ব্যর্থতায়, চাপে র‌্যাব-পুলিশ by পারভেজ খান

দেশে বেশ কিছু নিখোঁজ অথবা গুমের ঘটনা ঘটেছে। এ পর্যন্ত নিখোঁজ কাউকেই উদ্ধার করতে পারেনি র‌্যাব কিংবা পুলিশ। সর্বশেষ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসার নিখোঁজ হয়েছেন। দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে এ ঘটনায়। এ নিয়ে চাপের মুখে আছে পুলিশ ও র‌্যাব।


এমনকি পুলিশপ্রধানকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে।
এদিকে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে দফায় দফায় হরতাল হচ্ছে বিরোধী দলের ডাকে। হরতালের সময় রাজপথে জ্বলছে যানবাহন। পড়ছে নিরীহ গাড়িচালক ও পথচারীদের লাশ। এ ক্ষেত্রেও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে র‌্যাব-পুলিশের ভূমিকা। তা ছাড়া এসব আন্দোলন সামাল দিতে অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে র‌্যাব ও পুলিশকে। সব মিলিয়ে চাপ বেড়েই চলেছে র‌্যাব ও পুলিশের। এ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন র‌্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বৈঠক করছেন গোয়েন্দারাও। কিন্তু কোনোভাবেই তাঁরা ব্যর্থতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। গতকাল রবিবার র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সাবেক কর্মকর্তার কথায় এমন চিত্রই ফুটে ওঠে।
সাবেক এক আইজিপি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা ও মন্ত্রী। রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তাঁদের পরস্পরবিরোধী কাদা ছোড়াছুড়িতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থা।
আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে জনসাধারণকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যস্ত হয়ে পড়ছে হরতাল ঠেকাতে। এতে করে ব্যাহত হচ্ছে পুলিশের দৈনন্দিন কর্তব্য পালন ও তদন্তকাজ। পুলিশের অন্য ব্যস্ততার কারণে অপরাধীরাও তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে বেড়ে যায় অপরাধ। এসবের খেসারতও দিতে হচ্ছে জনগণকেই। তাঁর মতে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবং সরকারের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এ ধরনের 'শ্যাম রাখি না কুল রাখি' পরিস্থিতিতে কাজ করা সত্যিকার অর্থেই জটিল।
ওই সাবেক আইজিপি আরো বলেন, রাজনীতির কারণে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়া ছাড়াও নিজেদের ব্যর্থতার কারণেও পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, 'র‌্যাব ও পুলিশ এত দিন ধরে টানা তদন্ত চালিয়ে এখন পর্যন্ত একটা সমাধানে আসতে পারবে না_সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। যদি এর পেছনে কোনো বিশেষ রহস্য না থাকে, তাহলে অনেক আগেই এটা বেরিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটা ঘটছে না। পুলিশ অনেককেই সন্দেহ করছে। সন্দেহভাজনদের কাউকে কাউকে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করছে, কিন্তু কিছুই পাচ্ছে না_এটাও একটা রহস্য। অপহরণ ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যাচ্ছে। তারা প্রচারমাধ্যমের কাছে বলছে এক কথা। আবার তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে র‌্যাব-পুলিশ বলছে ভিন্ন কথা। ওরা নাকি তাদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য কোনো সাক্ষ্য পাচ্ছে না।' সাবেক পুলিশপ্রধান বলেন, 'একজন সাধারণ লোক, একজন ডাব বিক্রেতা বা একজন নিম্ন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা এ ধরনের একটি ঘটনার মিথ্যা বর্ণনা দিয়ে নিজের বিপদ টেনে আনবেন না। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ পুলিশ বা র‌্যাব সেটা নিয়ে ভাবছে না। কেন ভাবছে না সেটাও নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্য মাহবুব প্রচারমাধ্যমে কথা বলার পর কেনই বা হঠাৎ করে ছুটিতে চলে গেলেন, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। একটি মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে, এই নিখোঁজ ঘটনার পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত আছে। ফলে র‌্যাব-পুলিশের এই রহস্যময় আচরণ ওই সব অভিযোগকে আরো মজবুত করে তোলে।'
ইলিয়াস আলীর বিষয়ে তদন্ত নিয়ে র‌্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁকে উদ্ধারের ব্যাপারে র‌্যাবের চেষ্টার কোনোও কমতি নেই। দুজন সংসদ সদস্যসহ শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এ পর্যন্ত। অভিযান চালানো হয়েছে সম্ভাব্য অনেক স্থানে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তির মোবাইল ফোনের ওপরও র‌্যাবের গোয়েন্দাদের নজরদারি আছে।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, তাঁরা একটি বিষয়ে নিশ্চিত, এ ঘটনার পেছনে এমন একটি চক্র কাজ করেছে বা করছে যারা প্রশিক্ষিত, কৌশলী ও যথেষ্ট সতর্ক। কেউ নিখোঁজ হলে বা কাউকে অপহরণ করা হলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা কোন কোন পদ্ধতিতে বা কোন সূত্র ধরে তদন্ত কমর, সে ব্যাপারেও তারা অভিজ্ঞ। ফলে অভিযান পরিচালনাকারীদের 'অপরাধী ধরার জাল'-এর বাইরে থাকছে অপহরণকারীরা। তাদের সন্দেহ করার মতো কোনো সূত্রও তারা রেখে যায়নি। র‌্যাব এখন তদন্ত আর উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে শুধু সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ ধরে। তবে এসব কারণের পেছনেও এখন পর্যন্ত জোরালো কোনো যুক্তি পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, 'তবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত এই চক্র যথেষ্ট শক্তিশালী, সংঘবদ্ধ এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর।'
র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন ইলিয়াস আলী তাঁর আইনজীবীকে বলেছিলেন, তিনি রূপসী বাংলা হোটেলে যাবেন না। ওই দিন তাঁর আইনজীবীরও হোটেলে যাওয়ার কথা ছিল। নিজে যাবেন না বলে ইলিয়াস আলী তাঁর আইনজীবীকে ওই দিন হোটেলে যেতে নিষেধ করেন। এর পরও তিনি কেন ওই রাতে আবার হোটেলে গেলেন তার কারণ খুঁজে দেখা হচ্ছে।
র‌্যাবের মিডিয়া এবং আইন শাখার পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বাইরে থেকে যে যত কথাই বলুক না কেন, তাঁরা এই নিখোঁজ রহস্য সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছেন। কয়েকটি টিম গঠন করে তাঁরা নানাভাবে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। র‌্যাব আশাবাদী, তারা অচিরেই এই নিখোঁজ রহস্যের একটা সমাধান আনতে পারবে।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হরতাল করে বা জ্বালাও-পোড়াও করে এই নিখোঁজ রহস্যের সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃত অর্থেই কেউ যদি ইলিয়াসের সন্ধান চায়, তবে তাদের সহযোগিতা করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সম্ভাব্য কারণ জানিয়ে, প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে পুলিশের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ সরকারও আন্তরিকভাবে চায় ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করতে। র‌্যাব-পুলিশও যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একজন রাজনীতিবিদ এভাবে নিখোঁজ হবেন, এটা কারো কাম্য হতে পারে না।'

No comments

Powered by Blogger.