ভারত-টু-জি কেলেঙ্কারি নাটক by কুলদীপ নায়ার

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল আছে: দুটোই জনপ্রিয়। দুটোরই নাটকীয় অংশটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তা আবেগময় পারিবারিক পরিস্থিতিকে আরও আবেগময় করে তোলে। গাছের ভিড়ে মানুষ বন দেখতে পায় না।


দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল টেলিফোন বা টু-জির লাইসেন্স কেলেঙ্কারি, যার ফলে ভারতের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ক্ষতি হয়েছে এক লাখ ৮৬ হাজার কোটি রুপি, সেই মামলা নিয়ে দুটি রায় ঘোষণার পর ভারতের অবস্থা সেই রকম—টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটকের মতো। টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ রাজার প্রস্থানের পর তাঁর উত্তরসূরি কপিল সিব্বাল মন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই হিসাব করে বলেছিলেন, রাষ্ট্রীয় কোষের ক্ষতির পরিমাণ শূন্য।
মামলাটির প্রথম রায়ে সুপ্রিম কোর্ট ১২২টি মোবাইল টেলিফোন লাইসেন্স বাতিল করেছেন, যেগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছিল ‘মর্জিমাফিক ও অবৈধভাবে’। দ্বিতীয় রায়ে একটি বিচারিক আদালত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি আবেদন খারিজ করে দেন। ওই আবেদনে অভিযোগ করা হয়েছিল, লাইসেন্সগুলো বরাদ্দের ক্ষেত্রে চিদাম্বরমের হাত ছিল। (অবিশ্বাস্যভাবে, চিদাম্বরমকে নির্দোষ বলেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও, যাঁর একমাত্র যোগ্যতা এই যে তিনি কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কন্যা।)
সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন এবং দায় চাপিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের ওপর, কারণ তাঁরা সে সময়ের টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ রাজার ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেননি। তাঁরা তখন প্রধানমন্ত্রীকে এ রাজার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানিয়েছিলেন যে ওই মন্ত্রী মোবাইল টেলিফোন লাইসেন্স বরাদ্দের ক্ষেত্রে ‘আগে এলে আগে পাবে’ নীতি অনুসরণ করছিলেন, যেটা ২০০১ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এসে প্রথম শুরু করেছিল। অন্য মামলায় বিচারিক আদালত বলেছেন, চিদাম্বরম যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন মোবাইল টেলিফোন লাইসেন্স সম্পর্কে জানতেন, এমনকি ভারতীয় ক্রেতাদের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশীদারি দেওয়ার অনুমতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু এই কারণেই চিদাম্বরমকে ‘ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত’ করা চলে না।
উভয় আদালতের সামনে যদিও ভিন্ন ভিন্ন রকমের শুনানি হয়েছে, তবু উভয় আদালতের মতামতই সঠিক। তবু এই সত্যের কোনো নড়চড় হচ্ছে না, রাষ্ট্রীয় কোষাগার বিপুল অঙ্কের অর্থ হারিয়েছে। উভয় আদালত কাউকেই দোষী করতে পারেননি; কারণ, কেউই দোষী নয় বলে তাঁদের মনে হয়েছে। কিন্তু তৎকালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ রাজা কীভাবে মোবাইল টেলিফোন লাইসেন্সগুলো বিতরণ করছিলেন, তা এ দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির জানা ছিল। নৈতিক দায়িত্বকেই যদি মানদণ্ড মনে করা হয়, তাহলে ‘আগে এলে আগে পাবে’ নীতির প্রচলন করেছিল যে বিজেপি সরকার, এবং তারপর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন এনপিএ জোট সরকার—উভয় সরকারকেই দায়ী করতে হয়। সত্য যে, সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রীর কোনো দোষ দেখতে পাননি, বরং মন্ত্রী এ রাজার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁকে অবহিত না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও উপদেষ্টাদের দায়ী করেছেন। কিন্তু জনগণের দৃষ্টিতে বিজেপি, এবং বিশেষভাবে কংগ্রেস দায়ী।
উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে কংগ্রেসের ওপর জনগণের এই ধারণার নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়বে; তার জয়ের সুযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেখানে বিজেপির তেমন সাড়াশব্দ নেই, সুতরাং টেলিকমিউনিকেশন কেলেঙ্কারিতে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু অকংগ্রেসীয় দলগুলো এই সুবাদে কংগ্রেস দল ও কেন্দ্রে তাদের সরকারের নিন্দা-সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠার একটা সুযোগ পেয়ে গেছে। আর এই পরিস্থিতিকে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কাজে ব্যবহারের সম্পূর্ণ সুযোগ নিতে চাইবে বিজেপি, যে দলটি ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের বিকল্প হিসেবে হাজির করে। দুই প্রধান দলের মধ্যকার বৈরিতার ফল দেশের জন্য ভালো হতে পারে না; কারণ, এতে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। উভয় দলের উপলব্ধি করা উচিত যে দেশের সামনে অনেক সমস্যা। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, আইনগত ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি ভারত।
১২২টি মোবাইল টেলিফোনের লাইসেন্স বাতিল করার ফলে ভারতের ব্যাপারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যেতে পারে। তাদের অনেকে, যেমন নরওয়ে ও রাশিয়া এ দেশে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে না সুপ্রিম কোর্ট কিছু বলেছেন, না কিছু বলেছে সরকার। টেলিযোগাযোগ খাত ভারতের অন্যতম সাফল্যময় খাত। বিপুল পরিমাণ বিদেশি পুঁজি আকর্ষণ করেছে এই খাত; এক দশকের মধ্যে মোবাইল টেলিফোন গ্রাহকের সংখ্যা ৪০ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৪ কোটি।
সরকারকে নিজের ব্যবস্থা পরিষ্কার করতে হবে। সেটা করতে দীর্ঘ সময় লাগবে—মনমোহন সিংয়ের এই বক্তব্যে আশার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীর জন্য এটি একটি সুযোগ, এক নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে জাতির সামনে হাজির হওয়ার, যে মন্ত্রিসভায় কোনো কালিমালিপ্ত মুখ থাকবে না, যাদের থাকবে না কোনো সন্দেহজনক পরিচিতি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অসহায়। সবাই জানে, তিনি নিজে নিজের প্রভু নন। তবু, যদি তিনি তাঁর ক্ষয়ে যাওয়া ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে চান, তবে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার এখনই সময়।
এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, যিনি বিশ্বাস করেন টেলিযোগাযোগ খাতে কী ঘটছিল, তা প্রধানমন্ত্রী জানতেন না। গোয়েন্দা ব্যুরো ও রয়ের দুই প্রধান কার্যত প্রতিদিনই বৈঠক করেন। এ রাজার কীর্তিকলাপ তাঁরা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনতেন।
কিন্তু রাজাকে সে সময় কেন থামানো হয়নি বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি, তা স্পষ্ট। মনমোহন সিংয়ের সরকারে তিনি ছিলেন তামিলনাড়ুর ডিএমকে দলের প্রতিনিধি, লোকসভায় যাঁদের সদস্যসংখ্যা ১৬। সরকারের ক্ষমতায় থাকার জন্য এই আসনগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এক সময় স্বীকার করেছিলেন যে করা উচিত নয় এমন কাজ করা, আর করা উচিত এমন কাজ এড়িয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনার মধ্য দিয়েই জোট সরকারের ‘জোটধর্ম’ টিকে আছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকে সরকারের অন্তত একটি শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বেসরকারি খাতে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘আগে এলে আগে পাবে’ নীতিটা বাতিল করা উচিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাকে সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতে এক ধরনের হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের গুরুত্বটাই আসল কথা, নয়াদিল্লির উচিত নয় সেটা স্পর্শ করা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.