নিত্যজাতম্‌-মমতা-অভিজিতের শিষ্টাচার ও বাংলাদেশের পেছন ফিরে চলা by মহসীন হাবিব

এই দেশের মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কাঁটাতারের বেড়া ছাড়া পশ্চিম বাংলার মানুষের বিশেষ কোনো নৃতাত্তি্বক পার্থক্য নেই। একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, একই গায়ের রং। একই মাছ-ভাত, শাক, একই ইলিশ মাছের নেশা। একই পারিবারিক জীবনব্যবস্থা।


কিন্তু শুক্রবার ওই বাংলায় যে শুভ সূচনা আমরা দেখলাম, তা এই বাংলায় ঘটাতে মোট কত জেনারেশন লাগবে, বলা মুশকিল। কিছুদিন আগে পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। ভারতের সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রাণপুরুষ জ্যোতি বসুর দল সিপিআইএম এখন আর ক্ষমতায় নেই। নির্বাচনে হেরে গিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসেছে। দীর্ঘ ৩৪ বছরের সিপিআইএমের শাসনের অনেক দুর্বলতার, অনেক ব্যর্থতার কথা গলা ফাটিয়ে জনগণকে বলে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী পশ্চিম বাংলার মানুষের জন্য নতুন স্বপ্নকে মাটিতে টেনে নামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী এবং পশ্চিম বাংলার নয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারই এক নজির দেখালেন তিনি শুক্রবার। প্রয়াত সিপিআইএম নেতা জ্যোতি বসুর জন্মদিন প্রথমবারের মতো পালন হলো তৃণমূল সরকারের আমলে। মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী দল সিপিআইএমের প্রয়াত নেতার ছবিতে মাল্যদান করলেন অকৃত্রিম শ্রদ্ধায়। ক্ষমতা গ্রহণ করে মমতা বলেছিলেন, 'আমরা-ওরা'র ব্যবধান রাখবে না তাঁর সরকার। সেটাই যেন কাজে প্রমাণ করলেন তিনি। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে বিধানসভায় জ্যোতি বসুর তৈলচিত্রে মাল্যদান করেছেন সব দলের বিধায়ক। তৈরি হয়েছিল একটি মিলনমেলা। বিরোধী দল সিপিআইএম প্রধানমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জ্যোতি বসুর ছবিতে মালা দেওয়ায় অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানিয়েছে। আমাদের দেশের মতোই অসংখ্য অশিক্ষিত মানুষের বসবাস ওই বাংলায়। কিন্তু মমতা ভয় পাননি যে জ্যোতি বসু তাঁর চেয়ে বড় হয়ে যেতে পারেন। মমতা ভালো করেই জানেন, মানুষ ভোট দিয়ে সিপিআইএমকে তথা সিপিআইএমের পাণ্ডাদের প্রত্যাখ্যান করেছে, জ্যোতি বসুকে নয়। তাই জ্যোতি বসুকে শ্রদ্ধা জানাতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি তিনি।
এত গেল ঘরের ভেতরের একেবারে খাঁটি বাঙালি আরেকটি জনপদের কথা। এবার অন্য প্রতিবেশীর কথায় আসি। দেশটির নাম থাইল্যান্ড। বাংলায় যাকে আমরা ডাকি শ্যামদেশ বলে। বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে ফল থেকে শুরু করে চুলের শ্যাম্পু, গায়ের সাবানটাও ওই দেশ থেকে আমদানি হতে দেখি। এই থাইল্যান্ডেই অতি সম্প্রতি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ইংলাক সিনাওয়াত্রা। তিনি থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিলিওনিয়ার থাকসিন সিনাওয়াত্রার বোন। নিজেরা ধনী হলেও সিনাওয়াত্রার পুয়ে পার্টির মূল সমর্থক কিন্তু থাইল্যান্ডের দরিদ্র সাধারণ। যা হোক, পুয়ে পার্টির নির্বাচনে জয়ের পর পরই থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী অভিজিৎ ভিজ্জাজিভা ইংলাককে অভিনন্দন জানালেন।
তার মানে কি এই দুই পরিচিত জনপদের রাজনীতি রাতারাতি পাল্টে গেছে? হঠাৎ করে তারা গণতন্ত্রের চোখে সভ্য জাতিতে পরিণত হয়েছে? না। এই গত বছরও থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে তৃণমূলের নীরব দখল চলছে। সিপিআইএম এবং তৃণমূল_দুই দল পরস্পরের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগও তুলছে। এসব রাজনৈতিক কালচার এক দিনে বা এক বছরে সমাজ থেকে বা দেশ থেকে মুছে ফেলার নয়। কিন্তু রাজনৈতিক শিষ্টচার কী হওয়া উচিত, সেটি অন্তত শুরু করতে পেরেছেন মমতা ও অভিজিৎ ভিজ্জাজিভা। বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে মমতার এ পুষ্পমাল্য থেকে কম-বেশি সুগন্ধ ছড়াবেই। অভিজিতের থাইল্যান্ড অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত সামনের দিকে ধাবমান। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও আসলে থাইল্যান্ড একটি ঈর্ষণীয় দেশ হয়ে উঠবে অনেক জাতির কাছে। সেই স্থিতিশীলতারই একটি সূচনা করেছেন অভিজিৎ। তাঁর অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা থাইল্যান্ডের নির্বাচনের ফলের ব্যাপারে নাক গলাবে না। প্রধানমন্ত্রী অভিজিৎ যেখানে অভিনন্দন জানান, সেখানে সেনাবাহিনীর সুযোগ কোথায় নাক গালানোর?
শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, আমার বিশ্বাস, যেকোনো পরিবেশে এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে ডেকে আনে; একটি হিংসা আরেকটি হিংসাকে ডেকে আনে। মানুষ হলো আয়নার মতো। আপনি যেমন চেহারা আয়নায় দেখাবেন, তেমনটিই দেখতে পাবেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিপক্বতার কারণে কয়েকটি বিষয় অনুপস্থিত। দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের ধারণা, কোনোভাবে তাদের মুখ থেকে অন্য দলের প্রশংসা বের হলে সেই সার্টিফিকেটের কারণে দেশের সব মানুষ বিপক্ষ দলটিকে সমর্থন দিয়ে দেবে। নিজেকে বড় করার প্রধান শর্ত যে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো, এ সাধারণ হিসাবটিও কোনো রাজনৈতিক দল মানে না। বিগত দিনে আমরা দেখেছি, নিশ্চিতভাবে আগামী দিনেও দেখব, ক্ষমতার পালাবদলে দলগুলো কয়েকটি কাজ করে আসছে, যা দেশের সচেতন মানুষকে প্রথমেই হতাশ করে তোলে। নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগেই, পরাজয়ের আভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিং করে বলে দেন, এ নির্বাচন মানি না। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। অর্থাৎ একটি বিরোধী দল যদি নির্বাচনকেই স্বীকার না করে, তাহলে তো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা চিন্তাই করা যায় না। অন্যদিকে যে দল জয়লাভ করে, তারা কোনো রকমে ক্ষমতা গ্রহণ করেই প্রথম কয়েকটি কাজ শুরু করে, যা অতিহাস্যকর। আটার কল, মুদি দোকান থেকে শুরু করে রাস্তা, ব্রিজ সব কিছুর নাম পাল্টে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতার নামে নতুন নামকরণ শুরু করে। অথচ তারা বোঝে না যে ওভাবে নাম টিকিয়ে রাখা যায় না। নামটি ব্রিজ বা রাস্তাসর্বস্ব হয়ে যায়। আমেরিকায় কয়টি কাঠামো আব্রাহাম লিংকনের নামে? দক্ষিণ আফ্রিকায় কয়টি স্থান নেলসন ম্যানডেলার নামে? ভারতে কত জায়গা মহাত্মা গান্ধীর নামে?
এই নষ্ট সংস্কৃতি দূরে ঠেলে দিতে যেকোনো এক পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। দেখবেন অন্য পক্ষ অবশ্যই বাধ্য হয়েছে শিষ্টাচার প্রদর্শনে। ঠিক যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিপিআইএম 'অকুণ্ঠ ধন্যবাদ' জানাতে বাধ্য হয়েছে।
পুনশ্চ : গণমাধ্যমে প্রকাশিত জয়নুল আবদিন ফারুকের কয়েকটি বিষয় কিন্তু ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। একটি হলো, তিনি সুর করে অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইছিলেন 'সব শালারা ভাইসা যাবে বঙ্গোপসাগরে।' দ্বিতীয়টি হলো, তিনি নিজে ঢিল ছুড়ে মারছেন এবং তৃতীয়টি হলো, তিনি পুলিশ অফিসারকে 'তুই' সম্বোধন করছেন। তাঁর নিজের অবস্থানের সঙ্গে এই তিনটি কাজই সম্পূর্ণ বেমানান ছিল। নিশ্চয়ই রাজনৈতিক আন্দোলনে সংসদের বিরোধীদলীয় হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এবং রাস্তার পিকেটারের ভূমিকা এক নয়। তবে অতিউৎসাহী পুলিশ তাঁকে প্রহার করে অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারকে খুশি করাই যে তাদের লক্ষ্য ছিল, সে কথা সবার মুখে মুখে ফিরছে।
এ ঘটনা দেখে পাকিস্তানের সেই স্বৈরশাসনের সময়ের একটি কথা মনে পড়ল (নিজে দেখিনি, ইতিহাস পড়ে জেনেছি)। ১৯৬৯ সালে মওলানা ভাসানী ছিলেন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি লাহোর থেকে করাচি যাওয়ার সময় বর্বর শাসকদের পাণ্ডারা শাহিওয়াল রেলস্টেশনে তাঁর ওপর হামলা চালায়। ৮৬ বছর বয়স্ক নেতাকে রেলওয়ের কম্পার্টমেন্ট থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে ফেলে সেই পাষণ্ডরা। তিনি শরীরের বেশ কয়েকটি স্থানে আঘাত পান। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, মওলানা মুলতান স্টেশনে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে এ ঘটনায় সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। এই ধরনের বিশৃঙ্খলাকে তিনি পাত্তা দেননি। মওলানার কাছে তাঁর শরীর বা ওই পাণ্ডারা ফ্যাক্টর ছিল না, ফ্যাক্টর ছিল দেশের স্বৈরশাসন। আহারে, কোথায় হারিয়ে গেলেন তাঁরা আমাদের পঙ্কিল রাজনীতির মাঠে ফেলে রেখে?

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.