বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা-ছিমছাম মেলা, ক্রেতার স্বস্তি by মাসুম আলী

শাহবাগের মোড় থেকেই ভিড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। টিএসসির মোড়ে এসে সেই ভিড়ের সাক্ষাৎ যেমন পাওয়া গেল, তেমনি শোনা গেল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ভেসে আসা কুহুকুহু ডাকও। বসন্তের দূত জানিয়ে দিচ্ছিল, ফুরিয়ে এসেছে শীতের দিন।


পঞ্জিকার পাতায় না এলেও রাজধানীর আবহাওয়ায় ঋতুরাজের প্রভাব পড়েছে যথেষ্ট। শীত আর কুয়াশা উভয়ই বিলীয়মান। বিকেলের ফুরফুরে পরিবেশে বাংলা একাডেমীমুখী হতে আগ্রহী অনেকেই। নানা বয়সী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাগমে শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর অবধি পুরো এলাকাতেই উৎসবমুখর পরিবেশ। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ছিল এমনই চিত্র।
যাচাই-বাছাই করে যাঁরা বই কিনতে চান, তাঁদের জন্য মেলার পরিবেশ এখন চমৎকার। পরিসর না বাড়লেও মেলায় স্টলের সংখ্যা এবার যথেষ্ট বেড়েছে। মেলার ভেতরের পরিসর ছোট বলে ছুটির দিনগুলোতে যে প্রচণ্ড ভিড়ভাট্টা হয়, তাতে স্টলে স্টলে খোঁজ নিয়ে পছন্দমাফিক বই কেনা বেশ কঠিন। মঙ্গলবার ছিমছাম ছিল মেলার পরিবেশ। যাঁরা বই কেনার পরিকল্পনা করে এসেছিলেন, তাঁরা বেশ স্বস্তির সঙ্গেই কেনাকাটা করেছেন। আর যাঁরা বেড়াতে এসেছিলেন, তাঁরাও বেশ স্বচ্ছন্দে ঘুরেফিরে, গান শুনে সন্ধ্যা কাটিয়ে গেছেন। মেলার মঞ্চে ভাষার গান শুনিয়েছেন গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের শিল্পীরা।
মোড়ক উন্মোচন: বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আয়োজন চলে বিকেল থেকেই। গতকাল মেলার নজরুল মঞ্চে শাফাত কৈয়ামের বৃষ্টি ভেজা মন, এস এম শাওয়ান মনিরের মানব জীবন আশীর্বাদ কি অভিশাপ সহ পাঁচটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।
নতুন বই: তথ্যকেন্দ্রে গতকাল জমা পড়েছে ১০২টি নতুন বই। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: গল্প ১৬, উপন্যাস ১৫, প্রবন্ধ ১২, কবিতা ২৮, গবেষণা ৭, ছড়া ৫, শিশুসাহিত্য ৩, জীবনী ২, রচনাবলি ১, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ২, ইতিহাস ২, চিকিৎসা ২, রম্য-ধাঁধা ৩, ধর্মীয় ১, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ১ ও অন্যান্য ৯। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ছিল: গণপ্রকাশনী থেকে আহমদ রফিকের ভাষা-আন্দোলন ও নেতাকর্মীদের ভূমিকা, আগামী প্রকাশনী থেকে বদিউল আলম মজুমদারের দিন বদল: গণতান্ত্রিক শাসন ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ, সলিমুল্লাহ খানের স্বাধীনতা ব্যবসা, প্রথমা প্রকাশন থেকে সেলিনা হোসেনের নদীটির ঘুম ভেঙেছে, খান অ্যান্ড ব্রাদার্স থেকে রহমান হাবিবের বাংলাদেশের কবিতা: নন্দনতত্ত্ব ও জীবনার্থ সন্ধান, অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে সারওয়ার-উল-ইসলামের আয়রে আমার ছড়া, শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে ইরাজ আহমেদের বৃত্তের ভেতর একা এবং নাজমুল আশরাফের গণমাধ্যমে দলীয়করণ, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে সৈয়দ শামসুল হকের ভালোবাসার পদাবলি, কথাপ্রকাশ থেকে সেলিনা হোসেনের খুন ও ভালোবাসা, নান্দনিক থেকে আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত মীর মশাররফ হোসেন নাট্যসমগ্র, সময় প্রকাশন থেকে রাবেয়া খাতুনের ভ্রমণসমগ্র ৩, বিভাস থেকে এসেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভয় পেয়োনা নীল মানুষ, জাগৃতি থেকে বদরুদ্দীন উমরের সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসের মুখে: সমাজতন্ত্রের পদধ্বনি, আদিগন্ত থেকে কবীর চৌধুরী অনূদিত চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড, সুজন বড়ুয়ার রাজা যখন চাষীর ছেলে ও রাক্ষস জয়ী যুবরাজ প্রভৃতি।
এদিকে বাংলা একাডেমী গতকাল গত এক সপ্তাহে মেলার বিস্তারিত তুলে ধরেছে সংবাদমাধ্যমের কাছে। একাডেমী সূত্র জানায়, গেল সপ্তাহে ৭২৭টি বইয়ের মধ্যে সংখ্যায় এগিয়ে আছে কবিতার বই। এ পর্যন্ত ১৫৪টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এর পরের স্থানে আছে উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ও রম্য-ধাঁধার বই। এগুলো প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ১২৯, ৭৫, ৫৯ ও ৪১টি। এ ছাড়া গবেষণা ১৮, ছড়া ২৯, শিশুসাহিত্য ৩১, জীবনী ১৬, রচনাবলি ৬, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ১৪, নাটক ৫, গণিত/বিজ্ঞান ১৮, ভ্রমণ ১১, ইতিহাস ১০, রাজনীতি ৭ এবং বাকিগুলো অন্যান্য বিষয়ের বই।
এবার বাংলা একাডেমীর বিক্রি গতবারের তুলনায় বেড়েছে। একাডেমীর বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যে ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ২০০ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। ২০১১ সালে ১২ লাখ ৩০ হাজার টাকার বিক্রি হয়েছিল।
রবীন্দ্রচত্বরে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: বর্ধমান হাউসের সামনে রবীন্দ্রচত্বরে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চ। নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে গতকালও সেখানে ছিল আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গতকাল আলোচনা পর্বে ‘ভাষা-সংগ্রামী গাজীউল হক’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাট্যব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম সবুজ এবং ‘ভাষা-সংগ্রামী মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি-সাংবাদিক আবুল মোমেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন ভাষাবিদ অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, কবি আসাদ চৌধুরী ও কথাসাহিত্যিক নূরুল করিম নাসিম।

No comments

Powered by Blogger.