সংস্কৃতি-রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার by অমিত বসু

রবীন্দ্রপরিবার বিশাল বৃক্ষের মতো। শাখা-প্রশাখা অগণন। অনেক শাখা শুকিয়েছে। কিন্তু যা আছে তা-ইবা কম কীসে। বিন্দুতে সিল্পুব্দ দর্শনের সুযোগ সুবর্ণের চেয়ে মূল্যবান। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার বহনের দায়িত্ব তো আমাদেরও।


অবক্ষয়ের মরুভূমিতে পিরামিডের মতো দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রপরিবার এখন দ্বীপের মতো ছড়িয়ে আছে বিশ্বে। রবীন্দ্রনাথের পাশে যখন মৃণালিনী দেবী ছিলেন, তখন সময়টা ছিল অন্য রকম। টানাটানির সংসার। আশ্রমিকদের অন্নসংস্থানে মৃণালিনী নিঃসংকোচে নিজের অলঙ্কার তুলে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের হাতে। মনে করেছেন, স্ত্রী হিসেবে এটাই তার কর্তব্য। কোল আলো করে প্রথম সন্তান মাধুরীলতা এসেছে ১৮৮৬-তে। তারপর একে একে আবির্ভাব রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা, শমীন্দ্রনাথের। রবির সংসারে চাঁদের হাট। পাঁচ সন্তানের তুফান কলকাতার জোড়াসাঁকোয়, আবার কখনও শান্তিনিকেতনে। আনন্দবাজার কিন্তু অচিরেই বিনষ্ট। দমকা হাওয়ায় নিভেছে দীপ। রেণুকার মৃত্যু ১৯০৩-এ। সবচেয়ে আদরের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ হারিয়েছেন ১৯০৭-এ। ১৯১৮-তে চলে গেল জ্যেষ্ঠ কন্যা মাধুরীলতা। তিন সন্তানের মৃত্যু মৃণালিনী দেবীকে দেখতে হয়নি। মাত্র ১৯ বছর সংসার করে অনন্তলোকের যাত্রী তার আগেই। দুঃখের ঢেউ রবীন্দ্রনাথ একা সামলেছেন। রথীন্দ্রনাথ আর মীরাকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছেন। রথীন্দ্রকে পাঠিয়েছেন আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি-পশুপালনের শিক্ষা নিতে, যাতে শান্তিনিকেতন সংলগ্ন গ্রাম শস্য-শ্যামল করে তুলতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর অনুরোধে বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য হন রথীন্দ্রনাথ। রথীনের স্ত্রী প্রতিমা দেবী নিঃসন্তান। একমাত্র মীরা দুই সন্তানের জননী হন। মীরার বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না।
স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে দুই সন্তান নীতিন্দ্র আর নন্দিতাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছেই। নন্দিতার বিয়ে হয় কৃষ্ণ কৃপালিনীর সঙ্গে। লন্ডনে ছিলেন তারা। সেখান থেকেই অতীতের পাতায়। মীরার মৃত্যু ১৯৬৯-এ। আশা ছিল, মীরার পরিবার হয়তো রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব বহন করবে। তাও হলো না।
রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী থেকে অবসর নিয়ে দেরাদুনে চলে যান। ১৯৬১-তে সেখানেই যবনিকা পতন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিরা কেউ আর রইল না।
রবীন্দ্রনাথরা ছিলেন ১৫ ভাইবোন। দেবেন্দ্রনাথ আর সারদা দেবীর চতুর্দশতম সন্তান রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী, পরিবারে যার স্থান ১১ নম্বরে, তার সংসার কিছুটা বিস্তৃত। জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে বিয়ের পর চারটি সন্তানের জন্ম হয়। হিরণ্ময়ী, জ্যোতিরীন্দ্রনাথ, সরলা, ঊর্মিলা। তারাও কালের অতলে তলিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান তার সন্তানসন্ততিরা এখনও পৃথিবীতে আলো ছড়াচ্ছেন। সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম ভারতীয় আইসিএস। অর্থাৎ পরাধীন ভারতে এক নম্বর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ক্যাডার। প্রথমদিকে মুম্বাইয়ে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ তার কাছে প্রায়ই ছুটে যেতেন। ১৬ বছরে রবীন্দ্রনাথের লন্ডন সফর সত্যেন্দ্রনাথের দৌলতেই। বল ডান্সও শেখেন তার সৌজন্যে। আন্না তরখরের সঙ্গে প্রথম প্রেমে পড়া সত্যেন্দ্রর কারণেই। রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ। নিমতলা মহাশ্মশানে রবীন্দ্রনাথের মুখাগি্ন করেন সুবীর। সেই সুবীরের পুত্র সুপ্রিয় এখনও শান্তিনিকেতনে। বয়স ৭২। কোনো অবস্থায়ই শান্তিনিকেতন ছাড়তে নারাজ। রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন; কিন্তু মনে নেই। মনে থাকবে কী করে? তখন যে বয়স মাত্র আড়াই বছর। তবে রবীন্দ্রনাথের কোলে বসা ছবিটা সযত্নে সুরক্ষিত। সেই ছবি কেউ চাইলে মুখের ওপর না বলে দেন। ১৯৪৬ থেকে তিনি শান্তিনিকেতনে। সেখানেই শিক্ষা ও শিক্ষকতা। সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র সুরেন্দ্রনাথের চার পুত্র। সুবীর, প্রবীর, মিহির, সুণৃত। সত্যেন্দ্রনাথের কন্যা ইন্দিরা দেবী বিশ্বভারতীর উপাচার্য হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহধন্যা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পত্রালাপে ছেদ পড়েনি কখনোই।
সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র সুরেন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান মিহির। মিহিরের জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রদীপ্ত, দ্বিতীয় সুনন্দ, তৃতীয় কন্যা মিত্রা। মিত্রার বিয়ে হয়েছে কবি সরোজিনী নাইডুর পরিবারে। প্রদীপ্ত আরও উজ্জ্বল দুই কন্যার কল্যাণে। ফুটফুটে দুটি মেয়ে অদিতি আর প্রতীতি কিন্তু প্রদীপ্তর কাছে নেই। একজন একটু দূরে, আরেকজন বেশ দূরে। উপায় নেই, তাদের বিকাশের জন্য প্রদীপ্তের কৃচ্ছ্রসাধন। আমেরিকায় কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি করছেন অদিতি। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে চলছে অবিরাম গবেষণা। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিচর্চার সঙ্গে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ। অবিশ্রাম পরিশ্রমের পর রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিশ্রাম। অবকাশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অপরিসীম বিস্ময়ে আমেরিকানরাও স্বাদ নেয় তার। প্রতীতি দিলি্লতে। বেথুনে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হয়ে দিলি্লর স্কুল অব প্ল্যানিং অ্যান্ড আর্কিটেকচারে অরবান প্ল্যানিং নিয়ে মাস্টার্স করছেন। সঙ্গীত-নৃত্যে পারদর্শিনী প্রতীতি। সময়বিশেষে তার স্ফুরণ।
রবীন্দ্রপরিবার বিশাল বৃক্ষের মতো। শাখা-প্রশাখা অগণন। অনেক শাখা শুকিয়েছে। কিন্তু যা আছে তা-ইবা কম কীসে। বিন্দুতে সিল্পুব্দ দর্শনের সুযোগ সুবর্ণের চেয়ে মূল্যবান। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার বহনের দায়িত্ব তো আমাদেরও। অবক্ষয়ের মরুভূমিতে পিরামিডের মতো দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ। তাকে দেখেও যদি সম্বিৎ না ফেরে, কিছু বলার নেই। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, 'বিশ্ব সাথে যেনো যেথায় বিহারও, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও'। যোগাযোগের এটাই অন্যতম সূত্র। বিশ্বকে যে আপনার করতে পারবে, রবীন্দ্রনাথ তার। অসীম প্রকৃতিতেও তিনি। বাঙালির দু'চোখের অশ্রুধারার মতো গঙ্গা-পদ্মায়ও তার স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যৎ। রবীন্দ্রনাথ অতীত নন, বর্তমান। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে পা ফেলতে হলে রবির আলোর বিকল্প কোথায়।

অমিত বসু :ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.