জ্বালানিতে নয়, গরিবের জন্য খাদ্যে ভর্তুকি দিন by জাহিন হাসান

'ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম'-এ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, দুর্ভিক্ষকে সরলভাবে কম খাদ্য উৎপাদনের ফলাফল হিসেবে দেখাটা সঠিক নয়। দুর্ভিক্ষ তখনই ঘটে, যখন গরিবের বাজারমূল্যে খাদ্য কিনে খাওয়ার মতো আয়ের সংস্থান থাকে না। ড. সেন ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষকে একটা গ্রামীণ দুর্ভিক্ষ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।


ব্রিটিশের যুদ্ধকালীন ব্যয়ের কারণে কলকাতা শহরে আয় বেড়েছিল; আর শহরের লোকেরা তাদের বর্ধিত আয়ের একটা বড় অংশ খাদ্যে বিনিয়োগ করায় বেড়েছিল খাদ্যের দাম। গ্রামের লোকের আয় ছিল স্থির। ফলে বর্ধিত দামের খাদ্য কিনতে না পেরে তারা না খেয়ে মারা যাচ্ছিল। একইভাবে ১৮৪০-এর দশকে আয়ারল্যান্ডে দুর্ভিক্ষের সময়ও দুর্ভিক্ষপীড়িত আয়ারল্যান্ড থেকে খাদ্য রপ্তানি হচ্ছিল খেয়েদেয়ে মোটাতাজা হওয়া ইংল্যান্ডে; ইংল্যান্ডের ধনী ভোক্তাদের ক্রয়ের চাপে আয়ারল্যান্ডের ভুখা জনগণের নাগালের বাইরে খাদ্যের দাম না যাওয়া পর্যন্ত তা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
কয়েক দশক ধরেই আমাদের সরকারগুলো খাদ্যের দাম স্থির করে দেওয়ার মাধ্যমে চেষ্টা করে যাচ্ছে দাম নিয়ন্ত্রণের। প্রথাগত ধারণা হলো, খাদ্যের দাম কম রাখতে হবে, যাতে গরিব মানুষ খাদ্য পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়, তা হলো, সব গরিবই একই নৌকায় সওয়ার নয়। শহরের গরিব মানুষরা_যেমন কারখানার মজুর, রিকশাওয়ালা, দিনমজুর_খাদ্যের কম মূল্য মারফত লাভবান হয়। কিন্তু গ্রাম এলাকায় বেশির ভাগ লোক যুক্ত খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে। খাদ্যের বর্ধিত মূল্যের অর্থ সেখানে অনুমিত হয় গ্রামীণ গরিবদের বেশি কাজ এবং অধিক মজুরি হিসেবে। জমির মালিক-কৃষকরা বর্ধিত দামে তাদের ফসল বিক্রি করতে পারলে ভূমিহীন দরিদ্র প্রতিবেশীকেই নিয়োগ করে নতুন বাড়ি, মুরগির খামার কিংবা শস্য মজুদ ব্যবস্থার জন্য। যদিও সরকারি নজরদারির অভাবে এই বর্ধিত মূল্যের সুফল অনেকটাই কেড়ে নিয়ে যায় গ্রাম-শহরের মধ্যস্বত্বভোগীরা। বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই জনসংখ্যা বাড়ছে, আর কমছে কৃষিনির্ভর জমির পরিমাণ। প্রতিবছরই কৃষিজমি শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে শহর সম্প্রসারণের কাজে চলে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের মেনে নিতেই হবে, ভবিষ্যতে আমাদের বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি করতে হবে। শুধু আমাদের জন্যই নয়, একই কথা সত্য ভারত এবং চীনের ক্ষেত্রেও। কেননা তাদেরও জনসংখ্যা বাড়ছে, জনসাধারণের আয় বাড়ছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে অধিক খাদ্যের চাহিদা। ভবিষ্যতে গরিব বাংলাদেশিরা বিশ্ববাজারে খাদ্য কেনার জন্য প্রতিযোগিতা করবে অপেক্ষাকৃত ধনী ভারতীয় বা চীনাদের সঙ্গে। আমাদের সরকার তখন খাদ্যের দাম কম রাখার কৌশল জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হবে। ভারত-চীন যে দামে খাদ্য কিনছে, সেই দাম না দিয়ে আমরা খাদ্যই কিনতে পারব না।
ঘটনা এ রকম ঘটলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী লাভবান হবে। খাদ্যের অধিক মূল্যের ফলে গ্রামে কাজের সুযোগ ও আয় বাড়বে, যদিও শহরের গরিবদের ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য দেওয়া না গেলে তারা দিন কাটাবে অনাহারে। বাংলাদেশের দরিদ্রতম তিন কোটি মানুষের জন্য প্রতিদিন ২০০ গ্রাম চালের জন্য দাম পড়বে প্রতি বছর সাত হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বাজার মূল্য ৩৫ টাকা কেজি দরে)। ভাগ্যক্রমে সরকার তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ভারতের সমান পর্যন্ত বাড়িয়ে এর সমপরিমাণ বা এর চেয়েও বেশি টাকা তুলতে পারে। জ্বালানির অধিক মূল্য একই সঙ্গে জ্বালানি সাশ্রয় এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিকেও উৎসাহিত করবে। অনেক নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প (যেমন বড় আকারের বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট) ভারত বা চীনে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হলেও বাংলাদেশে অতিশয় কম জ্বালানি মূল্যের কারণে তা নয়। জ্বালানির কম মূল্যের মাধ্যমে সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। কেউ কেউ যুক্তি দেন, শিল্পায়নের জন্য জ্বালানির কম মূল্য প্রয়োজনীয়। সে ক্ষেত্রে জ্বালানির সুনির্দিষ্ট ব্যবহারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন হাসপাতাল ও কারখানার জন্য মূল্য এবং শপিং সেন্টার ও প্রাইভেট কারের জন্য জ্বালানি মূল্য আলাদা হতে পারে। আবার রপ্তানি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সত্যিকারের সামর্থ্য নিহিত সস্তা জ্বালানিতে নয়, বরং সস্তা শ্রমে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রতিবছর জ্বালানির দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়িয়ে তার রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং এই রাজস্ব গরিবের খাদ্যে ভর্তুকি দিতে ব্যবহার করা_আমি এই নীতি প্রস্তাব করি। এমন ভবিষ্যতের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, যেখানে খাদ্যের দাম বাড়বে। আমাদের এমন কোনো ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে গরিব মানুষকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য দেওয়া যায়। যেসব দেশ এটা করতে ব্যর্থ হবে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি।
লেখক : গবেষক ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র

No comments

Powered by Blogger.