কতক্ষণ কান্না চেপে রাখব? by রুদ্র মাসুদ

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে টিভি স্ক্রিনে সর্বশেষ খবরগুলো দেখা আর যত দ্রুত সম্ভব নেটে বসে অনলাইন নিউজগুলোতে চোখ বুলানো নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি থেকে শুরু করে বাসা থেকে বেরুনো, পত্রিকায় চোখ রাখা_ সবকিছুতেই যেন দেরি হতে থাকে। টিভিও দেখা হয়নি; হয়নি নেটে বসাও।


কোনো এক দুঃসংবাদ যেন পিছু তাড়া করে ফিরছিল। দুপুর ১২টায় যখন সমকালের পাতায় চোখ বুলাচ্ছিলাম তখন বারবার চোখের সামনে পড়ে বিরক্তি তৈরি করছিল ডিএমপির ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রটি। সমকালের পাতায় চোখ থাকা অবস্থায়ই মুঠোফোন বেজে ওঠে। অপর প্রান্ত থেকে বন্ধু নুরুল আলম মাসুদ (পার্টিসিপেটরি রিসার্চর্ অ্যান্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক-প্রান-এর নির্বাহী প্রধান) জানালেন, আপনাকে ফোন করেছি একটা কারণে, সেটি হচ্ছে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ভাই আর তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনী খুন হয়েছেন। কিছুক্ষণ আমার সাড়া না পেয়ে মাসুদ ভাই আবারও বললেন, খবরটা পেয়েছেন? ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু বললাম, ভাই আমার সারা শরীর কেঁপে উঠেছে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত। এ কথার পর তিনি বলেন, ভোরে মুক্তা ভাই (অক্সফাম এশিয়ার রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর জিয়াউল হক মুক্তা) আমাকে খবরটা দেওয়ার পর আমারও একই অবস্থা। এটি শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, শুদ্ধ সাংবাদিকতার মূলে আঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়। জেলা থেকে ঘাতকদের বিচারের দাবিতে দ্রুত কর্মসূচি দেওয়ার কথার মধ্য দিয়েই তার সঙ্গে আলাপের সমাপ্তি ঘটে।
এর পর থেকেই বারবার কান্না পেতে থাকে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে দিইনি, চেপে রাখতে হয়েছে কান্না। দুপুর গড়িয়ে বিকেলেও থামেনি কান্নার উদ্রেক। টিভি চ্যানেলগুলো সাগর সরওয়ার আর মেহেরুন রুনীর হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচার করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ডিএমপি কমিশনার সাগর ভাইয়ের ৫৮/এ/২ ইন্দিরা রোডের পশ্চিম রাজাবাজারের শাহজালাল রশিদ লজের বাসায় গেছেন। প্রধানমন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন দ্রুত হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার।
কিন্তু আমার মতো সারাদেশের শত শত সংবাদকর্মী, যারা জীবনে একদিনের জন্য হলেও সাগর সরওয়ার কিংবা মেহেরুন রুনীর সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের কী সান্ত্বনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী! শিশু বয়সেই নিজের পাশের কক্ষে বাবা-মাকে হারানো সাত বছরের মাহির সরওয়ার মেঘকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী! বাবা-মাকে হারিয়ে আগামী দিনের অনিশ্চিত যাত্রায় মেঘের সহযাত্রী কে হবে? এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দুষ্কর।
২০০০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে প্রায়ই চোখে পড়ত সাগর সরওয়ারের করা তেল-গ্যাস নিয়ে লিড নিউজ। এ নিয়ে তার করা বড় বড় সংবাদ পড়েছি। তখন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে আমার সাংবাদিকতার শুরু। মনে হতো সাগর ভাই অনেক সিনিয়র হবেন। অফিসে যখন পরিচয় ঘটে তখন দেখলাম ক্ষীণকায়, আমাদের চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় এক তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক। বয়কাট চুলের রুনী আপাকে (মেহেরুন রুনী) দেখিয়ে কেউ একজন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন (তখন সাগর ভাই ও রুনী আপা যুগান্তরে একসঙ্গে কাজ করতেন)। এরপর সাগর ভাইয়ের সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে স্নেহমাখা কণ্ঠে কুশল বিনিময় করেছেন, পেশাগত নানা দিক ধরিয়ে দিয়েছেন ভালো রিপোর্টিংয়ের জন্য। কথা হতো রুনী আপার সঙ্গেও। সাগর ভাই ইত্তেফাকে যাওয়ার পরও মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়েছে। রুনী আপা এটিএনে জয়েন করার পর আর কথা হয়নি। ক্রমেই সাগর ভাইয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ কমে আসে। একসময় সেই যোগাযোগ বন্ধই হয়ে যায়।
ফেসবুকের বদৌলতে ২০১০ সালে যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয় সাগর ভাইয়ের সঙ্গে। জানালেন, জার্মানির সরকারি রেডিও ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘদিনের জমে থাকা কথা চ্যাট হতো তার সঙ্গে। সমকালে জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি জেনে খুশি হন তিনি। একদিন জানালেন, তিনি দেশে ফিরে কাজ করতে আগ্রহী এবং মাছরাঙা টিভিতে কাজ করবেন। ডয়চে ভেলে রেডিওতে থাকা অবস্থায় গত বছরের ২৬ থেকে ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত তরুণদের কৃষি পদযাত্রা নিয়ে তিনি ইন্টারভিউ করেছিলেন বন্ধু প্রান-এর নির্বাহী প্রধান নুরুল আলম মাসুদের। সেটি তার হাত দিয়েই প্রচারিত হয়। এ নিয়ে মাসুদ ভাইয়ের সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছিলেন তিনি। বিষয়টি জানা ছিল আমারও। নানা সময়ে আলাপচারিতার কারণে সাগর ভাই মাসুদ ভাইয়ের অন্যতম প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন।
টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন নিউজগুলোতে সাগর ভাই আর রুনী আপার হত্যাকাণ্ডের খবর যতবার দেখছি এবং পড়ছি ততই চোখ গড়িয়ে পড়তে চাইছিল অশ্রুকণা। আমরা কি কাঁদব, না প্রতিবাদ করব_ এমন অনেক প্রশ্ন ভিড় করছিল মনের মধ্যে। প্রতিবাদ তো আমরা করছি, কিন্তু ফল কী হচ্ছে? মাত্র ক'দিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারালেন নিখিল ভদ্র, প্রাণ হারালেন দীনেশ দাস। আর কতজন সাংবাদিকের প্রাণহানি এবং অঙ্গহানি হলে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে_ এ প্রশ্নটি করতে চাই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা সরকারের কাছে। কতক্ষণ কান্না চেপে রাখব? অন্যকে বুঝতে না দেওয়ার কিংবা নিজেকে যেন দুর্বল প্রমাণিত না হয় সে জন্য হয়তো কান্না চেপে রাখা। কিন্তু নিজের প্রাণকে কীভাবে ঘাতকের হাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়_ সে উত্তর কেউ দিতে পারেন?
একদিন হয়তো সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনীর এই হত্যাকারীদের খুঁজে পাবে পুলিশ। কিংবা সাংবাদিকদের বুঝ দেওয়ার মতো জজ মিয়া নাটকের অবতারণা করা হবে। প্রকৃত ঘাতকদের বিচারও হবে হয়তো, কিন্তু মাহির সরওয়ার মেঘকে কি আমরা ভুলে যাব? দেশপ্রেমিক বাবা-মাকে হারানো শিশু মেঘের আগামীর পথচলা যেন মসৃণ হয়_ সেটাই কামনা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে।
প্রান্ত থেকে আওয়াজ তুলতে চাই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে_ দ্রুত সাগর-রুনীর হত্যাকারীদের গ্রেফতার, হত্যাকাণ্ডের কারণ উদ্ঘাটন এবং দ্রুত বিচারের।
editor@chalomannoakhali.com

No comments

Powered by Blogger.