বাঘা তেঁতুল-জেলের ভাত by সৈয়দ আবুল মকসুদ

অস্ট্রেলিয়ার গবেষকেরা প্রায় ১৭ প্রজাতির হাঙরের ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, হাঙর মাছ সবকিছু রংহীন দেখে। রঙিন বস্তুকে তারা দেখে রংহীন বর্ণে। গবেষণাপ্রধান ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক নাথান হার্ট বলেছেন, ‘এই তথ্য আমাদের হাঙরের আক্রমণ থেকে বাঁচার পথ খুলে দিল।


যদি কেউ এমন রঙিন পোশাক পরে পানিতে নামে, যার রং সমুদ্রের পানির রঙের চেয়ে খুব একটা গাঢ় নয়, তাহলে তাকে আর হাঙর আক্রমণ করতে পারবে না।’
এই গবেষণার ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে সেখানকার কেউ যদি আদালতে মামলা ঠুকে দেয়, তাহলে হার্ট সাহেবের হার্টফেল করার উপক্রম হবে। প্রমাণ করবেন কীভাবে তিনি? প্রমাণ করতে গেলে রঙিন কাপড় পরে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে হবে দুই পক্ষকেই।
কিছুকাল আগে সম্ভবত জার্মানির এক প্রতিষ্ঠান আদিরসাত্মক বিষয়ে জরিপ করেছে। ইউরোপের দেশে দেশে তা প্রায়ই করা হয়। কয়েক হাজার দম্পতির মধ্যে জরিপ করে তারা নাকি দেখেছে, ৭৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, যৌনমিলনের জন্য উইকেন্ড বা শুক্রবার বা শনিবার রাতটিই তাঁদের পছন্দ। জরিপের এই ফলাফল নিয়ে মকদ্দমা হলে নির্ঘাৎ হেরে যেতেন জরিপ কর্মকর্তারা। উত্তরদাতারা যে সত্য বলেননি, বানিয়ে বলেছেন, তা কীভাবে প্রমাণ করা যাবে? উত্তরদাতারা এখন যদি অস্বীকার করেন? অথবা বিচারালয় যদি এই জরিপের ফলাফল ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে করা বলে মনে করেন?
এখন থেকে দুনিয়ার জরিপকারী গবেষকদের এমন আটঘাট বেঁধে কাজ করতে হবে, যাতে প্যাঁচে পড়ে গেলেও বেরিয়ে আসার পথটা খোলা থাকে। এখন পদবি বদলে গেছে। আগে লোকে আমাকে বলত কবি, সমালোচক ও গবেষক। সমালোচনা ও গবেষণা জিনিসটি হলো যথাক্রমে সম্ভাব্য ও তথ্যনির্ভর। সমালোচনা করতে গিয়ে যদি বলি অগ্নিবীণা কোনো কাব্যই নয়, তা হবে আমার মন্তব্য। যদি বলি, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ উপন্যাসে দাম্পত্য মাধুর্য ঠিকমতো আঁকা হয়নি, স্বামী-স্ত্রীর খিটিমিটির কথাই বেশি, এখন যে অবস্থা তাতে কথাশিল্পীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মামলা হতে পারে। আদালত সমন না পাঠিয়ে সরাসরি আমাকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি করতে পারেন। তখন সব উপন্যাস ঠেলাগাড়িতে আদালতে নিয়ে আমি প্রমাণ করতে পারব না আমার বক্তব্য তথ্যনির্ভর।
২২ জানুয়ারি প্রথম আলোর মতামত জরিপের প্রশ্ন ছিল: টিআইবির জরিপ ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে করা, সুপ্রিম কোর্টের মূল্যায়ন কমিটির এ বক্তব্যের সঙ্গে কি আপনি একমত? ১১.২৪ শতাংশ বলেছেন ‘হ্যাঁ’। ৮৬.৭১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা একমত নন। এখন যদি কেউ মামলা ঠুকে দেয়, উত্তরদাতাদের নাম-সাকিনসহ উপাত্তের বান্ডিল বগলে নিয়ে সম্পাদক ও বিভাগীয় সম্পাদককে ছুটতে হবে কোনো প্রত্যন্ত জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে।
আমি যদি বিচার বিভাগের মানসম্মান ও ভাবমূর্তি বাড়ানোর কেউ হতাম, টিআইবির ওই অপ্রশংসামূলক জরিপে চটে গিয়ে সংস্থার চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালকের কুশপুত্তলিকা বানিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে অগ্নিসংযোগ করতাম। তাঁরাও অপমানিত হতেন, আমারও নাম পত্রিকায় ছাপা হতো, টিভি খবরে আমাকে দেখাত। বাদী-বিবাদী কারও বিভিন্ন আদালতে দৌড়াতে হতো না।
উপাত্তের কাগজপত্র ঝাঁকায় করে মিন্তির মাথায় দিয়ে উচ্চ আদালতে ছুটতে হতো না। যানজটের মধ্যে চায়ের দাওয়াত রক্ষা করার বিড়ম্বনা থেকেও বাঁচা যেত। জরিপ করে জেলের ভাত খাওয়ার আশঙ্কায় বিনিন্দ্র রাত কাটাতে হতো না কারও।
টিআইবি কি বলল না বলল, তা বড় দাঁড়িপাল্লা দিয়ে ওজন করা উচিত ছিল, জুয়েলারির সোনা মাপের নিক্তি দিয়ে নয়। এক ভরি সোনায় যদি কয়েক রতি কম হয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু এক মণ লাকড়ি মাপলে যদি দেখা যায় এক কেজি বা ৭০০ গ্রাম কমবেশি—তা নিয়ে মারামারি করা অর্থহীন।
সেদিন এক অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ায় এক মাননীয়কে আমি একান্তে বলেছি, চাকরিজীবনটা স্থায়ী নয়। পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার যত কম করা যায়, ততই গৌরবের। অবসরে যাওয়ার পরে অথবা মৃত্যুর পরে ছেলেমেয়েদের, তাদের বউ বা জামাইদের অথবা নাতি-নাতনিদের সমাজে যেন মাথা নিচু করে থাকতে না হয়। এই দুনিয়া বড় বাজে জায়গা। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বহু অবসরপ্রাপ্ত মাননীয়কে ট্র্যাকস্যুট পরে পিটি উষার মতো দৌড়াতে দেখি। কেউ তাঁদের পোছে না। বাংলাদেশে ক্ষমতা গেলে সব গেল।
অতি উঁচুতে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উচিত যেকোনো প্রশ্নেই সাবধানে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা। নিন্দাসূচক অথবা বিরূপ সমালোচনায় ছোটো কেউ উত্তেজনায় লাফাতে পারে, খুব বড় যিনি, তিনি তা পারেন না। অসংযত হয় ছোট, বড়কে হতে হয় সংযততর।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.