বেতাল হরতালে বিপন্ন উলুখাগড়া by এ কে এম শাহনাওয়াজ

কী বিচিত্র এই দেশ! জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কারো দায় আছে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতার মসনদ দখল করার প্রতিযোগিতায় এখন দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল জিম্মি করেছে সাধারণ মানুষকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এখানেই যে এই সব কাণ্ড আবার করা হচ্ছে জনগণের নাম ভাঙিয়ে।


রাষ্ট্রক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য সরকারি দল অসাধু হয়ে যায় বলে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করেছিল। আন্দোলনের ফসল হিসেবে এই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হয়। এ দেশের অসাধু রাজনীতিকদের হাতে গণতন্ত্র বারবার লাঞ্ছিত হয় বলে মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে মন্দের ভালো হিসেবে বেছে নিয়েছিল। আবার সেই আওয়ামী লীগই দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ইচ্ছাকে আমলে না নিয়ে ক্ষমতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে একটি অনিবার্য সংঘাতের পথ তৈরি করে দিল। অন্যদিকে যে ব্যবস্থায় বিএনপির ঘোর আপত্তি ছিল, তা বাতিল হওয়া না হওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগেই সংসদে না এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে হরতালের মতো জনগণ দ্বারা পরিত্যক্ত ধ্বংসাত্মক শেষ অস্ত্রবাণ প্রয়োগ করে ফেলল প্রথমে ৩৬ ঘণ্টা, পরে টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতালে। আবার জনগণের ঘাড়ে হরতাল চাপিয়ে দিয়ে প্রতারক মিথ্যাচারীর মতো বিএনপি নেতারা বলে ফেললেন, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। জনগণকে নিয়েই নাকি তাঁরা এই আন্দোলন করছেন। এই কল্পিত জনগণের বাস কোথায়, আমরা জানি না। তবে হরতালে এ দেশের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সবাই প্রত্যক্ষ করি আর ভুক্তভোগী হই।
কিন্তু ৩৬ ঘণ্টার হরতাল দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঠেকানো যায়নি। সেই হরতালের ক্ষত না শুকাতেই আবার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল পালন করল বিএনপি। মৌলবাদী বন্ধুদের সঙ্গে রফা হয়েছে। তাই তারা হরতাল ডেকেছে পরবর্তী রবি ও সোমবার। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষভাবে ছয় দিনের প্যাকেজ। দেশের কোটি মানুষের দুর্ভোগ। টিভি চ্যানেলে সাধারণ শ্রমজীবী আর ক্ষুদ্র-বৃহৎ ব্যবসায়ীদের আহাজারি। যানবাহনচালকদের বিপন্ন দশা। বিমানবন্দরে বিদেশফেরতাদের লাগেজ নিয়ে অসহায় বসে থাকা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ক্যালেন্ডারে হোঁচট খাওয়া। আর দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজা তো আছেই।
সেই গল্পের ছেলেরা শিশুসুলভ সরলতায় ডোবার ব্যাঙগুলোকে ঢিল ছুড়ে ক্ষতবিক্ষত করার ভয়ংকর খেলায় মেতেছিল। আর ক্ষমতার রাজনীতির লোভী মানুষগুলো নিজেদের শদন্ত বের করে অবলীলায় সাধারণ মানুষ এবং দেশের অগ্রগতির পথ রক্তাক্ত করছেন আবার বিপন্ন মানুষকে বীভৎস অপমান করে ক্যামেরার সামনে নির্লজ্জভাবে বলে বেড়াচ্ছেন, দেশের জনগণ তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করেছে। হরতালের আগের রাতে গাড়ি পোড়ানো-ভাঙচুর হচ্ছে। হরতালের দিন পুলিশি দৃষ্টি এড়িয়ে গাড়ি ভাঙার দৃশ্য টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে। শরীয়তপুরের গরিব মায়ের একমাত্র উপার্জনক্ষম ফল ব্যবসায়ীকে নাটোরে বিএনপির পিকেটাররা অগি্নদগ্ধ করে মৃত্যুপথযাত্রী করে দিয়েছে, আর মির্জা ফখরুল অন্য গ্রহের মানুষের মতো দেশবাসীকে বিস্মিত করে দিয়ে টিভি ক্যামেরায় বলছেন তাঁদের 'শান্তিপূর্ণ হরতাল' পালনের কথা। বলায় কেউ কম যান না। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের প্রতি পুলিশের অমার্জিত-অমানবিক আচরণ দেশবাসী দেখেছে। দেখেছে তাঁর রক্তাক্ত দেহ। আবার লজ্জায় অধোবদন হয়ে দেশবাসী আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফের জবানি শুনেছে। এই হঠাৎ ঘুমভাঙা দায়িত্বশীল নেতা বলেছেন, 'চিফ হুইপ ধস্তাধস্তিতে মৃদু আহত হতে পারেন।'
সরকারের বর্তমান আচরণ ও দেশ পরিচালনা মুক্তমনের মানুষকে স্বস্তি দিচ্ছে না এ কথা মানতেই হবে। সরকারের অনেক নীতি নির্ধারণ প্রতিবাদযোগ্য। বিরোধী দল বিচারে ক্ষমতার রাজনীতির ট্র্যাকে এগিয়ে থাকা বিএনপির এ সুযোগ নেওয়ারই কথা। কিন্তু তার জন্য তো তরিকা আছে। অস্ত্র প্রয়োগ করে লক্ষ্যভেদ করতে না পারলে সে অস্ত্র ক্রমে কার্যকারিতা হারায়। বিএনপির বোঝা উচিত ছিল, সরকার এ পর্যন্ত নিজেকে যতটা দুর্বল করেছে, তার বিপরীতে খুব জনপ্রিয় একটি বিরোধী দল থাকলে জনগণের আস্থা ও সমর্থন নিয়ে চূড়ান্ত অস্ত্রবাণ ছুড়ে কুপোকাত করা সম্ভব হতো। কিন্তু বিএনপির পক্ষে তা সম্ভব হবে কেন? বিএনপি কি নিজেকে পরিমাপ করতে পারছে না? না নিজের ৩৪ শতাংশ ভোটার নিয়েই রাজ্য জয় করা যায়! হরতালের মতো চূড়ান্ত অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে বর্তমান বাস্তবতায় না কর্মীদের সংগঠিত করা সম্ভব, না সরকারকে দুর্বল করা সম্ভব। কারণ দুই দিন আগে ক্ষমতায় থেকে নানা অপকর্মে গায়ে যে কলঙ্ক মেখেছেন বিএনপি নেতা-নেত্রীরা, অধিক ক্ষারযুক্ত সোডা মেখেও তা ধুয়ে ফেলা সম্ভব নয়। এ সময় খালেদা জিয়া যখন দেশ বাঁচানোর জন্য হরতালের ডাক দেন, মির্জা ফখরুলরা যখন সরকারের অন্যায় আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা বলেন; তখন দেশবাসীর কাছে তা উপহাসের মতো শোনায়। নিজেদের প্রস্তুত না করেই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার জন্য তর সইছে না ধরনের মনোভাব নিয়ে বেপথে হাঁটার চেয়ে মানুষের আস্থার কাছে আসার মতো আন্দোলন নিয়ে মাঠে থাকা উচিত ছিল বিএনপির। সরকার তার দুর্বল শাসনে সে সুযোগ বারবার এনেও দিচ্ছে বিএনপিকে।
রাজনীতির মাঠে মেধাবী পথ চলার প্রয়োজন যখন বিএনপির, তখন মৌলিক একটি নীতিগত সংস্কার আনতে পারছে না দলীয় আদর্শে। বিএনপির মানা উচিত ছিল সংরক্ষিত (?) ৩৪ শতাংশ ভোটারের বাইরেও আওয়ামী লীগের প্রতি ততটা ভালোবাসা নেই এমন অনেক ভোটার আছেন, যাঁরা যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদীদের সংস্পর্শের কারণে বিএনপিকে সমর্থন দিতে পারছেন না। আবার প্রত্যক্ষ বন্ধুতা না পেলেও রাজনৈতিক কৌশলের কারণে শেষ পর্যন্ত মৌলবাদীদের সমর্থনও বিএনপির পক্ষে আসার কথা। বিএনপি সম্ভবত এ ধরনের যৌক্তিক রাজনীতির দিকে যেতে পারছে না দলীয় সভানেত্রীর ইচ্ছাকে শিরোধার্য করতে গিয়ে। বেগম জিয়া একসময় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি রক্ষা নিয়ে। বিএনপির ভাবমূর্তি সংকটের যুগে একান্ত ব্যক্তিগত লাভালাভের ব্যাপারে দলীয় ব্যানারে আন্দোলন-প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে পথে নামা বিএনপিকে সমালোচিত করেছিল। খালেদা জিয়ার সাজা পাওয়া পুত্র কোকোকে নিয়ে এবার দেশ-বিদেশে দলীয় প্রতিক্রিয়া জানানো কোনো দূরদর্শী আচরণ ছিল না বিএনপির। বিশেষ করে যেখানে কোকো বিএনপি রাজনীতির কোনো পদাধিকারীও নন। কারণ দেশের সংবিধান জিয়া পরিবারের জন্য ভিন্ন কোনো আইন তৈরি করেনি। তারেক রহমান বিএনপি নেতা। তাঁকে নিয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানানো সাজে। কিন্তু দুর্নীতি, অর্থপাচার বা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কুশীলব হিসেবে তাঁর সংশ্লিষ্টতা আদালতে প্রমাণিত যদি নাও হয়, এই তরুণ নেতার দুর্ভাগ্য অন্ধ বিএনপিকর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষের সামনে তাঁর ক্লিন ইমেজ নেই। বাংলাদেশটা খুব ছোট। জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবন নামে অতি পরিচিত ভবনটিতে কী হতো আমাদের মতো আদার ব্যাপারীরা তা না জানলেও সাধারণ মানুষের কাছে প্রচারিত ছিল_ওটা দুর্নীতির আখড়া আর ষড়যন্ত্রের কাশিমবাজার কুঠি। দেশটি ছোট বলে হাওয়া ভবনের পথ মাড়ানো ভুক্তভোগী বা সুবিধাভোগী মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব বা জানাশোনা যাদের, তাদের মাধ্যমেই হাওয়া ভবনের দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে সাধারণ্যে। মির্জা ফখরুল বা নজরুল ইসলামদের মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিকরা যে সে খবর রাখেন না তা তো নয়। তার পরও মানুষের জন্য নয়, দলীয় সভানেত্রীর সন্তুষ্টি পেতে যখন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে এহেন 'জিয়া পরিবারের' জন্য আন্দোলনের ডাক দেন, তখন তাতে জনসম্পৃক্ততা তৈরি হওয়ার কোনো কারণ থাকে না।
অস্থির বিএনপির আরেকটি সংকট, তারা অসময়ে উপর্যুপরি হরতালের ডাক দিয়ে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। বিএনপি নেতারা বুঝতে চাইছেন না এই শব্দবাণ সাধারণ মানুষের হৃদয়ে না ছুঁয়ে বুমেরাং হয়ে বিএনপিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মানুষ তো বলতেই পারে, বিএনপি নেতারা এখন তো খুব গণতন্ত্র বুঝতে পারছেন। মানুষের ভোটে পাস করে এ দলের সংসদ সদস্যরা যখন ছুতানাতা কারণ দেখিয়ে দিনের পর দিন সংসদ বর্জন করে যাচ্ছেন, তখন কি তাঁরা গণতন্ত্রকে লাঞ্ছিত করছেন না? যা সংসদে বলার কথা তা না বলে রাজপথে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তাঁরা যে গণতন্ত্রকেই বিপন্ন করছেন, সে প্রশ্ন তো মানুষের মধ্যে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে।
বিএনপি নেতারা যখন ৩৬ ঘণ্টা, ৪৮ ঘণ্টা হরতাল ডাকার পরও সরকারকে হুমকি দিয়ে বলেন, সরকার দাবি না মানলে আরো কঠোর আন্দোলন করবেন, তখন মানুষ ভেবে পায় না অসময়ে হরতালের মতো শেষ বুলেটটি খরচ করে তাঁরা আর কোন অস্ত্রে কঠোর আন্দোলন করবেন? না হয় লাগাতার সাত দিন, চৌদ্দ দিন হরতাল দেবেন। কিন্তু গণতন্ত্রের এই বরপুত্র-কন্যাদের বোঝা উচিত, দলীয় অন্ধ সমর্থক দিয়ে নয়, স্বতঃস্ফূর্ত গণসম্পৃক্ততা না থাকলে এবং উপযুক্ত সময় তৈরি না হলে হরতালের মতো অস্ত্রটির প্রয়োগ ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই লাগাতার সাত দিন দূরে থাক, এবারের ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ঢিলেঢালা ভাব কি বিএনপি নেতাদের কাছে কোনো ইঙ্গিত বয়ে আনছে না? এবার সাহস করে মানুষ অনেক গাড়ি বের করেছে। কিছু দোকানও খুলেছে। যেহেতু সাধারণ মানুষ এই অসময়ে হরতালকে গ্রহণ করছে না, তাই এর পরের হরতালগুলোর ভবিষ্যৎ অনুমান করা যাচ্ছে। এই সত্য মানতে হবে যে ৩৬-৪৮ ঘণ্টার হরতাল থেকে বিএনপি কিছু অর্জন করতে পারেনি, শুধু পেরেছে উলুখাগড়া সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করতে। বিএনপি নেতারা যদি কালকেই সিংহাসনে বসার লোভ সংবরণ করে পরশু ক্ষমতায় বসার মতো ধৈর্য ধরতে পারেন, তাহলে বর্তমান সরকার পরিচালকদের উন্নাসিকতা ও অদক্ষ পরিচালনা তাঁদের সে সুযোগ নিশ্চিত এনে দেবে। এই সুযোগে সাধারণ মানুষকে বিপন্ন করে এমন কর্মসূচি বাদ দিয়ে জনসমর্থন নিজের অনুকূলে আনার চেষ্টা করাটাই হবে বিএনপির জন্য করণীয়।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.