সময়ের প্রতিধ্বনি-ট্রানজিট ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন by মোস্তফা কামাল

ইদানীং দুই দেশের মধ্যে যেকোনো পর্যায়ে আলোচনা শুরু হলেই ট্রানজিট ইস্যুটি কোনো না কোনোভাবে চলে আসে। এ বিষয়টি আগে আলোচ্যসূচিতে না থাকলেও এখন ভারত এ বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে। আর বাংলাদেশ পক্ষের আগ্রহ তিস্তা নদীর পানিবণ্টন, সীমানা এবং সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ চুক্তি স্বাক্ষরসহ বাংলাদেশের প্রধান প্রধান পণ্যসামগ্রী যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।


তবে সরকারের একটি অংশ এখনই ভারতকে ট্রানজিট দিতে প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো তাঁরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এড়িয়ে এক পা ভারতের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন। অথচ তাঁরা নিজেরাও জানেন, ভারত আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কোনো কিছুই সে দেশের সাউথ ব্লকের (পররাষ্ট্র দপ্তর) অনুমোদন ছাড়া করতে পারে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটানোর প্রবণতা অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। কখনো কখনো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অন্ধকারে রেখে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এতে সমন্বয়ের অভাব প্রকটভাবে দেখা দেয়। এতে সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর সমস্যা সৃষ্টি হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই তখন এগিয়ে আসতে হয়। আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে সব সময়ই সরকারের উচিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া। এটা না করলে কখনো কখনো সরকারকে বিব্রত হতে হবে।
যাহোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এখন ভারতের লক্ষ্য, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্যসামগ্রী পাঠানো। এ অঞ্চলটি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে পশ্চাৎপদ। এই সুযোগই নিচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তাদের এ তৎপরতা বন্ধ করতে সাতটি রাজ্যের উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই ভারত বাংলাদেশের সহায়তায় বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা অনেকটাই স্তিমিত করতে সক্ষম হয়েছে। এখন ওই অঞ্চলের উন্নয়নের দিকে নজর দিতে চাচ্ছে। এ জন্য ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব বিবেচনা করেই ক্ষমতাসীন কংগ্রেস জোটের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী ২৫ জুলাই ঢাকায় আসছেন। সেপ্টেম্বরে আসছেন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ওই সফরে ট্রানজিট চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে ভারত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে।
এর আগে গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ও বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। যৌথ ইশতেহারেও পরস্পরের স্বার্থে দুই দেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের কথা বলা হয়। প্রথম দিকে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থে ট্রানজিট দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলেও শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ পক্ষ অত্যন্ত কৌশলে নেপাল ও ভুটানকে সম্পৃক্ত করে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, আঞ্চলিক ভিত্তিতে ট্রানজিট হলে বাংলাদেশের আপত্তি নেই। এ বক্তব্যের কারণে বাংলাদেশে তেমন উত্তাপ ছড়ায়নি। তবে বিএনপি তখন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, শেখ হাসিনা সরকার যৌথ ইশতেহারে সই করে দেশ বিকিয়ে দিয়ে এসেছে।
এরপর এক বছর এসব ইস্যু নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। কারণ ভারত বাংলাদেশকে বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আটকে যায়। সংগত কারণেই দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব ইস্যু চাপা পড়ে যায়। গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাও ঢাকা সফরে এসে জানালেন, তিস্তার পানিবণ্টন এবং সীমানা চিহ্নিতকরণে দুটি চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে দুই পক্ষ একমত হয়েছে। এ দুটি ইস্যুই বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। এ ছাড়া বাংলাদেশি প্রধান প্রধান পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে ভারত রাজি হলে এবং উপরোক্ত চুক্তি দুটি সই করার পর ভারত ট্রানজিটের প্রস্তাব দিলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে। তবে তার আগে আমাদের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি শেষ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কাছে কিছু বিআইডিএস এবং এডিবির জরিপ রিপোর্ট রয়েছে। এগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দল, নাগরিকসমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং সামরিক ও বেসামরিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে। তাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ট্রানজিটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
ট্রানজিটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সব মহলকে সম্পৃক্ত করলে অযথা বিতর্ক এড়ানো সম্ভব। তাতে সাধারণ মানুষের সন্দেহ-সংশয় দূর করা সম্ভব হবে। বড় প্রতিবেশী ভারতের ব্যাপারে ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশি নাগরিকদের এক ধরনের ভয়ভীতি কাজ করে। এটা অস্বাভাবিক নয়। নেপালেও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারতের ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় আছে। ভারতবিরোধিতাও প্রবলভাবে লক্ষ করা গেছে। আমাদের এখানেও পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি আছে। বিরোধী পক্ষকে আস্থায় নিয়ে কাজ করতে পারলে উভয় দেশই লাভবান হবে। ভারতের ব্যাপারে যে ভয়ভীতি রয়েছে, তা দূর করতে হবে ভারতকেই।
ঢাকায় সফরে এসে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি অকপটেই বলেছেন, ভারতকে নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। বহুল আলোচিত ট্রানজিট ইস্যুতে তিনি অত্যন্ত ইতিবাচক উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, কেবল শান্তিপূর্ণ কাজেই ট্রানজিট ব্যবহার করা হবে। তিনি বাংলাদেশি জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে ট্রানজিটের সুফল পেতে হলে বাংলাদেশকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। (কালের কণ্ঠ, ৯ জুলাই ২০১১)
গত বছরের নভেম্বরে ট্রানজিট ইস্যু নিয়ে আমি কালের কণ্ঠে আরেকটি লেখা লিখেছিলাম। তারই কিছু অংশ এখানে পুনরুল্লেখ করছি। আমরা জানি, ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে এখনো বন্ধ রয়েছে। তখন দুই দেশের স্থলবন্দর ব্যবহার করে পণ্য আদান-প্রদান হতো। নৌ-ট্রানজিট তো পাকিস্তান আমল থেকেই চালু ছিল। এখনো কিছু কিছু জায়গায় যেমন_শাহবাজপুর থেকে আসামের মহিষাসন পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার এবং আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার লাইন বসিয়ে দুই দেশের মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপন করা যায়।
বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, দুই দেশের মধ্যে শুধু রেল ট্রানজিট চালু হলে বাংলাদেশ এখনই পরিবহন ভাড়া, পোর্ট চার্জ ও ট্রানজিট ফি বাবদ বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। পাঁচ বছর পর এই আয়ের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়নে দাঁড়াবে। তবে এই হিসাবকে ভিত্তি ধরে অগ্রসর হলে চলবে না, সরকারি পর্যায়ে ট্রানজিটের লাভালাভ খতিয়ে দেখতে হবে। সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ যদি ট্রানজিটের বিনিময়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়, তাহলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে অবশ্যই দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল, নাগরিকসমাজের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শুধু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যই নয়, নেপাল ও ভুটানকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এই তিন দেশই বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট ব্যবহারের সুযোগ চায়। আবার বাংলাদেশও নেপাল ও ভুটানে পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য ভারতের কাছে ট্রানজিট সুবিধা চায়। আঞ্চলিক ভিত্তিতে ট্রানজিট হলে বাংলাদেশের আপত্তি থাকার কথা নয়। বর্তমান সরকারও আঞ্চলিক ভিত্তিতেই ভারতকে ট্রানজিট দিতে আগ্রহী। দ্বিপক্ষীয় ট্রানজিটের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি বলেই জানি। দেশের জনমত যদি ট্রানজিটের বিপক্ষে হয়, সে ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। আমরা আশা করি, সরকার দেশের মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেবে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে আরেকটি জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরছি। এডিবির এক জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশ ট্রানজিট ব্যবহারের সুবিধা দিলে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব পাবে। চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর প্রতিবেশী দেশকে ব্যবহারের সুযোগও দিতে হবে। ভারত, নেপাল ও ভুটানের পণ্যবাহী কনটেইনার বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পরিবহনের কারণে শুল্ক হিসেবে এই অর্থ পাবে। তবে এ জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। তবে বিআইডিএসের জরিপে বলা হয়, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ ৪০০ কোটি টাকা পাবে। কোন জরিপটি সঠিক সে বিতর্কে না গিয়ে এটা স্পষ্ট করে বলা যায়, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট ব্যবহারের সুযোগ দিলে বাংলাদেশ লাভবানই হবে। তার পরও বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপির বিরোধিতার কারণ কী?
বিএনপি এবং কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, ট্রানজিট দিলে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত পণ্য পরিবহনের নামে অস্ত্র পরিবহন করবে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। কারণ ট্রানজিট সুবিধা দিলে ভারতীয় পরিবহনে কী পরিবহন করা হচ্ছে, তা দেখার কোনো সুযোগ থাকবে না। ট্রাক কিংবা লরিগুলো থাকবে সিলগালা।
বিশেষজ্ঞদের আরেকটি যুক্তি রয়েছে। তাঁরা বলছেন, ভারী যানবাহন যাতায়াতের জন্য বাংলাদেশের সড়কগুলো প্রস্তুত নয়। ট্রানজিটের মতো সিদ্ধান্ত নিতে হলে আগে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। এ জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার। তা ছাড়া ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে কী কী সুবিধা দেবে, তা জানাতে হবে। চুক্তিটিও জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।
সাধারণত প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশই অন্য দেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি সংসদে উপস্থাপন করে থাকে। আমাদের দেশেও সেই রেওয়াজ চালু রয়েছে। নিশ্চয়ই ট্রানজিট-সংক্রান্ত কোনো চুক্তি হলে তা জাতীয় সংসদের মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। তবে চুক্তির আগেই ট্রানজিট ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হবে। সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের মতামত ছাড়া সরকার এককভাবে ট্রানজিটের সিদ্ধান্ত নিলে সরকারের জন্য তা গলার কাঁটা হতে পারে। আমরা আশা করব, সরকার এ ক্ষেত্রে আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও দেশের মানুষের স্বার্থ, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.