বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩০৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ মোজাফফর আহমদ, বীর বিক্রম রক্ত দিয়ে লিখে গেলেন বীরগাথা রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ চালালেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলে আছেন মোজাফফর আহমদ।
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের একদম কাছে গিয়ে সাহস আর বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন মোজাফফর আহমদ। হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হলেন তিনি। পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রের কয়েকটি গুলি এসে লাগল তাঁর শরীরে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল তাঁর জীবনপ্রদীপ। এ ঘটনা হরিপুরে। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর।
হরিপুর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। সীমান্ত বিওপি। ১৯৭১ সালে এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাংলাদেশে-ভারত সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে এলেও হরিপুর থেকে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হরিপুরে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। সেদিন ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল একযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়।
মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের ঘাঁটি ছিল বেশ সুরক্ষিত। মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষত মোজাফফর আহমদের দল পাকিস্তানি সেনাদের তীব্র গোলাগুলি উপেক্ষা করে সাহসের সঙ্গে সামনে এগিয়ে যান। তাঁদের সাহস দেখে মুক্তিযোদ্ধার অন্যান্য দলও অনুপ্রাণিত হয়। তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে থাকেন। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, এমন সময় মোজাফফর আহমদ পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন।
কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী হরিপুর থেকে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে মোজাফফর আহমদসহ চারজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সহযোদ্ধাদের মরদেহ উদ্ধার করে সেখানেই সমাহিত করেন।
মোজাফফর আহমদ চাকরি করতেন ইপিআরে (পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন রাজশাহী ইপিআর সেক্টরের (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) অধীনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ৭ নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাব-সেক্টরে। বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মোজাফফর আহমদকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১০৮।
শহীদ মোজাফফর আহমদের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের পশ্চিম চাঁদপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম অলি মিয়া। মা হাবিয়া খাতুন। স্ত্রী রাশিদা বেগম। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে।
শহীদ মোজাফফর আহমদের স্ত্রী রাশিদা বেগম জানালেন, ১৯৭৩ সালে একবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ গিয়ে তিনি স্বামীর কবর দেখে আসেন। এরপর আর্থিক দৈন্যের কারণে আর যেতে পারেননি। তিনি জানেন না, বর্তমানে তাঁর স্বামীর সমাধি সংরক্ষিত কি না। সোনাইমুড়ীর সোনাপুর ইউনিয়নের এলাকাবাসী তাঁর স্বামীর নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। শহীদ মোজাফফর আহমদের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৭ এবং ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী)।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.