সারা দেশে শোকের ছায়া-দুর্ঘটনা রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি

ওরা সবাই ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। জীবনের শুরুতেই ঝরে গেল ৪৮টি তাজা প্রাণ। ফুটবল ম্যাচে জেতার আনন্দ মুহূর্তেই থেমে গেল। উল্লাসধ্বনি রূপ নিল বুকফাটা আর্তনাদে। চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ের ঘরে ঘরে এখন কেবলই দুঃসহ শোকের হৃদয়বিদারক মাতম চলছে। আর সেই শোক স্পর্শ করেছে সারা দেশকেই।


কিন্তু কেন? কিছু মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে কেন আমাদের বারবার এমনভাবে শোকের সাগরে ভাসতে হবে? কেন প্রশাসন এসবের প্রতিকারে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না?
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়তাকিয়া বাজারের কাছে শিক্ষার্থীদের বহন করা মিনি ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে উল্টে পড়ে যায়। এতে ৪৮ শিক্ষার্থী তাৎক্ষণিকভাবে মারা যায় এবং ১৫ জন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ট্রাকটি চালিয়েছিলেন চালকের হেলপার। তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্সও ছিল না। তদুপরি দুর্ঘটনার সময় তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এই দৃশ্যটি আমাদের অতিচেনা। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ হলেও গাড়ির চালকরা তা মোটেও মানছেন না। আর তা মানানোর দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরাও বিশেষ কারণে দৃশ্যটি দেখেও না দেখার ভান করেন। ফলে পথচারীকে চাপা দেওয়া, অন্য গাড়িকে ধাক্কা দেওয়া_এসব অহরহ ঘটে চলেছে। বিভিন্ন সময় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, অর্ধেকেরও বেশি গাড়ি চালকের কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই। যাঁদের লাইসেন্স আছে তাঁদেরও প্রায় ৮০ শতাংশ অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে চালক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়নি। কোনো একজন চালকের কাছ থেকে কোনো রকমে স্টিয়ারিং ধরা শিখতে পারলেই অর্থের বিনিময়ে তাঁরা লাইসেন্স পেয়ে যান। গাড়ি চালানোর অন্য সব নিয়ম-কানুন সম্পর্কেও তাঁদের কোনো ধারণা নেই। এমনকি রাস্তার সব সংকেতও এঁরা চেনেন না। ফলে এঁদের হাতে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তুলে দেওয়া, আর মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া সমান কথা হলেও প্রক্রিয়াটি অব্যাহত আছে। এ ছাড়া বেপরোয়াভাবে অথবা প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানোও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ, যা হরহামেশাই রাস্তাঘাটে দেখা যায়। রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী গাড়িও অর্থের বিনিময়ে 'ফিটনেস সার্টিফিকেট' পেয়ে যায় এবং সহজেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়।
বাংলাদেশে অত্যধিক সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় যে কারণ, তা হলো দুর্বল আইন, আইনের প্রয়োগ ও যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা। ফলে গাড়িচালকরা নিয়ম-কানুনের পরোয়া করে না এবং সড়ক দুর্ঘটনাকে কোনো বিষয় বলেও মনে করে না। এই চট্টগ্রামেই ২০০৩ সালে আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনায় ১১ জন কিশোর ক্রিকেটারের মৃত্যু হয়েছিল। তখনো শোকে কেঁদেছিল চট্টগ্রাম। কিছুদিন আগে সেই মামলাটির রায় হয়েছে। যে দ্রুতগামী হিউম্যান হলারের ধাক্কায় সেদিন এত তাজা প্রাণ ঝরে গিয়েছিল, সেই চালকের মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। তার ওপর সেই চালককে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা যায়নি। হয়তো ভিন্ন নাম নিয়ে আর কোথাও সে মানুষ মারার প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে।
মিরেরসরাইয়ের ঘটনায় গাড়ির মালিক, প্রকৃত চালক এবং যে হেলপার গাড়ি চালাচ্ছিল_তিনজনকেই বিচারের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। এরা কেন এবং কিভাবে হেলপারকে গাড়ি চালাতে দিয়েছিল, তা জেনে সেভাবেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর রাস্তায় গাড়ি চলাচলের সঙ্গে যেহেতু বহু মানুষের জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারটি জড়িত, তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেসব গাফিলতি রয়েছে সেগুলো যেকোনো মূল্যেই হোক দূর করতে হবে। গাড়ির ফিটনেস এবং চালকের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি চলা উচিত নয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যাতে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ভুয়া লাইসেন্সধারী চালককে ধরে টাকা নিয়ে ছেড়ে দিলে দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনগুলো সংশোধন করে ভুয়া চালক, নিয়ম না মানা এবং বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি চালকের দোষে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু হলে তাকে হত্যা হিসেবে গণ্য করে এর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.