সাংবাদিক দম্পতি খুন

রাজধানীতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি। মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি ঢাকার প্রাণকেন্দ্র ফার্মগেট সংলগ্ন পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন।

শুক্রবার দিবাগত গভীর রাতে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে তাদের খুন করা হয়। গতকাল সকালে পুলিশ তাদের হাত-পা বাঁধা রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। সাগরের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারাল অস্ত্রের ২৫টি আঘাত ছিল। তার বুকের বাম পাশে বাঁটবিহীন একটা ছুরির ৮০ ভাগ গেঁথে ছিল। মেহেরুন রুনির শরীরে তিনটি আঘাত করা হয়েছে। এছাড়াও তার পেটের মাঝখানে লম্বা করে কাটা ছিল। এতে তার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি ছুরি ও দু’জনের মোবাইল ফোন উদ্ধার করে পুলিশ। তবে তাদের ৫ বছর বয়সী একমাত্র পুত্রসন্তান মাহীন সারওয়ার মেঘ অক্ষত রয়েছে। এই মেঘই তার নানীকে টেলিফোন করে মা-বাবার মৃত্যুর খবর জানায়। দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ভয়াবহ এ হত্যাকাণ্ড কে বা কারা ঘটিয়েছে তা গতরাত পর্যন্ত উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় বাসার নিরাপত্তা প্রহরী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ুন কবীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। নিহতদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা করে মেহেরুন রুনির ভাই নওজেশ আলম নোমানকে গতকাল দুপুর ২টার সময়ে আটক করা হলেও বিকাল ৪টার দিকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়াও পরিবারের আরও ৪/৫ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে পুলিশ জানায়। ওদিকে ৪ দফা জানাজা শেষে নিহত দুই সাংবাদিককে আজিমপুর কবরস্থানে রাতে দাফন করা হয়েছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে র্যাব ও গোয়েন্দারা জানান, পারিবারিক বিরোধে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে নিহতদের স্বজনরা জানান, সাগর ও রুনির সঙ্গে কারও পারিবারিক বিরোধ আছে বলে তাদের জানা নেই। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডকে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড বলে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করা হলে তারা তা মানবেন না বলেও জানান। নোমানকে ঘটনার পর গোয়েন্দারা আটক করে নেয়ার পর পরিবারের চাপের মুখে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পরে গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, তাকে গ্রেফতার করা হয়নি, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হয়েছিল।
এদিকে সাংবাদিক দম্পতি খুন হওয়ার ঘটনায় গোটা গণমাধ্যম জগতে শোকের ছায়া নেমে আসে। সংবাদকর্মীরা তাদের প্রিয় দুই সহকর্মীকে একসঙ্গে হারিয়ে শোকবিহবল হয়ে পড়েন। মর্গ ও জানাজাস্থলে অনেক সাংবাদিক কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী গতকাল এক বিবৃতিতে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া দুই সাংবাদিকের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সরকারের দুর্বিনীত দুঃশাসনের ফল উল্লেখ করে বলেন, এ ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো দেশে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। সাধারণ মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার ন্যূনতম কোনো নিশ্চয়তা নেই। তিনি হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
একই সঙ্গে দু’জন সহকর্মীর মৃত্যুর খবরে সকাল থেকেই সাংবাদিক মহলসহ এলাকার শত শত মানুষ পশ্চিম রাজাবাজারে ৫৮/এ/২ নম্বর হোল্ডিংয়ের শাহজালাল রশিদ লজের ভাড়া বাসায় (এ/৪ ফ্ল্যাট) ভিড় জমায়। ছয়তলার এই বাসার পঞ্চমতলায় একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন সাগর-রুনি দম্পতি। সহকর্মী ও সিনিয়র সাংবাদিকসহ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকরা বাসায় ছুটে যান। সহকর্মীর এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডে স্তব্ধ ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন সবাই।
র্যাব, সিআইডি, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছেন। তবে কী কারণে এ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে এ বিষয়ে তারা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। গোয়েন্দাদের প্রাথমিক ধারণা, পারিবারিক বিরোধের কারণে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, কি কারণে এ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে তা নিশ্চিত না হলেও পারিবারিক কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। রাজধানীতে নিজ ফ্ল্যাটে দুই সিনিয়র সাংবাদিক খুনের ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ধস নেমেছে কিনা—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব দেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। নৃশংসভাবে সাংবাদিক দম্পতি খুনের ঘটনায় সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তার সঙ্গে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এবং বিশেষ সহকারী (গণমাধ্যম) মাহাবুবুল আলম শাকিল ঘটনাস্থলে গিয়ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের আশ্বাস দেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ অনেকেই খবর পেয়ে ছুটে আসেন। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তারা।
জানা গেছে, তাদের ফ্ল্যাটের প্রধান দরজা অক্ষত এবং ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। খুনিরা ঘটনার পর পালিয়ে গেলেও কেউ দেখেনি। ডাকাতির উদ্দেশে তাদের খুন করেছে নাকি খুন করে ডাকাতির ঘটনা সাজাতে আসবাবপত্র তছনছ করেছে তাও বলতে পারেনি পুলিশ। তবে ল্যাপটপ ও ক্যামেরাসহ মূল্যবান জিনিস ঘরে পাওয়া যাওয়ায় ডাকাতির ঘটনা হিসেবেও দেখা সম্ভব হচ্ছে না।
যেভাবে হত্যাকাণ্ডের খবর জানা যায় : সকাল ৭টার দিকে সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনির ৫ বছর বয়সী ছেলে মাহির সারওয়ার ওরফে মেঘ ঘুম থেকে উঠে তার বাবা-মায়ের শোয়ার ঘরে গিয়ে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পায়। এরপর সে তার মায়ের মোবাইল ফোন দিয়ে তার নানীকে ঘটনা জানায়। সংবাদ পেয়ে মেঘের নানী ও মামারা বাসায় এসে সাগর ও রুনির মৃতদেহ দেখতে পান। সংবাদ পেয়ে শেরেবাংলানগর থানা পুলিশসহ ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। শেরেবাংলানগর থানার ওসি জানান, ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, নিহতদের শোয়ার ঘরের মেঝেতে দু’জনের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। সাগরের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। দু’জনেরই শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। তাদের ঘরের জিনিসপত্র ছিল এলোমেলো, ড্রয়ারগুলো ছিল খোলা। তবে ল্যাপটপ ও ক্যামেরার মতো দামি জিনিসপত্র ঘরেই পাওয়া গেছে। মূল্যবান কিছু খোয়া যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। অবশ্য রান্নাঘরের জানালার একটি গ্রিল কাটা দেখা গেছে।
নিহত সাগর সারওয়ার কয়েক বছর জার্মানির গণমাধ্যম ডয়চে ভ্যালে রেডিওতে কাজ করার পর গত বছরের শুরুতে দেশে ফিরে মাছরাঙায় যোগদান করেন। এর আগে তিনি সংবাদ, দৈনিক যুগান্তর ও ইত্তেফাকেও কাজ করেছেন। তাদের পৈতৃক বাড়ি ঢাকার নবাবপুর রোডে। গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার বেড়ার কাজিরহাটে। সাগর সারওয়ারের বাবার নাম মরহুম মনির হোসেন মণ্ডল। মায়ের নাম সালেহা বেগম। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সাগর সারওয়ার ছিলেন তৃতীয়। তার বড় দু’বোনের নাম মুনমুন ও বুলন।
আর নিহত মেহেরুন রুনির মা রাজাবাজারে তাদের বাসার কাছেই থাকেন। এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার রুনি এর আগে সংবাদ, যুগান্তর ও চ্যানেল আইয়ে কাজ করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে।
পুলিশের ভাষ্য : ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বেনজীর আহমদ বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দু’জন প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বিয়োগান্তক। আমরা গোটা পুলিশ পরিবার এ ঘটনায় গভীর শোকাহত। পুলিশের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবার-পরিজনসহ সবার প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। ঘটনাটি হত্যা, নাকি ডাকাতি—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অল্প সময় আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না। তবে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, যত দ্রুত সম্ভব জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার ইমাম হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ওই বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী পলাশ রুদ্র পালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। সে জানিয়েছে, সাগর শুক্রবার বাসায় ফেরেন রাত ২টার দিকে। এরপর অপরিচিত আর কাউকে সে বাসায় ঢুকতে দেখেনি।
উপ-কমিশনার ইমাম হোসেন বলেন, রান্নাঘরের গ্রিল কাটা থাকায় ১ ফুট ৮ ইঞ্চির মতো ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছে। ওই জায়গা দিয়ে একটা বাচ্চা ভেতরে ঢুকতে পারবে। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রাতে ফেরেন সাগর, বাসায় ছিলেন রুনি : পারিবারিক ও সাগর-রুনির অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাগর সারওয়ার শুক্রবার রাত দেড়টা পর্যন্ত অফিস করেছেন। এরপর তিনি বাসায় ফেরেন। আর মেহেরুন রুনির সকালের শিফটে অফিস থাকায় তিনি সন্ধ্যার পর থেকেই বাসায় ছিলেন। এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান তপু সন্ধ্যা ৭টার দিকে মেহেরুন রুনিকে বাসায় নামিয়ে দেন বলে গতকাল সাংবাদিকদের জানান।
সাগরের সহকর্মী মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রতিবেদক জোবায়ের আহমেদ জানান, রাত দেড়টা পর্যন্ত অফিসেই ছিলেন সাগর। আমারও রাতে ডিউটি ছিল। ১টার পরও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সকালে এ ঘটনা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
হাতে ছুরি-পিস্তল ছিল : পুলিশ জানায়, নিহত দম্পতির ছেলে মেঘ তাদের বলেছে, রাতে তাদের বাসায় ক’জন লোক আসে। এদের মধ্যে দুজনকে সে পিকনিকে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখেছে। এ দুজনকে সে দেখলে চিনতে পারবে। এসময় তার বাবা বাসায় ছিলেন না। রাতে তার মা ওই লোকদের জন্য ডিম ভেজে দেন। তারা বাসায় বসে বিভিন্ন কথা বলেছে।
এদিকে এটিএন বাংলা তাদের প্রতিবেদনে জানায়, মেঘ বলেছে তার মা-বাবার হত্যাকারী (দুর্বৃত্তদের) হাতে ছুরি ছিল, পিস্তল ছিল। শুক্রবার স্কুলের পিকনিক থেকে ফিরে ক্লান্ত থাকায় আগেই নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে মেঘ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবা-মায়ের ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে চিত্কার করে কাঁদে। এরপর সে তার নানিকে ফোন করে জানায়।
সিআইডি আলামত সংগ্রহ করতে পারেনি : হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (২১ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা) আবদুল কাহহার আকন্দ ঘটনাস্থলে যান। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে দাবি করলেও সিআইডির অপর এক সদস্য বলেন ভিন্ন কথা। নাম প্রকাশ না করে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ঘটনা তদন্তের জন্য সিআইডি পুলিশের ৫ সদস্যের একটি দল কাজ করে। কিন্তু ঘণ্টাব্যাপী কাজ করার পরও কোনো আলামত উদ্ধার করতে পারেননি তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, খুনের জায়গাটা আলাদা করে রাখা (কর্ডন) হয়নি। বাড়িতে মানুষের প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি কেউ।
পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ ইচ্ছা থাকার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তাই আমরা বিশেষ কোনো আলামত পাইনি। সিআইডি কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, দুই সাংবাদিককে খুন করা হয়েছে। আমরা নিশ্চিত হয়েছি একাধিক ব্যক্তি এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বাড়ির এক জায়গায় ৮ ইঞ্চির মতো গ্রিল কাটা আছে। তবে এখান থেকে কোনো মানুষের বের হয়ে যাওয়া বা প্রবেশ কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয় বলে মন্তব্য ওই সিআইডি কর্মকর্তার।
পুরুষ কণ্ঠে কান্নার শব্দ : ওই বাসার ভাড়াটিয়া সমিতির সভাপতি চারতলার বাসিন্দা নুরন্নবী জানান, ভোর ৫টা-সাড়ে ৫টার দিকে ফজরের নামাজের জন্য উঠলে পুরুষ কণ্ঠে কান্নার শব্দ পাই। পরে নিরাপত্তা কর্মীকে জানালে সে ঘুরে এসে বলে পাশের বাসা থেকে শব্দ আসছে।
আটক নিরাপত্তাকর্মী পলাশ জানিয়েছে, ফজরের আজানের কিছু আগে সমিতির সভাপতি নুরন্নবী আমাকে ফোন করে বলেন, এখানে কোথাও কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে, খোঁজ নিয়ে দেখ। আমি ওপরে উঠে ঘটনাস্থলের আশপাশে দুবার চাপা কণ্ঠে কান্নার শব্দ পাই। এরপর আর কিছু শুনতে পাইনি। এর কিছু পর ফজরের আজান হয়।
ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের বক্তব্য : সাগর-রুনির পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হামিদা সুলতানা জানান, রুনিদের বাসায় শুক্রবার সন্ধ্যার পর কথাবার্তার শব্দ শুনে তার ধারণা হয়েছিল বাসায় মেহমান এসেছে। তবে ভবনের গেটে নিরাপত্তারক্ষীদের লগবুকে শুক্রবার কোনো অতিথি আসার তথ্য পাওয়া যায়নি।
ষষ্ঠতলার বাসিন্দা তাজমিন তানিয়া সাংবাদিকদের বলেন, সকাল ৮টার দিকে তার ছেলে কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হলে নিচে নিরাপত্তাকর্মী জানায়, পুলিশ না এলে যাওয়া যাবে না। তখন তিনি নিচে নেমে খুন হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন।
তিনি আরও জানান, বাসার ছাদের গেট রাত ৮টার দিকে তালাবদ্ধ করা হয়। এছাড়া নিচের গেটে নাম-ঠিকানা না লিখে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না।
ডিআরইউ প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের ঢল, আজিমপুরে দাফন : নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী মেহেরুন রুনির লাশ বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) প্রাঙ্গণে নেয়া হলে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় তাদের অনেক সহকর্মী কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে তাদের প্রথম জানাজা হয়। বিকাল চারটায় অনুষ্ঠিত এ জানাজায় সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদদের ঢল নেমেছিল। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দিয়ে সহকর্মীদ্বয়কে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়।
ডিআরইউর এ জানাজায় অংশ নেন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, সিনিয়র সহসভাপতি নুরুল আমিন রোকন, সিনিয়র সহকারী মহাসচিব এম আবদুল্লাহ, বিএফইউজের আরেক অংশের মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সিনিয়র সহসভাপতি কাজী রওনাক হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক কাদের গনি চৌধুরী, ডিআরইউ সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা এবং সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম চৌধুরীসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সংবাদকর্মীরা।
জানাজা শেষে জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী জানাজা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, সাংবাদিক হত্যা যেন এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। তিনি অবিলম্বে মেহেরুন রুনি এবং সারওয়ারের হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, যেভাবে সাংবাদিক হত্যা চলছে এই অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। দোষীদের শাস্তি দেয়া না হলে গোটা বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
এরপর মরদেহ দুটি নেয়া হয় মাছরাঙা টেলিভিশন প্রাঙ্গণে। সেখানে তাদের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মরদেহের পাশে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে পুরো মাছরাঙা পরিবার। সহকর্মীদের সবাই সাগর ও রুনির মরদেহের পাশে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মেহেরুন রুনির কর্মস্থল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলা প্রাঙ্গণে সাগর-রুনির তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এটিএন বাংলা পরিবারসহ কারওয়ানবাজার এলাকায় অবস্থিত সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা এই জানাজায় অংশ নেন।
জানাজার পর সাংবাদিক দম্পতির মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এটিএনের চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমান, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক এবং কারওয়ানবাজারে অবস্থিত সব মিডিয়া হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংবাদকর্মীরা।
এখান থেকে তাদের মরদেহ রাজধানীর পান্থপথের বৌবাজারে রুনির বাবার বাড়িতে নেয়া হয়। এ সময় সাংবাদিক দম্পতিকে একনজর দেখার জন্য স্থানীয় জনগণের ঢল নামে। বৌবাজারে রুনির খালা মিসেস ইমদাদ হোসেনের বাসায় কিছুক্ষণ সাংবাদিক দম্পতির লাশ রাখা হয়। এ সময় রুনির বৃদ্ধ মা নুরুন্নাহার বেগমসহ নিকটাত্মীয়দের বুকফাটা কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। এরপর তাদের মরদেহ নেয়া হয় সাগরের পৈতৃক নিবাস পুরনো ঢাকার নবাবপুরে। এখানে আরেকদফা জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়।
সাগরের গ্রামের বাড়িতে শোকের ছায়া : সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি শুক্রবার রাতে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হওয়ার পর সাগর সারওয়ারের পৈতৃক ঠিকানা পাবনার ছোট নওগাঁ কাজীরহাট গ্রামেও শোকের ছায়া নেমেছে। স্বজনরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। তারা মেনে নিতে পারছেন না সাগর দম্পতির এই মর্মান্তিক মৃত্যু। বাড়িতে থমথমে অবস্থার মধ্যে সবাই নিশ্চুপ। কৃতী সন্তানের মৃত্যুতে শোকে আচ্ছন্ন গোটা গ্রাম। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আত্মীয়-স্বজনরা ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় তাদের চোখ নিবদ্ধ করে রেখেছেন। সাগরের মৃত্যু-পরবর্তী খবর দেখা ও জানার জন্য তাদের মনে আকুতি। আলাপকালে তারা জানান, অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজন শনিবার সকালে মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরপরই ঢাকায় চলে গেছেন।
সাগর সারওয়ারের বড় চাচা হারুন অর রশিদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সকাল ৮টার দিকে আমি পাবনায় যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হই। এমন সময় আমার ছেলে কায়েম উদ্দিন মোবাইলে আমাকে সাগর ও তার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর জানায়। তখন আমরা সবাই টেলিভিশন অন করে খবরটি দেখি। তিনি জানান, সাগর ও তার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর জানার পরপরই তার চাচাতো ভাই, ভাতিজা, ভাগ্নেসহ অন্যরা ঢাকায় চলে যায়।
সাগরের চাচাতো ভগ্নিপতি নুরুল হক ফকির বলেন, অনেকদিন সাগরকে দেখিনি। এখন টিভির পর্দায় দেখছি। তবে জীবিত দেখতে পারলাম না। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে তার ছোট্ট শিশুটির কথা ভেবে। এ কষ্ট বলে বোঝানোর মতো নয়।
সাংবাদিকদের প্রতীকী কর্মবিরতি : সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার এবং মেহেরুন রুনির হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা প্রতীকী কর্মবিরতি পালন করেছেন। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে প্রেস ক্লাবের মূল ফটকের সামনে প্রায় ১৫ মিনিটের জন্য তারা প্রতীকী কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রায় অর্ধশত সাংবাদিকরা এতে অংশ নেন।
মুষড়ে পড়েছেন সাংবাদিকরা : শুক্রবার গভীর রাতে ঘটে যাওয়া রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি স্তব্ধ করে দিয়েছে সবাইকে। সাংবাদিক পরিবারের বন্ধুরা মুষড়ে পড়েছেন। এর কোনো সান্ত্বনা নেই কারও কাছেই। আছে সীমাহীন কষ্ট আর গভীর বেদনা। মর্মান্তিক এ ঘটনায় সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেন, আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও স্নেহভাজন ছিলেন মেহেরুন রুনি ও সাগর সারওয়ার। সদা হাসিখুশি থাকা এ দুটি মানুষের মৃত্যু আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। এটা অকল্পনীয় একটি ঘটনা। এ ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। হত্যাকারীদের অবিলম্বে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের প্রশাসনকে।
বিএফইউজের সিনিয়র সহকারী মহাসচিব এম আবদুল্লাহ বলেন, সাগর ও রুনি দুজনের সঙ্গে জ্বালানি বিটে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ হয়েছে। দুজনই খুব বন্ধুবত্সল। ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্সে একই কমিটিতে দায়িত্ব পালনের সুবাদে তাদের সঙ্গে অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল আমার। দুজনই খুবই প্রাণবন্ত ও সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। কোনো অহঙ্কার ছিল না। অত্যন্ত প্রতিভাবান এ দুই সংবাদকর্মীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে গোটা সাংবাদিক সমাজ শোকবিহ্বল ও বিক্ষুব্ধ। খুনিদের খুঁজে বের করার গতানুগতিক সরকারি আশ্বাসেই যাতে সীমাবদ্ধ না থাকে, সেটাই আমরা দেখতে চাই।
ডিইউজের সাবেক সভাপতি আলতাফ মাহমুদ বলেন, এ খবর শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়েছি। কী করব, কী বলব—কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। এ শোক ভোলার নয়। মেধাবী এ দুজনকে হারিয়ে আমাদের দিশেহারা হওয়ার মতো অবস্থা।
প্রতিবাদ সমাবেশ : আজ বেলা ১১টায় প্রেস ক্লাবের সামনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিএফইউজে এবং ডিইউজের যৌথ মানববন্ধন এবং প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে সর্বস্তরের সাংবাদিকদের উপস্থিতি কামনা করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.