মিলন দিবস-তরুণেরাই পথ দেখাবে by সেলিনা আখতার

১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের ভাড়াটে ঘাতকের বুলেট মিলনের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল। মিলন আর কোনো দিন ফিরবে না। এমন শাশ্বত সত্য মেনে নিয়ে হূদয়ের গভীরতম বেদনা পাথরচাপা দিয়ে আজও বেঁচে থাকার কঠিন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। নভেম্বর মাস এলে নতুন করে হূদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মন কেঁদে কেঁদে খুঁজে বেড়ায় মিলনের অস্তিত্ব। বারবার অশ্রুজলে ঝাপসা হয়ে আসে চোখের দৃষ্টি।


আমার চারপাশটা ঘিরে শুধুই নিথর নীরবতা; কোথাও যে মিলন নেই। মিলন ঘরে ঢুকে বলছে না, ‘আম্মা কোথায়?’ সন্তানহারা এক মাতৃহূদয়ের এ মরুভূমির শূন্যতা আর একজন মা ব্যতীত কারও উপলব্ধি করার নয়।
সাম্প্রতিককালে প্রচারিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়সংবলিত প্রতিবেদনগুলো পড়ে মন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছে।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে, স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব পায়। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তনের দীর্ঘ ২০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে—এমনটা আমরা বলতে পারি না। প্রতিটি নির্বাচনের আগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দুই দলের মধ্যে পতিত স্বৈরাচারকে দলে নিয়ে জোট গঠনের অসুস্থ রাজনীতি দেশবাসী লক্ষ করেছে। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের সঙ্গে জোট বাঁধতেও রাজনীতিবিদদের দ্বিধা নেই। কারণ, ক্ষমতার মসনদে বসাটাই যে আসল উদ্দেশ্য।
দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েম হলেও সংসদীয় রীতি অনুযায়ী কোনো একটি সংসদ অধিবেশনও পরিচালিত হয়নি এ ২০ বছরে। সব সংসদ অধিবেশন চলে বিরোধী দলবিহীন। যদিও সরকারি ও বিরোধী—উভয় দলের উপস্থিতিতে সংসদ অধিবেশন চলাটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ও সমস্যাগুলো সংসদে দুই দলের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে, এটাই পপ্রত্যাশা থাকে। পরিতাপের বিষয়, রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনের পর ভুলে যান যে আমজনতাই এ দেশটার মালিক। নির্বাচনের পর তাঁদের কাছে আপন স্বার্থ ও দলের স্বার্থ বড় হয়ে যায়। ফলে দেশের ও জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অবহেলিত থেকে যায়।
আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের বেশি হয়েছে। দফায় দফায় তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষের নাজেহাল অবস্থা। আমাদের অনেক বিজ্ঞ মন্ত্রী বলে থাকেন, চাষিরা তাঁদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন, তাঁদের অনেক উন্নতি হয়েছে। সরকার মাঠ তদারকি করলে দেখবে, প্রকৃত অর্থে তা ঠিক নয়। মধ্যস্বত্বভোগীরাই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। সীমিত আয়ের মানুষের আজ দীনদশা। সন্তানসন্তুতি আর সংসার চালাতে গিয়ে আজ তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। একমাত্র দুর্নীতি দমন কমিশনকেও অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এটা সর্বজনস্বীকৃত যে ভূমি রাজস্ব অফিস একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আমি নিজেও একজন ভুক্তভোগী। আগে ঘুষের পরিমাণ যেখানে হাজার হাজার টাকায় লেনদেন হতো, বর্তমানে তা হয় লাখ লাখ টাকায়। অবশ্য বলতে হয়, দুর্নীতি কোথায় নেই? দু-একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি আজ সমাজের সর্বস্তরে ক্যানসারের মতো মরণব্যাধিরূপে ছড়িয়ে পড়েছে।
শহীদ শামসুল আলম মিলন স্বপ্ন দেখেছিল বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির। স্বপ্ন দেখেছিল বুর্জোয়া, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বদলে দিয়ে সমতাভিত্তিক এক নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার। যে সমাজে সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা থাকবে সমভাবে। গণমানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সেদিন যাঁরা মিলনের সহযোদ্ধা ছিলেন, আজ তাঁরা অনেকেই সুবিধাবাদীদের সঙ্গে আপস করে আপন স্বার্থ সিদ্ধিতে ব্যস্ত।
মিলন ছিল আদর্শগতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন, দৃঢ়চিত্তের অধিকারী এক অদম্য সাহসী যুবক। ওর কাছে আপন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বার্থের ঊর্ধ্বে ছিল দেশ ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ। তাই এরশাদ সরকারের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ওকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। ঢাকা থেকে রৌমারীতে বদলি করা হয়েছিল। মনে-প্রাণে ধ্যান-ধারণায় একজন মানুষ যে কতটা একনিষ্ঠ ও সৎ হতে পারে, তা মিলনকে যাঁরা জানেন, তাঁরা উপলব্ধি করেছেন।
ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে স্বাধিকার আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন—প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের তরুণসমাজ ছিল সোচ্চার। অথচ দেশ যখন ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নারীর প্রতি যৌন হয়রানি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত, তখন আমাদের তারুণ্যের শক্তিধারী তরুণসমাজ নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে। তাই আজকের বিপথগামী তরুণসমাজকে ন্যায় ও সত্যের পথে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব আপনার, আমার, সর্বোপরি তাদের পরিবারের।
প্রথম আলো পত্রিকাটি প্রকাশনার প্রথম লগ্ন থেকে আমি এই পত্রিকার একজন পাঠক। এ পত্রিকার সমাজসেবামূলক নানামুখী কর্মকাণ্ড আমাকে মুগ্ধ করে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে প্রথম আলো পরিবার দুর্গত ব্যক্তিদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশোপযোগী করে গড়ে তোলার কিছুটা দায়িত্বও এবার তারা কাঁধে তুলে নিয়েছে।
আমাদের স্বপ্নের স্বদেশকে গড়ে তুলতে হলে আসুন, আমরা সবাই স্ব স্ব অবস্থান থেকে দেশ ও জাতির জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমে কিছু কল্যাণমুখী কাজ করার মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হই। সবার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মিলিত হয়ে একদিন অবশ্যই বাংলাদেশের পীড়িত, শোষিত, লাঞ্ছিত মানুষগুলোর জীবনে হাসি ফোটাতে সক্ষম হব। মিলনসহ সব শহীদের স্বপ্নও সেদিন সার্থক হবে।
সেলিনা আখতার: শহীদ শামসুল আলম মিলনের মা।

No comments

Powered by Blogger.