বিশ্বায়ন-কে দেখবে অভিবাসী শ্রমিকের মানবাধিকার by জহির আহমেদ

গত ১৬ জানুয়ারি ৯৭তম অভিবাসন ও রিফিউজি দিবস উপলক্ষে ভ্যাটিকানের পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট এক বাণীতে অভিবাসনকে বর্তমান বিশ্বায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করেন। পোপের বাণীর মর্মার্থ হলো একক মানবপরিবার। তাঁর আহ্বান হলো, গ্রহণকারী দেশ যেমন অভিবাসিতদের অধিকার নিশ্চিত করবে, নিরাপত্তা দেবে, তেমনি প্রেরণকারী দেশও অভিবাসনের পথ মসৃণ করবে।


এই দ্বিপক্ষীয় বিষয়কে পোপ সর্বজনীন মানবাধিকার বলেছেন। কারণ, সব মানুষই একটি ভ্রাতৃত্ববোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার কোনো ধর্ম নেই, নেই কোনো জাতিগত বিভাজন।
ভ্যাটিকানের পোপ বিশ্বায়নকে শুধু সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া মানতে নারাজ। বরং এটি মানবিকতার বোধও, যার প্রাণভোমরা হলো পারস্পরিক যোগসূত্রতা। পোপের বাণীর অপর গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হলো: অভিবাসিতদের দ্বৈত অধিকার নিশ্চিত করা। প্রথমত, দেশ ত্যাগ করার অধিকার, দ্বিতীয়ত, অভিবাসিত দেশে অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনমানের জন্য প্রবেশাধিকার ও কাজ করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পোপের বাণীর তাৎপর্য কী?
অভিবাসন ঐতিহাসিকভাবেই এই বাংলার মানুষের জীবিকার অন্যতম কৌশল ছিল। ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে চলাচলের এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অভিবাসন ঘটছে। সে ক্ষেত্রে দেশ বা স্থানের যেমন ভৌগোলিক পার্থক্য রয়েছে, তেমনি পার্থক্য রয়েছে অভিবাসনের ক্ষেত্রেও। মধ্যবিত্ত ও সচ্ছল মানুষজন উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপকে যেমন বেছে নেয়, তেমনি কম সচ্ছল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী মূলত পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে যেতে আগ্রহী। অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগ থাকে বিধায় বেশির ভাগ বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যে যায়। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (বিশেষত মালয়েশিয়া) বাংলাদেশিদের অভিবাসন ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই ঝুঁকি শুরু হয় পারিবারিক পর্যায় থেকে আর শেষ হয় দ্রুত দেশে ফেরত আসার মাধ্যমে। বেশির ভাগই জমিজিরাত বিক্রি করে কিংবা ঋণ করে প্রবাসী হয়। এ ছাড়া স্থানিক এজেন্টদের দ্বারা প্রতারিত হয় লেনদেন নিয়ে, বৈধ কাগজপত্রের ব্যবস্থা নিয়ে, সঠিক কর্মস্থলের নিশ্চয়তা নিয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কম মজুরি এবং নিরাপদ কর্মস্থল।
ফলে মূল বিনিয়োগকৃত অর্থের সংকুলান না করেই তাদের ফেরত আসতে হয়, আর না এলে তিলকে জোটে ‘অবৈধ’ শ্রমিক পরিচিতি। হয়রানি আর যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে থাকে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি এক হিসাবে দেখা গেছে, বিদেশ গমনের মূল খরচের ৫৯.৫ শতাংশ ব্যয় হয় জনশক্তির এজেন্ট দালালদের বখরা খাতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এজেন্টরা পেমেন্ট গ্রহণের কোনো রসিদ দেয় না, সরকারের কাছে তাদের জবাবদিহি থাকে অনুচ্চারিত।
শ্রমের বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ একেবারে শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০০৭ সালে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে মোট জনশক্তির পরিমাণ ছিল আট লাখ ৭৫ হাজার জন। ২০০৮ সালে আট লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন এবং ২০০৯ সালে ওই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় চার লাখ ৭৫ হাজার। আর ২০১০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এর সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখ ৫৬ হাজার।
এই ধারার অনিবার্য পরিণতি হলো ব্যাপকহারে ফেরত অভিবাসন। এক বছর ধরেই মালয়েশিয়া, মরিশাস, কুয়েত ও সৌদি আরব থেকে অনেক শ্রমিক দেশে ফিরতে থাকেন। কারণগুলো ছিল এ রকম: অর্থনৈতিক মন্দা, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়া, বাংলাদেশ মিশন ও জনশক্তিসংক্রান্ত এজেন্সিগুলোর অসাধুতা। শ্রমিকদের অভিযোগ হলো, বাংলাদেশিদের প্রতি রুষ্টতা, কর্মক্ষেত্রে অমানবিক পরিবেশ, কম মজুরি ইত্যাদি থাকলেও শ্রমিকেরা কাজ করতে চান জীবিকার প্রয়োজনেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম আইন না মেনেই ওই দেশগুলো বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে বাধ্য করছে।
জীবন্ত ফেরত অভিবাসনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শ্রমিকদের শব মিছিল। গত দুই বছরে দুই হাজার ২৩৭ জন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ ঢাকায় এসেছে। এক সরকারি হিসাবে দেখা যায়, ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল—এই পাঁচ বছরে আট হাজার ১০৭ জন বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন দেশে মৃত্যুবরণ করেন। প্রধান কারণ হিসেবে ওই সব দেশে শ্রমিকদের অসহায়ত্ত ও কর্মপরিবেশকে দায়ী করা হচ্ছে। এই মৃত্যুর কফিন শুধু শ্রমিকের লাশই বহন করছে না, বরং বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণের ব্যর্থতাকেও প্রকাশ করছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসীসংক্রান্ত গবেষণা ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০০৯ সালের প্রথম কয় মাসেই বিভিন্ন দেশে ৮৩৪ জন প্রবাসী (যার মধ্যে ৩২ জন নারী আছে) মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে ২৫৪ জন, মালয়েশিয়ায় ১০৭, দুবাইয়ে ১০০, কুয়েতে ৫৫, ওমানে ৩৪, আবুধাবিতে ২৪ এবং কাতারে ২১ জন। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের প্রায় সবার বয়স ৩০ থেকে ৪৫। তাঁদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে হূদেরাগকেই শনাক্ত করা হয়েছে।
বেশির ভাগ আত্মীয়স্বজনের মতে, প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর অন্যতম কারণগুলো হলো: কর্মক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কম মজুরি, ঋণের বোঝা, সর্বোপরি জীবিকার নিরাপত্তাহীনতা। এ জন্য বলা যায়, প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার যেমন দায়ী, তেমনি গ্রহণকারী দেশগুলোও সমভাবে দায়ী। অভিবাসিত শ্রমিকের মানবিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দুই প্রান্তেই। ১৯৯০ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী, সব অভিবাসী ও পরিবারের অধিকার সুনিশ্চিত করার কথাই বলা হয়েছে, যেটি আমরা এই লেখার শুরুতেই ভ্যাটিকানের পোপের আহ্বানেও পেয়েছি। বাংলাদেশের সংবিধানেও প্রবাসী নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করার উল্লেখ রয়েছে। পাঠক বুঝতেই পারছেন, প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের মানবাধিকারের বিষয়টি কীভাবে উপেক্ষিত?
বাংলাদেশের জিডিপির ১২ শতাংশ আসে প্রবাসী-আয় থেকে। ২০০৯ সালে এরাই ১০.৭২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। সরকারি তথ্যের বাইরে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর পরিমাণ অনেক বেশি হবে। জাতীয় অর্থনীতির হিসাবে, ২০০৪ সালে গার্মেন্টস খাতে রপ্তানি-আয় ছিল ২.৫২ বিলিয়ন ডলার। আর জনশক্তি রপ্তানি থেকে আয় ছিল ৩.০৬ বিলিয়ন ডলার, এটি বাজেটে বৈদেশিক সাহায্যের দ্বিগুণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রবাসীরাই আজ অসহায়।
প্রবাসে বাংলাদেশ মিশনে এদের পরিচিতি হচ্ছে ‘অবৈধ’, ‘বোঝা’, ‘অসাধু’ ইত্যাদি। বাংলাদেশ মিশনগুলোর কাজ কী? মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে সংকটে বাংলাদেশ মিশনের যে পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা ছিল, যার মাশুল দিতে হলো ৫৫ হাজার বাংলাদেশি অপেক্ষমাণ শ্রমিককে, এটি ঢাকা যাবে কী করে?
শ্রম ও জনশক্তিমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ‘সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় আমাদের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে আসছে, এর প্রধান কারণ অবৈধ অভিবাসন।’ মন্ত্রী আরও বলেছেন, অসাধু এজেন্সিগুলোর উচ্চমাত্রায় টাকা আদায়ের ফলে শ্রমিকেরা ওই টাকা আয় করার জন্য চুক্তির বাইরে বিদেশে অবস্থান করছেন। ফলে অবৈধ হচ্ছে অসংখ্য শ্রমিক। এই হলো রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা-দায়বদ্ধতা এড়ানোর মহাবয়ান।
গত এক বছরের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ করলে দেখা যাবে, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটাই দাবি ছিল—তাঁদের আকামার মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য যেন সরকার ব্যবস্থা নেয়। প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শ্রম ও জনশক্তিমন্ত্রীর অগণিত সফর কোনো কাজে আসছে না। একটি গরিব দেশের তিনটি মন্ত্রণালয় রয়েছে প্রবাসীদের দেখভাল করার জন্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী মন্ত্রণালয়। এদের কর্মপরিধি কী? প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থে কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তার কোনো সমন্বয় এখানে নেই। হোয়াইট কলার চাকরির ক্ষমতায় অসহায় শ্রমিকদের কণ্ঠ চাপা পড়ে যায়।
শ্রমবাজারের নিরন্তর সংকোচন, কর্মক্ষেত্রে অপরিমেয় দুর্গতি, চাকরি হারানো, অবৈধ হওয়া এবং সর্বোপরি লাশ হয়ে ফেরত আসা শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রের দেউলিয়াত্বকেই প্রকাশ করছে না বরং মানবাধিকারকেও লঙ্ঘন করছে।
পোপের বাণীতে একক বৈশ্বিক পরিবার তথা মানবতাবোধের মাধ্যমে অভিবাসনকে উৎসাহিত করার যে বার্তা আমরা পাই, তা আজ বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য নিতান্তই পরিহাস। আজকে যাঁরা জীবন্ত শ্রমিক হিসেবে নানান প্রতিকূলতার মাঝেও রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ডকে স্ফীত করে দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করছেন, কে জানে নিকট-ভবিষ্যতে তাঁদের বেশির ভাগই ফেরত অভিবাসনের লাশের মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য হবে কি না?
ড. জহির আহমেদ: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। zahmed69@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.