দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা : চোখের মণি কি কেউ দেখতে পায়? by শহিদুল ইসলাম

এক. ২৬ জুন ২০১১ দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার তৃতীয় দফার সম্পূরক চার্জশিট জমা দেওয়া হয়। সেই চার্জশিটে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর, জামায়াতে ইসলামীর আমির ও জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফার কর্তা পরেশ বড়ুয়াসহ নতুন করে আরো ১১ জন আসামির নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।


সেখানে আরো জাঁদরেল সরকারি আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তারাও আছেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, ৩ জুলাই ২০১১ তার নতুন সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। সেখানে নতুন করে আরো ৩০ জন আসামি জালে ধরা পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তখনকার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে, হাওয়া ভবনের সর্বেসর্বা তারেক রহমান, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বেগম জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ বিএনপির সংসদ সদস্য, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালকসহ সমাজের মোট ৩০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাঁদের সবার নাম ৪ জুলাইয়ের কাগজেই পাবেন। ওই সব ভিআইপি আজ ২১ আগস্ট বোমা হামলার আসামি ভাবতেই কষ্ট হয় এবং সেই সঙ্গে খারাপ লাগে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী, এই চিন্তা করে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের বোমা হামলায় আওয়ামী লীগের নেত্রী ও আমাদের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন এবং শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হন। অনেকে পঙ্গুত্ব নিয়ে আজও সেদিনের ঘটনার সাক্ষী। আশ্চর্যের বিষয়, তৎকালীন জোট সরকারের সেদিনের রহস্যজনক কথাবার্তায় পেছনের সত্য আজ প্রমাণ হলো। ঘটনার চার বছর পর সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন প্রথম অভিযোগপত্রটি জমা দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট বর্তমান সরকার অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। গ্রেনেড হামলার সাত বছর এবং অধিকতর তদন্তের আদেশ দেওয়ার দুই বছর পর সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হলো। সম্পূরক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে তদন্তের স্বার্থে ১৪ বার সময় নেয় সিআইডি। মোট সাক্ষীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯১। মামলায় ৬৯ ধরনের আলামত জব্দ করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে ঘটনাটি ঘটলেও তারা ওই গ্রেনেড হামলাকে ভিন্ন খাতে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছিল। দশ ট্রাক অস্ত্র পাচার মামলায় তারা আসল গডফাদারদের বাঁচানোর জন্য জাহাজঘাটের কুলি-শ্রমিক-মাঝিমাল্লাদের আসামি করেছিল। আর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তারা কোথাকার এক জজ মিয়াকে হাজির করে টাকা ও ভয় দেখিয়ে তাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল। কিন্তু এত বড় পাপ কাজ মানুষের সহ্যের বাইরে। কালের কণ্ঠের ৪ জুলাই সংখ্যায় বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে অন্য যারা অভিযুক্ত 'তদন্ত ভিন্নখাতে' নেওয়ার অভিযোগ ছিল, অধিকতর তদন্তে যা পাওয়া গেছে শিরোনামে সব খবরই ছাপা হয়েছে। এর পরও কারো কিছু জানার থাকলে তা অবশ্যই খোঁজ করলে জানা যাবে। এটা খুবই দুঃখজনক, কর্তাব্যক্তিরা যদি অন্যায় করে থাকেন, তাহলে সে অন্যায়ের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপানো আরেকটি অন্যায়।
দুই.
খবরে আরো প্রকাশ, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয় হাওয়া ভবনে। এর কোনো প্রতিবাদ বা এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত আদালতে কোনো মামলা রুজু করা হয়নি। ওই দিন সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় তারেক রহমানের ছবির নিচেই বড় করে বিএনপির সংবাদ সম্মেলনের খবর ছাপা হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, তাঁরা যে আশঙ্কা করেছিলেন তা-ই সত্য প্রমাণিত হলো। জিয়াউর রহমানের পরিবার ও বিরোধী দল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তারেক রহমানকে মিথ্যা ও সাজানো মামলায় আসামি করা হয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কথা কী করে বলেন! দীর্ঘ সাত বছর ধরে বহু তদন্তের পর সিআইডি তাদের অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে তারা যাঁদের নাম করেছে, তাঁরাই ওই গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যুক্ত। এ অভিযোগ আদালতে গড়াবে। সেখানে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর জানা যাবে, সিআইডির ওই অভিযোগনামা মিথ্যা, নাকি সত্য। ওই অভিযোগপত্রের ভিত্তি এখনই যদি কেউ ধরে নেয় যে তারেক-বাবররাই প্রকৃত অপরাধী, সেটা যেমন ভুল হবে, তেমনি এখনই যদি কেউ দাবি করেন যে তাঁরা নির্দোষ ও মিথ্যা আক্রোশের শিকার, সেটাও সমান ভুল হবে। বাবর দীর্ঘদিন ধরে জেলহাজতে আছেন, তাঁর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, হয়তো আরো নেওয়া হবে। তারেক রহমানও দীর্ঘদিন দেশের বাইরে। যদি ওই প্রতিবেদন মিথ্যা হয়, সেটা তো তারেকের চেয়ে আর কেউ ভালো জানেন না। তাহলে তিনি দেশের বাইরে কেন? তাঁর উচিত হবে দেশে এসে আইনের আশ্রয় নিয়ে ওই অভিযোগপত্রকে চ্যালেঞ্জ করা। তিনি যদি এভাবে দেশের বাইরে থাকেন, তাহলে যত দিন যাবে, ততই দেশের মানুষের মনে ওই অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে চিন্তা সুদৃঢ় হবে।
তিন.
গত ৩ জুলাই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে জনরোষের সম্মুখীন। এখন জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে ফেরানোর অপকৌশলের মাধ্যমে জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এটা একটা মহাসমস্যার বিষয়। বিএনপি যদি আদাজল খেয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আর সংসদ অধিবেশনে যাবে না, তাহলে সরকার কি বুড়ো আঙুল মুখে ঢুকিয়ে সংসদ ভবনের ঠাণ্ডা হাওয়া খাবে? কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না? কোনো কাজকর্ম করবে না? বিএনপি কি সেটাই চায়? বরং বিএনপিকে যারা ভোট দিয়েছে, জাতীয় সংসদ বর্জন করার জন্য তারা ভোট দেয়নি। সংসদ ভবনে গিয়ে সংসদ অধিবেশনে বসে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিটি ভুলভ্রান্তি, গণবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে তাদের ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে। বিএনপি জনগণের সে ম্যান্ডেটের প্রতি সুবিচার করছে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে বিভিন্ন বিষয়ে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, বিএনপি সংসদে না গিয়ে, কোনো কথা না বলে তাদের চেয়েও বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা পল্টনে তাদের অফিসের সামনে কিংবা অন্য কোনোখানে 'জনগণের স্বার্থে' যেসব প্রস্তাব করছে, তার কোনো রেকর্ড থাকছে না সংসদ ধারাবর্ণনায়। তাদের কথা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, বিএনপি আজও সংসদীয় গণতন্ত্রের মাজেজাই বুঝে উঠতে পারেনি। পারলে তারা এ রকম ক্রমাগত সংসদ অধিবেশন বর্জন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিত না।
চার.
কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসী ঘটনার বিচার না করা বিএনপির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। তারা শেখ মুজিবসহ তাঁর পরিবারের ১৭ সদস্যের হত্যার বিচার করেনি। বরং অবৈধভাবে সে বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। বিএনপি জেলহত্যা মামলার বিচার করেনি। এমনকি বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান হত্যার বিচারের কথা একবারও মুখে আনেনি। অথচ তাঁর স্ত্রী ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিএনপি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার করেনি। বিএনপি দশ ট্রাক অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশের বিচার করেনি। বিএনপির নেতা-নেত্রীরা চারদিকে কেবল ষড়যন্ত্রের জাল দেখেন। বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের যদি দশ ট্রাক মামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি প্রমাণ হয়, তাহলে প্রমাণ হবে কেন তিনি খুনি ও অস্ত্র চোরাচালানিদের চোখে দেখেননি। তিনি প্রায়ই বলতেন, 'উই আর লুকিং ফর সন্ত্রাসী', কিন্তু সন্ত্রাসীদের তিনি দেখতে পেতেন না। কেন? রবীন্দ্রনাথের গানের একটি কলি উদ্ধৃত করে লেখাটি শেষ করব।
'নয়ন সম্মুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই-'
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.