গন্তব্য ঢাকা-খাট্টা গ্রামের মিঠা মানুষটির গল্প by শর্মিলা সিনড্রেলা

‘পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে আড়িয়াল খাঁ নদ। বাড়ি থেকে নদের দূরত্ব নেহাত কম নয়। ভ্যানে যেতেই লাগে প্রায় ১৫ মিনিট আর হাঁটাপথে আধঘণ্টা তো বটেই। সেই নদের সীমাহীন জলে বড়শি বা জাল ফেলে মাছ ধরার আনন্দের কাছে এই দূরত্বটুকু নস্যি। তাই রোজই ছুটে যাওয়া হতো জলের টানে। তারপর দিন শেষে মাছ নিয়ে ঘরে ফেরা।


কী মজাই না হতো তখন! আবার কখনো কখনো ঘটত নানা ঘটনা। এই যেমন, একবার বন্ধু হাবিবের সঙ্গে গেছি মাছ ধরতে। তখন ছিল শীতের সময়। কনকনে শীতের মধ্যে আমরা দুজন নদের ধারে বসে আছি। বিকেল পাঁচটা থেকে বসে আছি, রাত আটটা বেজে যায়, কোনো মাছের দেখা নেই। আমরা বসে আছি আর মুড়ি খাচ্ছি। হঠাৎ দেখি বড়শিতে টান লাগল। আমরা তুলতে গেছি, দেখি অনেক ভারী। হাবিব বলল, মনে হয় ঝোপে বড়শি আটকেছে, কোনো মাছ নেই, ছেড়ে দে। আমি তাই বড়শি টানা ছেড়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আবার বড়শির সুতা ধরে টানছি, দেখি হালকা লাগে। তীরের কাছাকাছি আসার পরই আবার বড়শিতে টান লাগল। আর এত জোরে টান লাগল যে মনে হলো আমাকেই টেনে নিয়ে যাবে। আমি তাড়াতাড়ি একটা গাছে সুতাটাকে পেঁচিয়ে দিলাম। কিন্তু আমার হাত কেটে একাকার। মনে হয়, সেই মাছটার ওজন ৩০ কেজির মতো ছিল। মাছটা ধরতে পারলাম না। পরে আবার বড়শি ফেলে শেষরাতের দিকে একটা বোয়াল মাছ পেয়েছিলাম। সেটাও অনেক বড় ছিল। ওজন ছিল প্রায় ১১ কেজি।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন তিনি আর আমিও শুনছিলাম তেমনই আগ্রহ নিয়ে। নদীর ধার, কনকনে শীত, বন্ধুর সঙ্গ, মুড়ির শব্দ আর বোয়াল মাছ ধরার আনন্দ—সবই তো যেকোনো গ্রামছাড়া মানুষকে নিজের নাড়ির টানের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই যথেষ্ট।
যাঁর মাছ ধরার এমন রোমাঞ্চকর কাহিনি এতক্ষণ শুনলাম, তাঁর নাম মোহাম্মদ শহীদ। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার কাউরুবেড়া ইউনিয়নে তাঁর বাড়ি। তাঁদের গ্রামের নামটি ‘খাট্টা’ হলেও মানুষগুলো যে মিঠা, সেটা বলতে ভোলেন না মোহাম্মদ শহীদ। আজ ১৬ বছর হলো ঢাকায় আছেন তিনি, কিন্তু সেসব স্মৃতি এখনো অমলিন তাঁর মনে। বাবা, মা এবং এসব ভালো লাগার ক্ষেত্র—সব ছেড়ে জীবিকার টানে একদিন বোনজামাই ওহাব মোল্লার সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। ‘না, এখন সব সয়ে গছে। ঢাকায় থাকতেও এখন খারাপ লাগে না। তা ছাড়া ভালো লাগার আরও একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এখানে। সেটা হলো গান। আমি সংগীত খুব ভালোবাসি। গ্রামে যখন থাকতাম তখন কেবল কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতাম। কিন্তু এখন আমরা রোজই রাতে গানের আসর বসাই। রাত নয়টা থেকে আমাদের গান চলে রাত একটা পর্যন্ত। কখনো বা সারা রাতই আমরা একসঙ্গে গান গাই। আমরা ১০-১৫ জন একসঙ্গে গান করি। যখন গ্রামে যাই তখন তো এভাবে গান করতে পারি না, তাই খুব খারাপ লাগে।’ নিজের শখকে নিয়েই এখন সুখী মোহাম্মদ শহীদ।
ঢাকায় আসার পাঁচ বছর পর স্ত্রী পিয়ারা বেগমকে নিয়ে এসেছেন তিনি ঢাকায়। ‘বড় ছেলে সোহাগ থাকে দেশে, আমার বাবা-মায়ের কাছে। নয় বছরের মেয়ে শ্রাবণী থাকে আমার কাছে আর পড়াশোনা করে তৃতীয় শ্রেণীতে। আর ছোট ছেলে তরিকুল পড়ছে প্রথম শ্রেণীতে। আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমার স্বপ্ন, ওরা সততার সঙ্গে কাজ করে খেয়ে-পরে বাঁচবে। আমার বউ বা সন্তানেরা কেউ গান জানে না। তরিকুলকে তাই আমি গান শেখাতে চাই।’ বুকের মধ্যে এই ছোট্ট স্বপ্নটাই লালন করেন মোহাম্মদ শহীদ।
শহীদ গ্রাম ছেড়েছেন আজ অনেক দিন। এক মাস বা দুই মাস পর পর গ্রামে যাওয়া হয় তাঁর। বাবা-মা আছেন, ছোট ভাই আছে আর ছেলে সোহাগও তো আছে। প্রতিমাসেই বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে দেন তিনি। কে জানে, কবে গ্রামে একেবারে ফেরা হবে কিংবা হবে কি না? এখানে তো স্বল্প পুঁজি দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করে দিনে প্রায় ৫০০ টাকা আয় হয়। কিন্তু গ্রামে গেলে কী করবেন তিনি?
ঢাকার আগারগাঁওয়ে বিসিএস কম্পিউটার সিটি এবং লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মাঝের সরু পথটিতে রোজ বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ভেলপুরি বিক্রি করেন তিনি। আর বেলা ১১টা থেকে থাকেন শেরেবাংলা গার্লস ও বয়েজ স্কুলে। ৩৯ বছর বয়সী এই মানুষ খাট্টা নামের গ্রামটিকে ভুলতেও পারেন না আবার ঢাকার সংগীতের আসরের টানও ছাড়তে পারেন না। সর্বোপরি আয়ের দুশ্চিন্তা তো রয়েছেই। তাই সবকিছুই এখন ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে মোহাম্মদ শহীদ বলেন, ‘দেখি কী হয়?’

No comments

Powered by Blogger.