প্রকল্পের গাড়ি-নিখোঁজ গাড়িগুলোর খোঁজ মিলুক

কথায় আছে, কাজীর গরুর অস্তিত্ব শুধু কেতাবে। অর্থাৎ কাগজপত্রে গরুর অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে তার দেখা মেলে না। কাজীর গরু বাস্তবে আছে, অথচ কাগজপত্রে নেই এমন ঘটনা নিশ্চয় সবাইকে বিস্মিত করবে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়ি নিয়ে এমন উল্টো ঘটনাই ঘটে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে।


সরকারি কোনো প্রকল্প বা উন্নয়ন কার্যক্রমের শুরুতে কাজের প্রয়োজনে যানবাহন কেনা হয়। সাধারণত এসব যানবাহন কেনার টাকা আসে সরকারি কোষাগার বা দাতা সংস্থার বরাদ্দ থেকে। গাড়ি কেনার পর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, এক সময় শেষও হয়। কিন্তু কেনা গাড়ি আর সরকারের হিসাবের খাতায় ফিরে আসে না। খবর মেলে, প্রকল্পের সেই নিখোঁজ গাড়িগুলো সরকারের টাকায় চলছে, পদস্থ ব্যক্তিদের পরিবহন করছে। কিন্তু হিসাব চাইতে গেলেই আর কাগজপত্র মেলে না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি উদ্যোগ নিয়েছে নিখোঁজ গাড়িগুলোর হিসাব মেলানোর। হিসাব মেলেনি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও বেখবর। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো হিসাব দিতে পারেনি বা দেয়নি। কাগজপত্রে নেই অথচ বহাল তবিয়তে থাকা এ গাড়িগুলো ব্যবহার করছেন সরকারি কর্মকর্তারা। নিয়ম অনুসারে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর গাড়িগুলো পরিবহন পুলে ফেরত আসার কথা। কিন্তু পদস্থ কর্মকর্তারা নিয়ম না মেনেই গাড়িগুলো ব্যবহার করে চলেছেন। অবৈধভাবে ব্যবহৃত গাড়ির সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি। ২০০৫ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি বৈঠকে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকল্পের অন্তত ২৬ হাজার ৩৪৮টি গাড়ি পরিবহন পুলের হিসাবের বাইরে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ অনিয়মটি চলছে বহুদিন ধরে। বিভিন্ন সরকারের আমলে নিখোঁজ গাড়িগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হলেও ফেরত আসেনি। হিসাব মেলানোর চেষ্টা হলে, কিছু গাড়ি নামকাওয়াস্তে জমা পড়ে। জমা পড়া গাড়ির অধিকাংশই মোটরসাইকেল। আর দামি গাড়িগুলোর অধিকাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। জমা পড়া গাড়িগুলোকে অকেজো ঘোষণার পর বিক্রি করে দেওয়া হয়। বলাবাহুল্য, প্রকল্পের গাড়িগুলোর অপব্যবহারের জন্য মূলত সরকারি কর্মকর্তারাই দায়ী। সাধারণ নিয়মে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় গাড়ি বরাদ্দ থাকার কথা। প্রশাসনিক কাজের স্বার্থেই সেটা দরকার। প্রশ্ন হলো, বরাদ্দ গাড়ির বাইরে অতিরিক্ত গাড়ির প্রয়োজন হবে কেন? কিংবা যে গাড়ি প্রাপ্য নয়, নিয়ম না মেনে তা ব্যবহৃত হবে কেন? সরকারি কর্মকর্তাদের কাছেই দায়িত্বশীলতা ও নিয়মানুবর্তিতা সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করা হয়। নাগরিকরা তাদের মাধ্যমেই আইন-কানুনের সঙ্গে পরিচিত হয়। কর্মকর্তাদের মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি নাগরিকদেরও দুর্নীতিতে উৎসাহিত করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো প্রশাসনে কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা থাকতে পারেন, তার নৈতিক স্খলন ঘটতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে কোনো অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়ার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। অথচ প্রকল্পের গাড়ির ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটছে। সরকারের উচিত, গাড়িগুলো দ্রুত নথিবদ্ধ করা এবং পরিবহন পুলের আওতায় ফিরিয়ে আনা। কর্মকর্তাদের যদি গাড়ির প্রয়োজন হয় তবে নিয়ম মেনেই সেটি দেওয়া হোক। অনিয়ম করে তারা সেটি ব্যবহার করবেন কেন? এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদেরও সচেতন হতে হবে। গাড়ির অপব্যবহারের মাধ্যমে দেশের যে বিপুল সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে তা রোধ করতে উদ্যোগী হতে হবে এখনই।

No comments

Powered by Blogger.