব একাকার, হাতে হাত ধরে তারাই রাস্তায় নেমেছে। পুলিশের লাঠির বাড়ি, টিয়ারগ্যাস, গুলি তারাই বুক পেতে নিয়েছে। তিউনিসিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ বেকার, কিন্তু যুবদের বেলায় এই পরিমাণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ও দেশের দক্ষিণে ৫০ শতাংশের বেশি। ওই দেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়ের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। একা বেন আলী ও তাঁর স্ত্রী লেইলার পরিবারই নাকি দেশের মোট সম্পদের ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত। আমেরিকান কূটনীতিকদের কাছ থেকেই সে কথা জানা গেছে (ধন্যবাদ উইকিলিকস!)। গুজব ছিল, বেন আলী নাকি তাঁর স্ত্রী লেইলাকে নিজের গদিতে বসানোর পাঁয়তারা করছিলেন। লোকজন অনেক আগে থেকেই তেতে ছিল, তাই এ খবর ফাঁস হওয়ায় আগুনে ঘিয়ের বৃষ্টি নামে। আরও একটা ব্যাপার বেন আলীর বিপক্ষে গেছে। দেশের প্রতিটি তথ্যমাধ্যম নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও ইন্টারনেট ও সেলফোনের এই যুগে যুবাশ্রেণীর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি তিনি। সিদ বাউজিদের ২৬ বছর বয়স্ক ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজির আত্মাহুতির ভেতর দিয়ে এই বিপ্লবের শুরু। অন্য সময় হলে সে খবর ধামাচাপা দিয়ে রাখা বেন আলীর পক্ষে কঠিন হতো না। কিন্তু এখন সময়টা ভিন্ন। গত বছর ইরানেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। সেলফোন, ইন্টারনেট ও যুবশ্রেণী প্রায় অসম্ভব সাধন করে ফেলেছিল। সেখানে বিপ্লব শেষ পর্যন্ত যে মুখ থুবড়ে পড়ে, তার প্রধান কারণ ইরানি নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা। পেশাদারি সেনাদল তো ছিলই, তার ওপর তথাকথিত রেভল্যুশনারি গার্ডদের বেপরোয়া পিটুনির মুখে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ আন্দোলন দাঁড়াতে পারেনি। তার ওপর সে দেশের আপসকামী রাজনৈতিক নেতৃত্ব—যারা আসলে দুদিন আগেও ক্ষমতাভোগীদের অন্তর্গত ছিল—আন্দোলনের তীব্রতায় নিজেরাই ভীত হয়ে পড়ে। এই আগুন বাড়তে দিলে তাদের পিঠের চামড়াও পুড়বে—এই ভয়ে তড়িঘড়ি মাঠ থেকে সরে পড়ে তারা।
তিউনিসিয়ার বেলায় একই ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘদিন একদলীয় শাসন চালু থাকায় সে দেশে বিকল্প কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। বাম ও ডান উভয় ধারার রাজনীতিকদেরই বেন আলী দেশছাড়া করেছিলেন। ফলে দেশের মানুষের আস্থাভাজন কোনো রাজনীতিকই নেই। হাতে কাদা লাগেনি—এমন কোনো আমলাও নেই। ফলে এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন এমন রাজনীতিকেরা হঠাৎ ক্ষমতার মধ্যমাঠে চলে এসেছেন। সাবেক শাসক দলের সদস্যদের সঙ্গে তড়িঘড়ি তাঁরা যদি কোনো সমঝোতায় পৌঁছে যান, তাতেও অবাক হওয়ার থাকবে না। মৌলবাদীদের নিয়ে পুরোনো ভয় এখনো যায়নি, তারাও ক্ষমতার ভাগ চাইবে। ইসলামপন্থী ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিও পর্দার পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এসব প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাধা অসম্ভব নয়। ফলে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তা ঠেকাতে সেনাবাহিনীর ভেতর কোনো ‘লৌহমানব’ চেয়ার দখল করে বসতে পারেন। ইসলামি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যুক্তিতে আমেরিকা ও তার মিত্ররা তেমন লৌহমানবকে যদি সমর্থন জানায়, তাও বিস্ময়ের কিছু হবে না।
এসবের মোদ্দা ফল হবে, যে বিপ্লবের সম্ভাবনায় তিউনিসিয়ার মানুষ এবং বহির্বিশ্বে আমরা এত উচ্চকিত, তার অপমৃত্যু। এই নাটকের পুনরাবৃত্তি আমরা বারবার দেখেছি পৃথিবীর নানা জায়গায়। পূর্ব ইউরোপের চেকোস্লোভাকিয়ায় ও হাঙ্গেরিতে, আফ্রিকার কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে, এশিয়ার ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায়, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার হাইতি ও চিলিতে। এসব দেশের ঘটনাবলি থেকে আমরা একটা জিনিস শিখেছি, আর তা হলো চূড়ান্ত পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত জনতার মাঠ থেকে সরে না যাওয়া। জনতার একমাত্র শক্তি তাদের সংখ্যায়। যত বেশিসংখ্যক মানুষ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করবে—পুরোনো ব্যবস্থায় তারা আর ফিরে যেতে চায় না, ভোল পাল্টে পুরোনো পাপীদের ক্ষমতা দখল তত কঠিন হবে। বেন আলী পালিয়েছেন, ফলে বিজয় এসে গেছে ভেবে জনতা যদি সরে দাঁড়ায়, সব ইঁদুর তখন গর্ত ছেড়ে ফের ঢুকবে ভাঁড়ার ঘরে।
তিউনিসিয়ার বন্ধুরা, সুবিধাবাদী ইঁদুর থেকে সাবধান। মোহাম্মদ বুয়াজিজির নামে দোহাই, রাস্তার দখল ছেড়ো না।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.