জনসংখ্যাই প্রধান সমস্যা-সম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে

বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা কত? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ১৫ কোটি। অন্যদিকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার মতে, ১৬ কোটির ওপরে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়েও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। এমনি অবস্থায় গতকাল সোমবার সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও উদ্যাপিত হলো বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস-২০১১।


এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল, '৭০০ কোটি মানুষের বিশ্ব : পরিকল্পিত পরিবার, দেশ গড়ার অঙ্গীকার'। কিন্তু বাংলাদেশ কি এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করছে?
বাংলাদেশ একটি ছোট্ট ভূখণ্ড। অথচ এর রয়েছে বিপুল জনসংখ্যা। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার যেখানে প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল, সেখানে দিন দিনই তা কমছে। বাল্যবিবাহ এখনো রোধ করা যায়নি। এখনো বাংলাদেশে বিয়ের গড় বয়স ১৬ দশমিক ৪ বছর। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের ৬২ শতাংশই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতাও অনেকাংশে দায়ী। ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ দম্পতির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তাদের পরিবারকল্যাণ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, পরিবারকল্যাণ সহকারী বা মাঠকর্মীরা এখন আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০২৫ সালে মধ্যে ২০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ কি পারবে সেই বিপুল জনসংখ্যার বোঝা বইতে?
শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধিই নয়, কর্মসংস্থান এবং বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। তাদের মধ্যে রাজধানীমুখী স্রোতই সবচেয়ে বেশি, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কয়েক গুণ। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অনেক এলাকা এখনই চাষাবাদ ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ফলে যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে, তা কি ভাবা যায়! কাজ ও খাদ্য সংকট যে পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছবে এবং পরিবেশের যে বিপর্যয় ঘটবে, তাতে সব ধরনের শৃঙ্খলাই ভেঙে পড়বে। সেই অবস্থা মোকাবিলার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তা কি আমরা নিচ্ছি? জবাব একটাই_না। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করা গেলে সক্ষম তরুণ-যুবকরা বিদেশে গিয়ে কর্মসংস্থান করতে পারত। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আমাদের অগ্রগতি প্রায় নেই বললেই চলে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যা আগামী অক্টোবরে ৭০০ কোটিতে পেঁৗছবে। ২০১০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এর ৬০ দশমিক ৭ শতাংশই বসবাস করে এশিয়া মহাদেশে। বৃদ্ধির হারও এখানেই বেশি। বাংলাদেশও একই পথের পথিক। উন্নত দেশগুলো যেখানে তাদের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে চিন্তিত, সেখানে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ঘটছে তার উল্টোটা। ১৯৯৫ সালে যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ, সেখানে ২০০৫ সালে সেই হার দাঁড়িয়েছিল ২ দশমিক ১-এ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রেক্ষাপটে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। অর্থনৈতিকভাবে যাঁরা সক্ষম, অর্থাৎ যাঁরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষিত এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম, তাঁরা কিন্তু অধিক সন্তান নিচ্ছেন না। যাঁরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষিত করা তো দূরের কথা, তাদের মুখে ঠিকমতো আহার জোগাতে পারবেন কি না সেই অনিশ্চয়তা রয়েছে, তাঁরাই বেশি সন্তান নিচ্ছেন। ফলে সুনাগরিক তৈরির প্রেক্ষাপট থেকেও দেশে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থা তৈরি হচ্ছে। এর জন্য দায়ী মূলত সরকারের অবহেলা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং মাঠপর্যায়ে পরিবারকল্যাণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন মুখ থুবড়ে পড়া। এ বিষয়ে প্রচার এবং উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
বর্ধিত জনসংখ্যার এই বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সঠিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে অতি দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে হবে। উপকূলীয় এলাকায় মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় মানুষের জানমাল রক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধান নদ-নদীর অববাহিকায় থাকা মানুষ এবং তাদের আবাদি জমিকে বন্যা, খরা ও নদীভাঙন থেকে রক্ষা করতে হবে। সর্বোপরি, জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করার সর্বতো প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করতে হবে। তাহলেই কেবল উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে চলা সম্ভব হবে। অন্যথায় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকেই কেবল এগিয়ে যাব আমরা।

No comments

Powered by Blogger.