চরাচর-'হাতের মুঠোয় হাজার বছর আমরা চলেছি সামনে' by একরামুল হক লিকু

বাউলসংগীত শতসহস্র বছর ধরে প্রবহমান বাঙালি এবং এ ভূখণ্ডের মানুষের মনে অসাম্প্রদায়িক জীবন বোধের জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে সুরের মূর্ছনায় উজ্জীবিত করেছে পরতে পরতে। এরই ধারাবাহিকতায় গোটা পৃথিবীর মানচিত্রে স্বতন্ত্রভাবে আমাদের লোকজ সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ।


ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে বাউল গান সৃষ্টি করেছে অসংখ্য লোকগাথা, মঞ্চায়িত হয়েছে বাঙালির হাজার বছরের মঞ্চে শৈল্পিক উপস্থাপনার মাধ্যমে। আর আমরা ধারাবাহিক এই প্রজন্মের উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও শেকড়কে অনেক ক্ষেত্রেই মূল্যায়ন করি না অথবা সস্তা আবেগের উন্মাদনায় বিভ্রান্ত হই, নয় তো লজ্জিত হই ইতিহাসের এ সাংস্কৃতিক মৌলিক উপাদানকে ধারণ করার। একজন বাঙালি যত শুদ্ধ ইংরেজি শিখে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াক না কেন, সে কখনোই প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না সে বাঙালি নয়। কারণ প্রকৃতির সোধা গন্ধ তাকে কখনোই বাঙালি ভিন্ন কিছু হতে দেবে না। এ নিরেট শুদ্ধ, সত্যকে জেনেও আমরা বারবার জীবন বোধে ছেদ ঘটাই। তার পরও কিছু মানুষ যাঁরা প্রকৃতির রূপরস আর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হন বা যুগের প্রয়োজনে সৃষ্টি হতে হন, তাঁরা নিভৃতেই তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন নিভৃতচারীর মতো আপন খেয়ালে। কী নেই আমাদের, আর কী ছিল না। ব-দ্বীপের অভ্যন্তরে হাজার বছর ধরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যে ভাণ্ডার লুকায়িত তার সম্পূর্ণ পরিসংখ্যানটাও আমাদের জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, লালন, হাছন, মুকুন্দ দাস, পাগলা কানাইসহ অসংখ্য মহাপুরুষ জন্মেছেন, সৃষ্টি করেছেন যা মহীরুহ হয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে করেছেন সমৃদ্ধ, প্রসারিত। আমাদের সভ্যতা, মূল্যবোধ বিকশিত হয়েছে তাঁদের সৃষ্টিশীল শৈল্পিক উপস্থাপনায়। আমরা তো সেই মানুষ, যে শ্রমিক কাজ শেষে ঘরে ফেরে, যে কৃষক গান গায় জীবনের গান, আমরা তো তাঁদেরই সন্তান। আমরা পথ চলছি বাংলা নাটক সামনে নিয়ে, আর এ জনপদে সুন্দরের চারণভূমি গড়ার প্রত্যয় নিয়ে, অনন্ত নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে। আর সে প্রয়াসের অংশ হিসেবে 'হাতের মুঠোয় হাজার বছর, আমরা চলেছি সামনে' হৃদয়ে বসবাস করা জীবন বোধের স্লোগানকে ধারণ করে আমরা গিয়েছিলাম ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে। ছবির মতো সুন্দর, প্রকৃতি সব রূপ ঢেলে দিয়েছে এই গ্রামটিতে। যেখানে ঘুমিয়ে আছেন লোক ঐতিহ্যের সাধক পুরুষ লালন শাহের গুরু সিরাজ শাহ্, তাঁর সহসাধক পাঞ্জু শাহ্, দুদ্দু শাহ্, হিরু শাহ্, মনির উদ্দিন শাহ্সহ আরো অনেকে। লালনের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, শৈশব, যৌবনের স্মৃতিবিজড়িত তীর্থভূমি। বাড়ির কাছে 'আরশিনগর' লালনের জনপ্রিয় গানের আরশিনগর গ্রাম আছে; কিন্তু লালন নেই। অসংখ্য স্মৃতি এবং লোক ঐতিহ্যের পবিত্র ভূমি 'হরিশপুর' অবহেলায়, অভিমানে লুকিয়ে রেখেছে নিজেকে। আজ সময় এসেছে আর একবার ঘুরে দাঁড়ানোর। লালন গুরু সিরাজ শাহ্সহ তাঁর অন্যান্য অনুসারী_যাঁরা হরিশপুরের পবিত্র মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন, তাঁদের অসংখ্য কীর্তিগাঁথা তুলে আনা দরকার। আর এ কাজ করার ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে সৃজনশীল মানুষের প্রয়োজন। অন্যথায় আকাশপথের সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কখনোই প্রতিহত করা সম্ভব হবে না। যদি না আমরা প্রতিদিন বুকে একবার হাত দিয়ে বলি আমরা বাঙালি।
একরামুল হক লিকু

No comments

Powered by Blogger.