অভিমত-নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা কতটা যুক্তিযুক্ত? by মাহফুজ কবীর

অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্সের আবেদন অনুমোদন করেছে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের ছয়টি এবং বাকিগুলো প্রবাসী বাংলাদেশিদের। বিষয়টি ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে এবং সংবাদমাধ্যমগুলো বিষয়টির পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য তুলে ধরে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে খবরটি উপস্থাপন করেছে।
প্রধান প্রশ্নটি হচ্ছে, আদৌ কোনো নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল কি না? এর বিপক্ষে অনেক যুক্তি থাকতে পারে কিন্তু আমি চেষ্টা করব বিষয়টিকে বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করতে।
কল্যাণ অর্থনীতির প্রথম মৌলিক উপপাদ্যে বলা হয়, কোনো প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্য সম্পদের ‘প্যারেটো’র দক্ষতাসূচক বন্টনের দিকে নিয়ে যায়, যেখানে দ্বিতীয় মৌলিক উপপাদ্য কোনো দক্ষ বন্টন প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্যের মাধ্যমে টেকসই হতে পারে তা নির্দেশ করে। তার মানে, তত্ত্বীয়ভাবে এটা দেখানো সম্ভব যে নতুন ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং ব্যবসায় আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত ‘প্যারেটো-উন্নয়ন’ বা কল্যাণ বাড়াবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন ব্যাংকগুলো কি সাম্প্রতিক সময়ের ‘সিন্ডিকেশন’-এর মতো প্রতিযোগিতাবিরুদ্ধ আচরণ উসকে দেবে? এ বিষয়টি নিয়ে একজন খ্যাতিমান আর্থিক খাত-বিশেষজ্ঞ ইতিমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংককে সমন্বয়কারী হিসেবে বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে নজরদারি করতে হবে। কিন্তু মাথাব্যথা দূর করার জন্য কখনো মাথা কেটে ফেলা যায় না।
অন্যদিকে প্রশ্ন তোলা যায়: উদ্যোক্তারা কেন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য ‘মরিয়া’ হয়ে উঠেছেন? ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আবেদনের আগে তাঁরা অবশ্যই একটি বাস্তবমুখী লাভ-ক্ষতির হিসাব করে নিয়েছেন। যদি বাজারে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক চালু থাকত, তাহলে এই উদ্যোক্তারা তাঁদের প্রস্তাবনা নিয়ে আরও সতর্ক হতেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে খুব বেশি লাইসেন্সের আবেদন জমা পড়ত না। কাজেই বলা যায়, এ খাতে মুনাফার বিপুল সুযোগ রয়েছে, বাজার এমন সবুজ সংকেতই দিচ্ছে!
সর্বশেষ ২০০০-০১ সালে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনুমোদনের পর থেকে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকে অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। অর্থনীতির সামগ্রিক আয়তন তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় বা জিএনআই বেড়েছে আরও বেশি, যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুণ। বৈদেশিক বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে; আমদানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৪ গুণ এবং রপ্তানি ৩ দশমিক ৬১ গুণ। বিদেশি শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স ৪ দশমিক ৭ গুণ বেড়েছে। এসব সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন নতুন বাস্তবতায় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আরও প্রতিযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগকে অনুপ্রাণিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক লক্ষ্য হচ্ছে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নেই এমন জনগণকে সেবার আওতায় আনার মাধ্যমে চলমান আর্থিক সেবার আওতা বৃদ্ধির কার্যক্রমকে শক্তিশালীকরণ। ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যানসের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে আছে। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি, দেশে আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবার প্রসার পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় কম।
প্রকৃতপক্ষে আর্থিক সেবায় অন্তর্ভুক্তি বা ‘ফিনানশিয়াল ইনক্লুশন’ বলতে শুধু ব্যাংকের উপস্থিতিকেই বোঝায় না, বরং প্রতিযোগিতামূলকভাবে ন্যায্যমূল্যে আর্থিক সেবা ক্রয় করার ক্ষমতা ও এসব সেবার প্রাপ্যতাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্ত সেবাসমূহের বৈচিত্র্যও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, যাতে করে ভোক্তা বিভিন্ন পণ্যের মধ্য থেকে বাছাই করার সুযোগ পান। সর্বোপরি এটা নিশ্চিত করতে হবে যে ক্রেতারা সেবা নিরবচ্ছিন্নভাবে পেতে পারেন। আর এটিই ব্যাংকিং খাতের স্থায়িত্বশীলতা নির্দেশ করে।
প্রায়ই অর্থনীতিবিদেরা সুদের হার, বিশেষ করে ঋণের সুদের হার নিয়ে কথা বলেন। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ঋণের সুদের হার বেশি হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কম হচ্ছে। ঋণের সুদের হার কমাতে এই নতুন ব্যাংকগুলো সহায়তা করবে, ফলে বিনিয়োগ বাড়বে, যা অর্থনীতিকে প্রসারিত করবে এবং নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো গ্রামাঞ্চলে বাস করে, যাদের শহরের লোকজনের চেয়ে ভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা প্রয়োজন। নতুন ব্যাংক স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা হলো গ্রামাঞ্চলে এবং শহরে ১:১ অনুপাতে শাখা খুলতে হবে। উদ্দেশ্য, শাখা খোলার মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকেও আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসা। আমাদের ব্যাংকগুলো মূলত শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামাঞ্চলের জনগণ সাধারণ আর্থিক সেবা থেকেও বঞ্চিত। এটা শুধু গ্রামাঞ্চলের জনগণের আর্থিক সেবা পাওয়ার মৌলিক অধিকারকেই হরণ করে না, বরং গ্রাম ও শহরের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যকেও গভীরতর করে। চর ও হাওরাঞ্চলের মতো দুর্গম এলাকায় ব্যাংকগুলোর শাখা খোলা উচিত, যাতে ওই অঞ্চলের মানুষ তাদের ভিন্নরকম চাহিদা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অনুসারে আর্থিক সেবা পেতে পারে।
মধ্যম আয়ের অর্থনীতি হওয়ার পথে বাংলাদেশের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য নতুন ব্যাংক নতুন সুযোগ নিয়ে আসবে। ইতিমধ্যেই দেশে প্রায় চারডজন বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে, কাজেই অনেকে যেমন বলছেন এ দেশে ব্যাংকের বাজার নিঃশোষিত, তা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে শুম্পিটারের মতানুসারে ব্যাংকগুলোকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ব্যাংকিং সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্ভাবনী সেবা দিতে হবে এবং যাদের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছায়নি, তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুটি ইতিবাচক বহিঃস্থ প্রভাব দেখা যাবে। একদিকে ভোক্তারা ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে ন্যায্যমূল্যে নিত্যনতুন ও মানসম্পন্ন সেবা পাবেন এবং অন্যদিকে গৃহীত উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো ব্যাংকিং খাতে। ফলে পুরো খাতের উল্লেখযোগ্য মানোন্নয়ন ঘটবে।
অতীতে দেখা গেছে, সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যেও তথাকথিত ‘রাজনৈতিক ব্যাংক’গুলো ভালো করেছে। যেহেতু সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে নেওয়া হয়ে গেছে, কাজেই এর পেছনে কী কারণ ছিল, তা খুঁজে দেখার বদলে এই নতুন বৃক্ষের ‘ফলের পরিচয়ে’র জন্য অপেক্ষা করা দরকার। এ ছাড়া ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি ঋণ মধ্যম মেয়াদি ঋণে রূপান্তরিত হয়েছে, পরিশোধ করা হয়নি এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। কাজেই এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন নতুন ব্যাংকগুলোর কারণে বাজারে ঋণ অতিমাত্রায় সহজলভ্য না হয় বা ঋণের অতিরিক্ত জোগান না সৃষ্টি হয়। ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখলে নতুন ব্যাংকগুলো চূড়ান্ত বিচারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং সুফল বয়ে আনবে।
যেকোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগের প্রধানতম দুটি লক্ষ্য থাকে: সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন এবং উৎপাদন ব্যয় সর্বনিম্নকরণ। ব্যাংকিং খাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং অন্যান্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করাকে উৎসাহিত করলে তা আর্থিক সেবাসমূহকে ব্যয়-সাশ্রয়ী করবে এবং দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও এই সেবা পৌঁছানোর জন্য সহায়ক হবে।
ব্যাংকের সংখ্যা দেশের ব্যাংকিং খাতের বিকাশের পথে প্রধানতম প্রতিবন্ধক নয়। কারণ, নতুন অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলো নিজেরাই টিকে থাকার কৌশল খুঁজে নেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহায়ক এবং অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে দেশের আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা ও দক্ষতা আনতে হবে।
বাধ্যতামূলক সামাজিক দায়বদ্ধতা, বর্গাচাষিদের জন্য ঋণ তহবিল সৃষ্টি, মসলা উৎপাদনে সুদ-ভর্তুকি, কৃষকদের জন্য কম খরচে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইত্যদি উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই জনগণকে আর্থিক সেবার আওতায় আনার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এসব অর্জনের ওপর ভিত্তি করে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যাংক আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং যথার্থ পরিবীক্ষণ ও তদারকির মাধ্যমে দেশের আর্থিক খাতের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে।
ড. মাহফুজ কবীর: অর্থনীতিবিদ, ঊর্ধ্বতন গবেষণা ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ, ঢাকা।
mahfuzkabir@yahoo.com.

No comments

Powered by Blogger.