মেহেরজান-বিনির্মাণের বিপত্তি ও জাতীয়তাবাদী আবেগ by ফাহমিদুল হক

রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত মেহেরজান এবং চলচ্চিত্রটি নিয়ে তৈরি হওয়া ব্যাপক প্রতিক্রিয়া, দুই-ই আমার দৃষ্টি কেড়েছে। আমার ধারণা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, হয়তো ওই মাত্রায় বিশ্লেষণপ্রবণ নই। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’-এর বাইরে কোনো কিছুই আমরা অনুমোদন দিতে চাই না।


সেই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভটা কী, আমরা সবাই জানি। এর একটা অংশ হলো, স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে, হত্যা-ধর্ষণ-ধ্বংসের মতো যুদ্ধাপরাধ করে এবং বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশকে স্বাধীন করেন। এই ন্যারেটিভের আরেকটি অংশ হলো, ইসলামপন্থী কয়েকটি দলের বাঙালি সদস্যরা ওই সব যুদ্ধাপরাধে সহায়তা করেন অথবা ওই সব অপরাধে নিজেদের নিযুক্ত করেন। মেহেরজান ছবিটি ওই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে ভিন্ন ন্যারেটিভ নির্মাণ করেছে। ফলে ছবিটি ঘিরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
সেসব প্রতিক্রিয়ার যে গড় বৈশিষ্ট্য, তাতে মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে উল্লম্ব অবস্থানে রেখে ছবিটি বিচার করেছে। আমি ছবিটি বিচার করতে চাই বাংলাদেশে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত অন্যান্য ছবির সঙ্গে আনুভূমিকভাবে। তার সঙ্গে মেলাতে চাই জাতি-রাষ্ট্র ধারণার।
জাতি-রাষ্ট্র যদি বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায়, একটি ‘কল্পিত সমাজ’ (ইমাজিনড কমিউনিটি) অথবা গায়ত্রী স্পিভাকের ভাষায়, ‘কৃত্রিম নির্মাণ’ (আর্টিফিশিয়াল কনস্ট্রাক্ট) হয়ে থাকে, তবে তার ‘কল্পিত’ ঐক্য ও সংহতির জন্য লাগাতারভাবে একটি আদর্শ জাতীয়তার অবয়ব বা বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে হয় এবং কিছু ‘রেপ্রিজেন্টেশন-পদ্ধতি’র (স্টুয়ার্ট হলের মতে) মাধ্যমে এই নির্মাণের কাজটি করতে হয়, সেই অবয়ব বা বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্যও। সংবাদপত্র, সাহিত্য বা শিক্ষা সেই রেপ্রিজেন্টেশনের দায়িত্বটি বরাবর পালন করে এসেছে। অপেক্ষাকৃত অধুনামাধ্যম চলচ্চিত্রও বিশ্বব্যাপী জাতীয়তা, আত্মপরিচয় নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালকেরাও উৎসাহের সঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তা গঠন, সংরক্ষণ ও প্রচারণার কাজটি করে চলেছেন। এ দেশের শিল্পপ্রয়াসী চলচ্চিত্রের বিরাট অংশই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। স্বাধীনধারার পরিচালক তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেলের পাশাপাশি মূলধারার চাষী নজরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের খ্যাতি আছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশির ভাগ চলচ্চিত্রে ওই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভকেই দেখি। তারেক মাসুদের মাটির ময়না ছবিতে প্রথম দেখা গেল, ওই ন্যারেটিভ থেকে কিছুটা সরে আসা হয়েছে। যদিও তাঁর মুক্তির গান ছবিটি গ্র্যান্ড ন্যারেটিভেরই অন্যতম অংশীদার। মাটির ময়নায় প্রথম দেখা গেল একটি অন্যতম বড় চরিত্র। যার ইসলামিক বেশবাশ ও ম্যানারিজম থাকার পরও সে রাজাকার নয়। নতুবা আগে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোয় একটি রাজাকার চরিত্রের উপস্থিতি থাকে, যে ইসলামপন্থী এবং যার চরিত্রে যাবতীয় বদস্বভাব রয়েছে। এরা একটু বয়স্ক ও সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি পরিহিত, এদের মুখে দাড়ি থাকে—অর্থাৎ রাজাকার ও মোল্লা এভাবে সমার্থক হয়ে ওঠে। এ কথা ঠিক, ১৯৭১ সালের রাজাকাররা কোনো না কোনো ইসলামপন্থী দলের সদস্য ছিল। কিন্তু তারা সবাই বয়স্ক-টুপি পরিহিত ছিল না। তাদের অনেকেই বয়সে তরুণ ও আমাদের মতোই শার্ট-প্যান্ট পরিধান করত। এসব নির্মাতা-স্রষ্টারা মূলত চিন্তাভাবনায় আধুনিক ও বামঘেঁষা হলেও ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্য দিয়েই পশ্চিমা আধুনিকতা ও বাম ভাবনার স্থানিকীকরণ ঘটে। ফলে বাঙালি মুসলমানের বাঙালিত্বের অংশটুকুই তারা একমাত্র আত্মপরিচয় বলে ভাবতে চায়। এ জন্য মুসলমানিত্বের অংশটুকুকে তারা বাতিল করতে চায়। ইসলামের অনুসারীরা তাদের কাছে ‘অপর’। ফলে চলচ্চিত্রে তাদের অপরায়ণের শিকার হয় বাঙালি-মুসলমান জাতিসত্তার ভেতরকার মুসলমানিত্ব অংশটি।
মাটির ময়না ছবির দ্বিতীয় ভাগে একটি দৃশ্য আছে, ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকেরা একটি লঞ্চে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ভয়াবহতা বর্ণনা করছেন এবং এর পরপরই অন্ধ বয়াতির গান শুরু হয়, যেখানে কারবালার যুদ্ধকে ‘ভ্রাতৃঘাতী’ যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং যাকে বর্তমান যুদ্ধের সঙ্গেও সম্পর্কিত করা হয়। সুফিবাদ বা লোকধর্মের আদর্শ প্রভাবিত সহজিয়া ভাবের রক্তপাতহীন ছবিটি চলমান যুদ্ধকে স্বীকার করে নিয়েও তাকে অতিক্রম করতে চায় এবং জাতীয়তাবাদী আবেগের বাইরে এসে সব যুদ্ধই শেষ পর্যন্ত যে ভ্রাতৃঘাতী, সেই বার্তা দিতে চায়। তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নরসুন্দর-এ একজন বিহারি পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের তাড়া খেয়ে পলায়নরত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে দেয়। এটিও মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বাইরের ছবি, যে ক্ষেত্রে আমরা বিহারিদের জানি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে।
মেহেরজান ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা নিয়ে যারা উত্তেজিত, তাদের মেহেরজান-পূর্ব ছবিতে দৃষ্ট এ ধরনের ডিকনস্ট্রাকশনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এই পর্যায়ে আমি হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া (২০০৪) ও তৌকীর আহমেদের জয়যাত্রার (২০০৪) কথা বলতে চাই। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, দুটি ছবিতেই রাজাকার হিসেবে দুটি চরিত্র ছিল, কিন্তু চরিত্রগুলো ছোট। অন্যদিকে জয়যাত্রায় দেখা যায়, যখন পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে ঢোকে, তাদের জেরার মুখে পড়েন মসজিদের ইমাম। তিনি পাকিস্তানি সেনার নৃশংসতার প্রতিবাদ করেন এবং তাদের হাতে শহীদ হন। এভাবে একজন মৌলভি হন চলচ্চিত্রের প্রথম প্রতিবাদকারী এবং শহীদ। আর শ্যামল ছায়ায় যুবা-মৌলভি বলতে গেলে মূল চরিত্র। তিনি নৌকা আরোহীদের মধ্যে প্রথম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি রাজাকারকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। তাঁর গুণাবলির চরম নিদর্শন দেখি, অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি উদারতায়। নৌযাত্রায় হিন্দুদের ধর্মচর্চার অধিকার রক্ষায় তিনি ছিলেন সচেষ্ট। এক মৌলভির মধ্যেই যাবতীয় গুণাবলির সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। একসময় ঘটত ঠিক উল্টোটা।
লক্ষ করার বিষয় হলো, এর মধ্যে নাইন-ইলেভেনের ঘটনা ঘটে গেছে, আফগানিস্তান-ইরাক আগ্রাসন ঘটেছে। মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের নতুন নতুন ব্যাখ্যা আসছে। আমাদের বেশির ভাগ আর্ট সিনেমা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, তাতে ইসলামি দলভুক্ত রাজাকার চরিত্র থাকছে এবং বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসায় ‘প্রথমত বাঙালি না মুসলমান’ প্রশ্নটি অমীমাংসিত থাকছে—এই পরিপ্রেক্ষিতে খোদ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রেই নানা বিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশন শুরু হয়েছে বিগত এক দশকে। মেহেরজান সেই ডিকনস্ট্রাকশন-প্রক্রিয়ায় একটা উল্লম্ফন। আগের ডিকনস্ট্রাকশনগুলোয় কিন্তু আজকের মতো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
আরও একটি বিষয় হলো, যাঁরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, তাঁদের আবেগের পরিমাপে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম সৃজনশীল অভিপ্রকাশে আক্রান্ত হবে না। বরং মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল ঐতিহাসিক ঘটনাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে চাইবে নতুন প্রজন্ম। আর এই দেখার ক্ষেত্রে তারা সমসাময়িক জাতীয় ও বৈশ্বিক জীবনদর্শন ও রাজনীতি, বৈশ্বিক মানবতাবাদ ইত্যাদি বহিঃস্থ ঘটনাক্রম-আদর্শ দ্বারা অবলীলায় তাড়িত হবে। এটা শৈল্পিক দায় ও উপায়।
মেহেরজান বিতর্কে চলচ্চিত্রটিকে একটি টেক্সট হিসেবে কেউ পাঠ করছেন না। বা বলা যায়, সেই দিকটায় দৃষ্টি দেওয়ার অবকাশ পাচ্ছেন না, সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায়। অথচ ছবিটির চিত্রনাট্যে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। একমাত্র পাকিস্তানি সৈনিকের সঙ্গে মেহেরের প্রেমের বিষয়টি ছাড়া কোনো কিছুই পক্বতা লাভ করেনি ছবিতে। অথচ ছবিটি একসঙ্গে অনেক কিছু ধরতে চেয়েছে। এমনকি পরিচালকের নিজস্ব গবেষণার জায়গাটি, বীরাঙ্গনাদের অংশটিও পূর্ণ অভিঘাত নিয়ে হাজির হয় না। নীলা চরিত্রটির হঠাৎ প্রস্থান একটি সম্ভাবনাকে অসমাপ্ত রাখে। মেহেরের প্রেমপর্বটি অতিদীর্ঘ, ওই রকম গ্রামীণ নির্জনতায় অনেক আগেই এই ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ প্রেমটি ধরা পড়ার কথা। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেবল ইঙ্গিতের মাধ্যমে সারা হয়েছে, অথচ যার বিস্তার জরুরি ছিল। যেমন যুদ্ধশিশু সারাহর একটি সমকামী সম্পর্কের ইঙ্গিত আছে ছবিতে। একই ইঙ্গিত আছে ‘প্রাণসখা’ অরূপ-রাহীর চরিত্র দুটির ক্ষেত্রেও। সেই ইঙ্গিত চিত্রনাট্যে কিছুই যোগ করে না। সমকামিতা নিজেই একটা বিরাট ডিসকোর্স, এই বিষয়ভিত্তিক আলাদা ছবিই হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের ছবিতে ওই ইঙ্গিত অপ্রয়োজনীয় ছিল।
বাণিজ্যিক উপাদান ছবিটির অন্যতম সীমাবদ্ধতা। সময় ও চরিত্রানুযায়ী অবিশ্বস্ত বর্ণিল পোশাক, অমলিন ঝকঝকে বাংলাদেশের গ্রাম, ভারতীয় তারকাদের কাস্টিং, নির্ভরযোগ্য সিনেমাটোগ্রাফি-উদ্ভূত অ্যাক্সোটিক প্রাকৃতিক চলমান চিত্র—ছবিটির প্রতি একটা ওরিয়েন্টালিস্ট গেজ-এ (প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিক্ষেপণ) প্রলুব্ধ করে। তবে বাণিজ্যিক বিনোদন আবার ছবির অন্যতম শক্তিও। ওই সব উপাদানের কারণে অনেক সাধারণ দর্শকের কাছেই এটা বিয়োগান্তক প্রেমকাহিনি হিসেবে হাজির হবে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যা একটা রূপকথার আখ্যান তৈরি করে। আর মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের ডিকনস্ট্রাকশন করতে গিয়ে রূপকথা-পরিস্থিতি পরিচালকের জন্য বিশেষ সুবিধা এনে দেয়। সেই সুবিধা বা স্বাধীনতা পরিচালক নিতেই পারেন। নয়তো মুক্তিযুদ্ধ কেবল ইতিহাসের দিন-সংখ্যা নিয়ে পাঠ্যবইতে আটকে থাকবে, নানারূপে মানুষের মনে ঠাঁই নেবে না।
তবে বলতে হবে, মেহেরজান-এর কাউন্টার ডিসকোর্স প্রিম্যাচিউর। ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে স্থানিক ও কালিক ব্যবধান গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বাইরে কাউন্টার ন্যারেটিভ জন্মের পথ করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে এ রকম অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনো পুরোনো প্রজন্মের কাছে তরতাজা। ফলে এই ধরনের ডিকনস্ট্রাকশন মেহেরজান-এর জন্য খানিক আগাম হয়ে গেল।
কিন্তু মেহেরজানবিরোধী বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে আমার ভয় হয়, ঐতিহাসিক বা জাতীয়-আন্তর্জাতিক যেকোনো ঘটনাক্রম নিয়ে নানামুখী বা ডিসকার্সিভ আলোচনার পথ বুঝি ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। মুক্তিযোদ্ধা বনাম রাজাকার/পাকিস্তানপন্থী ডাইকোটমির বাইরে বুঝি আর কিছু থাকতে নেই এই ভুবনে।
ফাহমিদুল হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক, চলচ্চিত্র গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.