বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস-দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার by মার্টিন অধিকারী

আজ বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস। ১৯৫৪ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কুষ্ঠরোগের বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা দূর করার এবং এ রোগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে।


কুষ্ঠরোগের বিষয়ে ভুল ধারণার ফলে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যুগ যুগ ধরে সমাজ, এমনকি একান্ত আপনজনদের দ্বারাও অবহেলিত ও লাঞ্ছিত। সভ্যতার আলোয় আমাদের সেই অন্ধকার অনেকটা দূর হয়ে গেলেও আজও বিভিন্ন দেশে ও সমাজে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত মানুষের প্রতি ঘৃণা ও অস্পৃশ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা রয়ে গেছে। আমাদের দেশেও তাই কারও কুষ্ঠরোগ হলে তাকে অনেক দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনার আঘাত সহ্য করে চলতে হয়। আশির দশক থেকে বিনা মূল্যে কুষ্ঠরোগের সফল চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত সর্বাধুনিক সফল চিকিৎসা এমডিটি বা মাল্টি ড্রাগ থেরাপি সেবন করলে এ রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এখনো অনেকেই কুষ্ঠরোগীদের বিষয়ে সংস্কারজনিত ‘অস্পৃশ্যতার’ মনোভাব পোষণ করে থাকেন। তাই কুষ্ঠ একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত।
লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত মানুষের জীবনে আশার আলো এনে দিয়েছে। যিশুখ্রিষ্টের মানবপ্রেম ও সেবার মহান আদর্শকে অনুসরণ করে আমাদের দেশেও ওই সেবার কাজ চলছে। দেশে বর্তমানে ২১টি প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ১৪টি জেলায় লেপ্রসি মিশন কুষ্ঠ সম্পর্কে শিক্ষা ও তথ্য প্রদান, গণসচেতনতা সৃষ্টি করা, কুষ্ঠরোগীদের শনাক্ত করা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দান, রোগের শিকার ব্যক্তিদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ তাদের আর্থসামাজিকভাবে পুনর্বাসন করা ইত্যাদির সমন্বয়ে সামগ্রিক সেবার কাজ করছে।
আমাদের মূল কথা হলো, কুষ্ঠরোগ কোনো অভিশাপ নয়, বিনা মূল্যে এ রোগের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাচ্ছে; রোগ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা জরুরি; এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি যেকোনো প্রকারের সামাজিক বৈষম্য বড় অপরাধ।
সচেতনতার অভাবে ও সময়মতো ওষুধ না খাওয়ার ফলে কুষ্ঠের কারণে দেশে বর্তমানে ৩৫ হাজারের মতো কুষ্ঠ-আক্রান্ত ব্যক্তি ঘা ও বিভিন্ন ধরন ও মাত্রায় প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়ে আছেন। কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মৌলিক প্রয়োজন হচ্ছে: ১. জনগণকে যথেষ্ট সচেতন করা, যাতে কারও রোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা জানতে পারেন এবং ২. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত সর্বাধুনিক সফল চিকিৎসা এমডিটি যেন রোগী ব্যবহার করে, তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। পৃথিবীর সর্বত্রই কুষ্ঠরোগের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সফল চিকিৎসা হচ্ছে এই এমডিটি, যা বিনা মূল্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সরবরাহ করে এবং সব রোগীকে দেওয়া হয়।
নীলফামারী, গাইবান্ধা, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, রংপুর, দিনাজপুর এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় সব সময়ই দেশের অধিকসংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়ে আসছে। নীলফামারী, গাইবান্ধা, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান—এই চারটি জেলায় কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব এখন বেশি।
জাতীয় কুষ্ঠ উচ্ছেদ কর্মসূচির আওতাধীন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে দেশে কুষ্ঠ-আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবার কাজ চলছে। এই সেবা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি: ১. ১৮৯৮ সালের লেপার্স অ্যাক্ট বাতিল করা প্রয়োজন। এই আইনে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যাতে রোগ ছড়াতে না পারে, সে জন্য সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে রোগীদের বিচ্ছিন্ন করে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার বিধান আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কুষ্ঠরোগ নিরাময়ে কোনো সফল চিকিৎসা ছিল না। সেকালে ওই আইনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা বাতিল করা দরকার, যেন কুষ্ঠরোগীদের মানবাধিকার রক্ষিত হয়। কুষ্ঠমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এ ধরনের পুরোনো আইন বাতিল করা একান্ত প্রয়োজন। আশা করি, এই আইনের বাতিল বিল আমাদের মহান সংসদ কর্তৃক অচিরেই পাস হবে।
২. বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি বাস্তবসম্মতভাবে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। এ লক্ষ্যে দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে এবং নার্সিং শিক্ষা কারিকুলামে কুষ্ঠরোগ ও তার চিকিৎসার বিষয়ে যথেষ্ট প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
৩. কুষ্ঠরোগীদের মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এ বিষয়ে ইতিবাচকভাবে বিভিন্ন সংবাদ ও কুষ্ঠ বিষয়ে সাফল্যমূলক তথ্য ও খবরাখবর পরিবেশন করা আবশ্যক। দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও লেপ্রসি মিশনের বিভিন্ন প্রকল্পসহ কুষ্ঠরোগের জন্য কাজ করা সংস্থাগুলোয় এ রোগের চিকিৎসা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়।
কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে বৈষম্য দূর করার স্বার্থে জাতিসংঘ ২১ ডিসেম্বর, ২০১০ একটি নীতিমালা ও গাইডলাইনস অনুমোদন করেছে। ওই ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক পুনর্বাসনের স্বার্থে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম দপ্তর, ইউনেসকো, ইন্টারন্যাশনাল ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কনসোর্টিয়াম যৌথ উদ্যোগে ২০১০ সালের নভেম্বরে এক কমিউনিটি বেইসড রিহ্যাবিলিটেশন গাইডলাইন তৈরি করেছে। এ ছাড়া আমাদের পবিত্র সংবিধানসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সুরক্ষা আইন, নীতিমালা ও দলিল কুষ্ঠ আক্রান্ত হতভাগ্য মানুষের জীবনে প্রকৃত মানব মর্যাদা নিয়ে বাঁচার জন্য আশার আলো জ্বালাতে সবাইকে অবশ্যই প্রেরণা ও সহায়তা দেবে, এটাই আশা করা যায়।
রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী: পরিচালক, অ্যাডভোকেসি ও প্রমোশন, লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
martin_a@tlmbangladesh.org

No comments

Powered by Blogger.