চারদিক-তৃপ্তি হোটেল কখনো বন্ধ হয় না by ফারুখ আহমেদ

বাস থেকে নেমে রিকশা, তারপর পাঁচ মিনিটে উত্তরা হোটেল। এটি আবাসিক হোটেল। ঈশ্বরদী এসে স্টেশন রোডের পাশের এই উত্তরা হোটেলেই ডেরা গাড়লাম। পাশেই বাজার, মার্কেট, গঞ্জ, রেলস্টেশন, বেচাকেনা, মানুষের আনাগোনা। ঈশ্বরদীর অন্যতম দর্শনীয় স্থান এখানকার বেনারসিপল্লি, ফতেহ মোহাম্মদ এলাকা তার নাম।


ফতেহ মোহাম্মদপুর স্টেশন রোড থেকে অল্প পথ। পাকশী স্টেশন আর ঈশ্বরদী জংশনের সঙ্গে বেনারসি সংস্কৃতি এবং প্রাচীন জনপদ হিসেবে অনবদ্য হয়ে আছে ঈশ্বরদীর আকাশ-বাতাস আর মানুষ। এসব দেখতেই ঈশ্বরদী এসেছি। সঙ্গে গ্রীষ্মের ফল লিচু বাগানের ছবি তোলা মুখ্য উদ্দেশ্য। আটটার বাসে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত তিনটা বেজে গেছে। মাঝ বিরতিতে ফুড ভিলেজে রাতের খাবার খেয়ে নিলেও হোটেলের রুমে প্রবেশের পর পরই খিদেয় পেট মোচড় দিয়ে উঠল। এত রাতে খাবারের কী হবে ভাবছিলাম। হোটেলবয় মুশকিল আসান করল। সে আমাদের ঘর গোছাতে গোছাতে জানাল, তৃপ্তি হোটেলে খাবার পাওয়া যাবে। ভাবলাম রেলস্টেশনের পাশেই হোটেল। রাত-বিরাতে স্টেশনে রেল থামে, সুতরাং এমনটাই হওয়ার কথা। বয়কে খাবার আনতে পাঠালাম। একটু পরই ছেলেটি খাবার নিয়ে ফিরল। আমরা সে রাতে তৃপ্তি হোটেলের খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ঘুমাতে গেলাম।
পরদিন ঘুম ভাঙতেই মাহবুবুল হক এলেন। আমরা তাঁকে দুদু ভাই বলে ডাকি। প্রথম আলোর ঈশ্বরদী প্রতিনিধি। তাঁর সঙ্গে বের হয়ে আমরা সকালের নাশতা খেতে তৃপ্তি হোটেলে চলে এলাম। হোটেলের কেদারায় জায়গা নিতেই দুদু ভাই তৃপ্তি হোটেলের গুণগান শুরু করলেন। নিজ শহরের হোটেল একটু ভালো। এমন আপন কথাবার্তা, গুণগান স্বভাবিক মনে হলো। দুদু ভাই বললেন, এটা ঈশ্বরদীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারের হোটেল। ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের পাশে সাদামাটা এক জায়গায় হোটেলটির অবস্থান। দেখে তেমন আহামরি কিছু মনে হলো না। তা ছাড়া দেখে ভালো লাগার মতো কিছুই পেলাম না। দেশের বহু ট্রেন স্টেশনের পাশে এমন হোটেল অহরহই চোখে পড়বে। তবে খাবারের মান ভালো। তৃপ্তি হোটেলের খাবার খেয়ে তৃপ্তি নিয়েই বের হবেন যেকোনো ভোজনরসিক। তবু তৃপ্তি হোটেলের বিশেষত্ব অন্য খানে, জানালেন দুদু ভাই। ভালো করে আবার একনজর হোটেলটা দেখে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে দুদু ভাই ধাঁধায় ফেললেন, খুঁজে দেখুন কিছু চোখে পড়ে কি না! খুব ব্যস্ততা হোটেলের লোকজনদের মধ্যে। প্রচুর কাস্টমার আসছে, খাবার খেয়ে চলে যাচ্ছে, কেউ কেউ পার্সেল নিচ্ছে। সবকিছু দেখে বললাম, হোটেলটা খুব জনপ্রিয়। দুদু ভাই বললেন, অন্য কিছু পেলেন না! আমি ‘না’ বলতেই তিনি গড়গড় করে বলে চললেন, তৃপ্তি হোটেলের খাবারের সুনামের কথা এলাকার লোকেরা বেড়াতে আসা ভ্রমণপিপাসুদের অকপটে বলে থাকেন। সকালে ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে ডিম ভাজা বেশ মুখরোচক। তা ছাড়া সকালে পরোটার সঙ্গে গরুর মাংস ভুনা অসাধারণ। আছে নানা ধরনের সবজি ভর্তায় দুপুর-রাতের খাবার। তবে খাবারের চেয়ে অন্য একটা বিষয় তৃপ্তি হোটেল প্রায় বিশ্বরেকর্ডধারী, সেটা হলো কোনো দিন হোটেলের ঝাঁপ নামেনি অর্থাৎ তৃপ্তি হোটেল কখনো বন্ধ হয়নি। সারা বছর, দিন-রাত, ঈদ-পূজা-পার্বন সব সময় হোটেল খোলা থাকে। আর বন্ধ হবে কী করে, হোটেলের কোনো ফটকই তো নেই! আবার ভালো করে হোটেলের দিকে চোখ বুলালাম। ব্যাপারটা অবাক হওয়ার মতো। তৃপ্তি হোটেলে বের হওয়ার একটিমাত্র পথ, কিন্তু সেখানে কোনো দরজা নেই, কোনো ঝাঁপও নেই যে হোটেলটি বন্ধ করা যাবে। তার অর্থ হোটেলটি দিন-রাত সমানে খোলা থাকে, সঙ্গে চলে খাবার বিক্রি। লোক আসছে-যাচ্ছে, কর্মচারী পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু হোটেল বন্ধ হচ্ছে না, কখনো বন্ধ হয়নি। বিবিসি রেডিওতে তৃপ্তি হোটেল নিয়ে ফিচার হয়েছে। হানিফ সংকেত তাঁর টিভি ম্যাগাজিন ‘ইত্যাদি’তে কখনো বন্ধ না হওয়ার রেকর্ডের জন্য তৃপ্তি হোটেল নিয়ে ফিচার করেছেন। সুতরাং তৃপ্তি হোটেলের এমন রেকর্ড ও জনপ্রিয়তা নিয়ে আমার আর কোনো সংশয় বা সন্দেহ রইল না!
১৯৭৪ সালে হোটেলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই দিন-রাত সমানে চলছে। এক দিনের জন্যও হোটেলটি কেউ বন্ধ পায়নি। হোটেলটি মূলত রেলওয়ের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। জায়গাটির লিজ গ্রহীতা আবদুর রহিম। এখনো হোটেলের সাইনবোর্ডে তাঁর নাম লেখা। পরবর্তী সময়ে আবদুর রহিম ঘরটি ভাড়া দেন স্থানীয় দোমনাকে। সেই দোমনাই এখন হোটেলের পরিচালক।
ঈশ্বরদী ঐতিহ্যের শহর। ঈশ্বরদী লিচুর শহর। ঈশ্বরদী বেনারসিপল্লির জন্য বিখ্যাত। সঙ্গে ঈশ্বরদী বিখ্যাত হোটেল তৃপ্তির জন্য। সুতরাং ঈশ্বরদী বেড়াতে এলে লালন শাহ সেতু, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, মেরিনপাড়া, পদ্মাপাড়ের সাড়াঘাট, পাকশী স্টেশনের পাশাপাশি স্টেশন রোডের কাছের তৃপ্তি হোটেলে একবার হলেও ঢুঁ মারতে হবে।
কি, ঢুঁ মারবেন না?
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.