মতামত-শিক্ষার জাতীয় বাজেট বনাম পারিবারিক বাজেট

শিক্ষাব্যয়ের কতটা সরকার দেবে আর কতটা রাষ্ট্র দেবে সেই প্রশ্নই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তুলেছিলেন। তাদের দাবি আপাতত মেনে নেওয়ার মাধ্যমে সমস্যাটার আপাত সমাধান হয়েছে বটে, কিন্তু প্রশ্নটার কোনো স্থায়ী সমাধান হয়েছে কি?


শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে পরিবারের ওপরে এর ভার চাপিয়ে শিক্ষার দায় রাষ্ট্র এড়াচ্ছে। এর ফলে পারিবারিক বাজেটের ওপর যে অসম্ভব, অবাস্তব এবং অযৌক্তিক চাপ, তার বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা সবার জন্য অবারিত করে দেওয়া উচিত, নাকি কেবল সেরা ছাত্রছাত্রীদেরই উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়, সেই প্রশ্নের সুরাহা করা জরুরি। কিন্তু এই প্রশ্নকে সামনে ঝুলিয়ে বিদ্যমান শিক্ষাকাঠামো ও সুযোগকে সংকুচিত করা, তাকে বড়লোকের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে আমাদের ঘোর আপত্তি আছে।
এই বজ্রপাত বিনা মেঘে নয়। মেঘে মেঘে বহুদিন ধরেই প্রাইভেট সেক্টরে সেবা খাতগুলো একে একে ছেড়ে দেওয়ার নিও লিবারেল অর্থনৈতিক নীতির বাস্তবায়ন চলছে বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি নির্দেশিত ‘উন্নয়নের লক্ষ্য’ অর্জনের অংশ হিসেবেই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত ক্রমেই বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রণীত উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্রে তারই পরামর্শ। এবার তার ফলাফল ভোগের পালা শুরু হয়েছে। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত পুরোনো স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাব্যয়ের দায়িত্ব ক্রমেই পরিবারের বাজেট থেকে টানতে শুরু করেছে।
সামাজিক খাতগুলোতে সরকারি ব্যয় ক্রমহ্রাসমান করে তোলা এবং সেবা খাতগুলোকে প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিই ও এর অনুসৃত নীতিমালাই বিদ্যমান সংকটের কারণ। সরকারের অদল-বদলে এর মূল জায়গাটাতে তেমন কিছু উনিশ-বিশ হয় না। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার ক্রমেই পারিবারিক ব্যয় ব্যবস্থাপনার হাতে ছেড়ে দেওয়াই এই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। রাষ্ট্র ক্রমেই এই ব্যয়-ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এই প্রবণতা তিন-চার দশক ধরে রাষ্ট্রের সঙ্গে ছাত্রসমাজকে একটি মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে রাখছে। শিক্ষা এখন সব অর্থেই বিদ্যা-কারখানার একটি মহার্ঘ পণ্য এবং উপার্জনের পুঁজি, যা ভাত-রুটি-তরকারির সঙ্গে সন্তানদের হাতে বাবা-মাকে গায়ের রক্ত পানি করে তুলে দিতে হচ্ছে।
বছরের পর বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে গবেষণার জন্য উল্লেখ করার মতো কোনো বরাদ্দ থাকে না। ফলে হাভাতে বাজেটে অপুষ্ট শিশুর স্ফীত উদরের মতো বড় হয়ে দেখা দেয় বেতন-ভাতার খাত। আর তখনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠেঙানোর জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষজন ও কিছু মিডিয়া তারস্বরে বলতে থাকে, গেল গেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব টাকা মাস্টার-কর্মচারীদের পেটে গেল। কী স্ববিরোধিতা! বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যা-কারখানার নিজস্ব আয় বলতে নীতি-নির্ধারকেরা কী বোঝাতে চান, সেটাও স্পষ্ট নয়। শিক্ষা ও গবেষণাই এর প্রধান উৎপাদিত পণ্য। একে চড়া দরে দেশের বাজারে বিক্রি করা, অর্থাৎ মোটা অঙ্কের টিউশন আদায় করা ছাড়া আর কি আয়ের উৎস হতে পারে, তা কল্পনা করা কঠিন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখর বিষয়-বুদ্ধিসম্পন্ন কিছু অধ্যাপক মাছ চাষ, আম-কাঁঠালের বাগানের ইজারা, দোকান-জায়গা ভাড়ার মতো কিছু বুদ্ধিও উদ্ভাবন করছেন! পেটেন্ট, রয়্যালটি, গবেষণার ফরমাশ থেকে আয় দিয়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে কি না তা আমাদের জানা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একবার রাতের বাণিজ্যিক কোর্স চালুর চেষ্টা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নিবৃত্ত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিভিন্নভাবে অর্থ-উপার্জনমূলক কোর্স চালু করে যাচ্ছে। অধ্যাপকদের শ্রম, সময় ও মনোযোগের অনেক বড় অংশই কেড়ে নিচ্ছে এই উপার্জনমূলক পাঠদান এবং ফরমায়েশি গবেষণা বা ‘খ্যাপের কাজ’। এই দৈন্যের সংস্কৃতি থেকে মুক্তির পথ কোনোভাবেই বাজেট সংকোচন নয়। বাজেট বাড়িয়েই কেবল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র সেরা ফলটি পেতে পারে। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দের পাশাপাশি ভালো কাজের জন্য, গবেষণার জন্য, সুশিক্ষার জন্য পুরস্কার আর ফাঁকিবাজি, মন্দ কাজের জন্য শাস্তির মতো আত্মজবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা তৈরি করেই মেধার সর্বোত্তম ব্যবহার করা সম্ভব।
সামাজিক খাতগুলোতে সরকারি ব্যয় ক্রমহ্রাসমান করে তোলা এবং সেবা খাতগুলোকে প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিই ও এর অনুসৃত নীতিমালাই বিদ্যমান সংকটের কারণ। সরকারের অদল-বদলেও এই নীতি অক্ষয় থাকে। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার ক্রমেই পারিবারিক ব্যয় ব্যবস্থাপনার হাতে ছেড়ে দেওয়াই এই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। এই প্রবণতা তিন-চার দশক ধরে রাষ্ট্রের সঙ্গে ছাত্রসমাজকে একটি মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে রাখছে। শিক্ষা এখন সব অর্থেই বিদ্যা-কারখানার একটি মহার্ঘ পণ্য এবং উপার্জনের পুঁজি, যা ভাত-রুটি-তরকারির সঙ্গে সন্তানদের হাতে বাবা-মাকে গায়ের রক্ত পানি করে তুলে দিতে হচ্ছে।
খেয়াল করা দরকার, বেতন-ফির বাইরেও বিরাটঅঙ্কের টাকা বাবা-মাদের খরচ করতে হয়। দিনকে দিন লেখাপড়ার খরচ যা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তা অধিকাংশের পরিবারের বাজেট থেকে নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রীর জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করার রাজনৈতিক কথামালার তাহলে কী হবে? মধ্য ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো থেকে আসা বিরাট সংখ্যক তরুণকে মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য সরকার কীভাবে এবং কী কী পদক্ষেপ নেবে, তা স্পষ্ট নয়। উচ্চ আয়ের দেশের উচ্চ আয়ের পরিবারগুলোর পক্ষে সন্তানদের জন্য আর দশটা বিলাসবহুল জিনিস কিনে দেওয়ার মতো শিক্ষাকে কেনা যেমন সম্ভব, তেমনি এই দেশের পরিবারগুলোর কি সেই সচ্ছল অবস্থা রয়েছে? অথচ এরাই কি সন্তানের শিক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে না, যে তাদের সন্তান চাকরি হোক বা স্বোপার্জন হোক—কিছু একটা করে তাদের একটু বেঁচে থাকার ভরসা দেবে? অথচ তারা দেখছে তাদের সন্তানদের সামনে এক বৈষম্যমূলক ভবিষ্যৎ। এই পরিবারগুলোর বাস্তবতা হলো বর্ধিত খরচের মুখে ঝরে পড়া অথবা উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বেকারত্বের ঝুঁকি এবং দারিদ্র্যের পুনরুৎপাদন। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষাবঞ্চিত তরুণকে কেন এই অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেওয়া?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরও উচ্চশিক্ষার সংকটের জ্বালামুখ খোলাই রয়েছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি না বদলালে অর্থাৎ শিক্ষার দায়ের সিংহভাগ রাষ্ট্রের না নেওয়া পর্যন্ত তাই সমাধান আকাশকুসুমই হয়ে থাকবে।
 লেখকেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.