ইতিউতি-হায়, সভ্য ও সুশৃঙ্খল ব্রিটেন! by আতাউস সামাদ

ব্রিটেনে গত সপ্তাহের শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাজধানী লন্ডন শহরে সহিংসতা শুরু হয়ে চলে টানা চার দিন। বন্দুকধারী পুলিশ মার্ক ডুগল নামে এক ৩১ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে গুলি করে মেরে ফেলার পর এর প্রতিবাদে প্রথমে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হয়। পুলিশ কর্তৃপক্ষ চার সন্তানের পিতা ডুগলের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা তার পরিবারকে জানাতে গড়িমসি করলে উত্তাপ দেখা দেয়।


খানিক পরই লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় প্রচণ্ড সহিংসতা। সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে দেখা দেয় দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও গাড়িতে আগুন দেওয়া। তারপর চলে লুটপাট।
এর মাঝে পুলিশের ভূমিকা ছিল বেশ কিছুটা সন্দেহজনক। তারা দাবি করতে থাকে, নিহত ডুগলের কাছে একটা বন্দুক ছিল এবং তাই দিয়ে সে পুলিশকে গুলি করতে যাচ্ছিল। তখন একজন পুলিশ তাকে গুলি করে। এই তথ্যটি পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এদিকে পুলিশবিরোধী বিক্ষোভ প্রায় হঠাৎ করেই দাঙ্গায় পরিণত হয়। এ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার সময় পুলিশকে প্রায় নিষ্ক্রিয় দেখা যায়। দাঙ্গাকারীরা ঘরবাড়ি, বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও ছোট দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সময় এসবের মালিকেরা পুলিশের সহায়তা চেয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু তাঁরা তা পাননি বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। বিবিসি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান 'হার্ড টক'-এর উপস্থাপক স্টিফেন স্যাকার বলেছেন, দাঙ্গার সময় তিনি নিজেও পুলিশকে ফোন করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাদের নম্বরে ঢুকতেই পারেননি।
এদিকে দু'দিনের ভেতর দাঙ্গা, অগি্নসংযোগ ও লুটপাট ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডের আরো তিনটি শহর বার্মিংহাম, লিভারপুল ও ম্যানচেস্টারে। বার্মিংহামের হাঙ্গামা তীব্র জাতিগত বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছে। সেখানে একটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার অধিবাসীরা মসজিদে এশার নামাজ শেষে একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁরা নিজেরাই নিজ নিজ বাড়িঘর রক্ষার চেষ্টা করবেন। এ রকম একটি পাহারাদার দলের ওপর এক যুবক হঠাৎ করে খুব জোরে গাড়ি চালিয়ে উঠিয়ে দেন। এতে তিনজন সেখানেই মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন, ঘাতক চালক একজন কৃষ্ণাঙ্গ ছিল। রয়টার্স বার্তা সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলেছে, ওই ঘটনার পর কিছু যুবক বিভিন্ন মসজিদের পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে যায় এবং হুংকার দেয় যে তারা মসজিদ পুড়িয়ে দেবে। তবে গতকাল সকালে (শুক্রবার) এ লেখার সময় পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটার খবর পাওয়া যায়নি। লন্ডনে শিখ সম্প্রদায়ের অনেকে তাঁদের নিকটবর্তী গুরদাওয়ারার সামনে জড়ো হয়ে একই রকমভাবে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেন। তাঁদেরও দাঙ্গাবাজদের হুমকি শুনতে হয়েছে। তুর্কি অধ্যুষিত এলাকায়ও তাঁরা হাতের কাছে যা পেয়েছেন তাই নিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট পাহারা দিয়েছেন। বাংলাদেশিদের পাড়াতেও কিছু হামলা হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত বেশ কিছু সরেজমিন প্রতিবেদন পড়ে জানা গেছে, লন্ডনসহ ইংল্যান্ডের চারটি শহরের যে এলাকাগুলোতে হাঙ্গামা হয়েছে সেগুলো মূলত নগরীর ভেতর দিকে অবস্থিত গরিবদের বসতি। তবে শহরতলির মধ্যবিত্ত কিছু এলাকাতেও দোকানপাটের ওপর হামলা হয়েছে। কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশনে লুটপাটকারীদের যে ছবি উঠেছে বার্মিংহামের পুলিশ তা থেকে বেশ কিছু প্রকাশ করেছে দাঙ্গাবাজদের পরিচয় জানার জন্য। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত এসব ছবি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। ছবিগুলো দেখে মনে হয় যে ভাঙচুরকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক-যুবতী_সম্ভবত আফ্রিকান ও ক্যারিবীয় অভিবাসীদের বংশোদ্ভূত। তবে তাদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ও নারীও দেখা গেছে কিছু। শ্বেতাঙ্গদের অন্তত দুজন বেশ বয়স্ক। এদের একজন মুখ ঢাকার চেষ্টা করেছে, অন্যজন করেনি। দোকানের ভেতর লুটের মাল সংগ্রহ করার সময় অনেক লুটপাটকারীরই তাদের মুখের আবরণ সরে যায়।
লন্ডনে হামলাকারীরা মনে হয় নিজেদের পরিচয় গোপন করার বিষয়ে আরো সতর্ক ছিল। তবে লন্ডনে হাঙ্গামার সময় তোলা চারটি ছবি সবার দৃষ্টি কেড়েছে। এর একটি ছিল এক মুখোশধারী যুবক বেশ ধীরেসুস্থে একটি পোশাকের দোকানের কাচের জানালা ভেঙে শো উইনডোতে রাখা কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিল। এর অল্পক্ষণের ভেতরই ওই ইমারতটির পুরোটাতেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় ছবিটি আগুনে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা বাড়ির। তার কয়েকটা দেয়াল যেন শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটা দেখে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় লন্ডনে জার্মান বোমারু বিমানের হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িঘরের কিছু ছবির কথা মনে পড়েছে আমার। তৃতীয় ছবিটি এক পোলিশ নারীর। আগুন থেকে বাঁচার জন্য বাড়ির ওপর তলার জানালা থেকে লাফিয়ে পড়ছেন তিনি। চতুর্থটি এক মালয়েশীয় ছাত্রের। সে হাঙ্গামার মধ্য দিয়েই বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তখন অন্য দুই-তিন যুবক যেন তাকে সাহায্য করছে এমন ভাব দেখিয়ে দাঁড় করায় এবং তারপরই তাদের একজন মালয়েশীয় ছাত্রটির পিঠের ব্যাগ থেকে তার টাকাশুদ্ধ মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোনটি বের করে সেগুলো নিয়ে চলে যায়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ইউটিউবে তুলে দেওয়ার পর সব নামকরা টেলিভিশন চ্যানেল ছবিটি বারবার দেখায়। ইতিমধ্যে লন্ডনে রিচার্ড ম্যানিংটন নামে ৬৮ বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধ আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে দাঙ্গাবাজরা তাঁকে পিটিয়ে আহত করে। তিনি গত পরশু হাসপাতালে মারা গেছেন। তাঁকে নিয়ে হাঙ্গামায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চারে। আহত হয়েছেন কয়েকশ'। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে দেড় হাজারেরও বেশি লোককে।
লন্ডনে প্রথমে যে ৫৬ জনকে আদালতে হাজির করা হয় বিবিসি তাদের বয়স জেনে বিশ্লেষণ করে বলেছে, এদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর। ৩৬ শতাংশ ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী। আর ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ছিলেন ১৩ শতাংশ। ৩০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী আট শতাংশ ও ৪০ থেকে ৪৪ বছর বয়সী ছিল পাঁচ শতাংশ। এদের মধ্যে প্রায় সবাই পুরুষ, দু'তিনজন নারী। তবে আদালতে আনা গ্রেপ্তার হওয়া লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তাদের মধ্যে ১২ বছর বয়সী একটি বালককে দেখা যায়।
হাঙ্গামার শুরুতে সহিংস লোকদের সংবাদ মাধ্যমে, বিশেষ করে বিবিসিতে প্রতিবাদী বিক্ষোভকারী বলা হলেও পরে তাদের দাঙ্গাকারী বলা হতে থাকে। পুলিশের হাতে নিহত মার্ক ডুগলের পরিবারের পক্ষ থেকেও এক বিবৃতিতে বলা হয় যে তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর যাঁরা প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁদের সঙ্গে সহিংস ব্যক্তিদের কোনো সম্পর্ক নেই। ডুগলের পরিবারের সদস্যরা অবশ্য এখনো তাঁর হত্যার বিচারের অপেক্ষায় আছেন বলে জানান।
দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অগি্নসংযোগ ও লুটপাটের ছবি হাতে আসতে থাকার পর ব্রিটিশ সরকার কঠোর অবস্থান নেয়। সরকার থেকে বলা হয় যে দাঙ্গাকারীরা আদৌ কোনো প্রতিবাদ করছে না বা রাজনৈতিক লক্ষ্যে বিক্ষোভ করছে না, বরঞ্চ এরা একদম সুযোগ সন্ধানী লুটতরাজকারী এবং চুরি ও লুট করাই তাদের উদ্দেশ্য। দাঙ্গা চলতে থাকলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গ্রীষ্মকালীন ছুটি ফেলে লন্ডনে ফেরত আসেন। তিনি বিধ্বস্ত কিছু এলাকা পরিদর্শন করেন। পার্লামেন্টে বিরোধী লেবার পার্টির প্রধান এড মিলিব্যান্ডও আসেন। ছুটিতে থাকা পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনও অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল, অর্থাৎ ব্রিটেনের শাসকগোষ্ঠী দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে কট্টরপন্থা নিতে একমত হন। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন পার্লামেন্টে বলেন, 'এই দাঙ্গা সম্পূর্ণভাবে এবং সরাসরি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।' তিনি আরো বলেন, সংখ্যায় অতি সামান্য ওই অপরাধীরা যা পেরেছে হাতিয়ে নিয়েছে, তাদের লক্ষ্য করে বলছি, আমরা তোমাদের পরিচয় উদ্ধার করব, তোমাদের খুঁজে বের করব, তোমাদের কাঠগড়ায় দাঁড়া করাব এবং তোমাদের শাস্তি দেব।' এড মিলিব্যান্ড বলেন, 'পুলিশ বিভাগকে শক্তিশালী করার জন্য সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে, কমানো যাবে না। তিনি বলেন, ক্যামেরনের সরকার যে নানা খাতে ব্যয় বরাদ্দ কাটছাঁট করেছে, তা দেশের জন্য খারাপ হয়েছে।' তাঁর দলের আরেক নেতা জ্যাক স্ট্র বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে কিছু জেলখানা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, তিনি যেন কিছুতেই তা বাস্তবায়ন না করেন। অবশ্য সরকার পক্ষ এতে রাজি হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন কয়েক দফা পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সম্মিলিত বৈঠক করার পর পুলিশের কৌশলকে দায়ী করেছেন দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার জন্য। তিনি বলেন, 'শুরুতে রাজপথে খুব কম সংখ্যক পুলিশ ছিল।' অবশ্য ব্রিটেনের পুলিশ সমিতিগুলোর সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেছেন, 'পুলিশ একটি অভূতপূর্ব এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল।' তাঁর মতে, পুলিশ শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের নির্দেশে এখন লন্ডন শহরে ১৬ হাজার পুলিশ নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। দাঙ্গা শুরুর দিন লন্ডনে পুলিশ ছিল মাত্র ছয় হাজার। তবে লন্ডন ও বার্মিংহামে এশীয় বংশোদ্ভূত ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসীরা বলছেন যে পুলিশ খুবই নিষ্ক্রিয় ছিল এবং তাঁদের সুরক্ষা দেয়নি। এখানেও প্রশ্ন উঠেছে যাঁরা হামলার সরাসরি শিকার হয়েছেন তাঁরা যদি শ্বেতাঙ্গ হতেন তাহলে পুলিশ কি প্রথম থেকেই মারমুখি হতো না? কানাডাবাসী এক ব্রিটিশ নাগরিক বিবিসি মারফত প্রশ্ন করেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী ও লন্ডনের মেয়র হাঙ্গামা শুরুর পর চার দিন পর্যন্ত কোথায় ছিলেন। প্রথম থেকেই তাঁদের লন্ডনে দেখা যায়নি কেন?'
উল্লেখ্য, লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার ও লিভারপুলে চার দিন ধরে এ রকম বিশ্রী হাঙ্গামা চলতে থাকায় দেশে ও প্রবাসে ব্রিটিশ জনগণ মনে করছেন যে এতে সারা বিশ্বে তাঁদের দেশের খুব ঘোরতর মর্যাদাহানি হয়েছে। প্রবাসী ব্রিটিশরা বলছেন, তাঁরা লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না। ব্রিটেনের ভেতরেও এক অদ্ভুত পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের অঙ্গরাজ্য স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও আয়ারল্যান্ড বলছে, যে চারটি শহরে দাঙ্গা হয়েছে তার সবকটি ইংল্যান্ডে অবস্থিত, কাজেই সব গোলমালের দায়িত্ব কেবলই ইংলিশদের নিতে হবে। তাদের দাবি, যে হাঙ্গামা হয়েছে গণমাধ্যমে তাকে 'যুক্তরাজ্যে দাঙ্গা' বলা যাবে না, বলতে হবে ইংল্যান্ডে দাঙ্গা। সরকারসহ অনেক ব্রিটিশ বলছেন যে দেশের বেশির ভাগ জায়গায় কোনো হাঙ্গামা হয়নি, এটাও মানতে হবে।
তবে লন্ডন থেকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে যে এখনো চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। পুলিশ ও বসত এলাকার নেতাদের খুবই সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
হঠাৎ করে যে ব্যাপক ও বিধ্বংসী হাঙ্গামা হলো ব্রিটেনের চারটি বড় শহরে, তার কারণ নিয়ে আলোচনা ও তর্ক চলছে। রয়টার্স বার্তা সংস্থার একটি সরেজমিন প্রতিবেদনে দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারী কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা দেশের 'সিস্টেম' বা ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের দুর্নীতি করে সরকারি টাকা মেরে দেওয়া এবং বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকদের গগনতুল্য বোনাস দেওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। একজন কমিউনিটি লিডার (এলাকার নেতা) দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং বহু তরুণের মধ্যে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে পড়ে থাকার ফলে তৈরি তিক্ততার কথা হাঙ্গামার সুপ্ত কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এক যুবক নিজেকে বিক্ষোভকারী দাবি করে বলেন, সরকার একদিক থেকে কর বাড়িয়েছে, আর অন্যদিকে শিশু-কিশোরদের জন্য যে পারিবারিক ভাতা দিত সেটা কমিয়ে দিয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, তাহলে আমরা যাব কোথায়?
ব্রিটেনে এই দাঙ্গার পর আরো দুটি বিষয়ে কথা উঠেছে। এর একটি হলো, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেনে ধনবৈষম্য সবচেয়ে বেশি মাত্রায় রয়েছে। এক পর্যবেক্ষক ইন্টারনেটে মন্তব্য করেছেন, ব্রিটেন সবচেয়ে জঘন্য অর্থবৈষম্যের দেশ এবং এ দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী মানুষের আর্থিক উন্নতি হওয়ার মতো কর্মকাণ্ডের ভেতর ঢুকতে পারছে না। রয়টার্স বলছে, ব্রিটেনে প্রতি পাঁচজন যুবার মধ্যে একজন একদম বেকার। ১৮ মাস ধরে যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে ও একই সঙ্গে ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি ব্রিটেনের দরিদ্রদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিয়েছে। তারা সবচেয়ে কষ্টে আছে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে হাঙ্গামায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর যাদের প্রথমে আদালতে আনা হয় তাদের মধ্যে ছিল একজন নৃত্যশিল্পী ও একজন খেলোয়াড়। কিন্তু এরা গরিব।
অন্য একটি বক্তব্য, যা প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নিজেও তুলেছেন, তা হলো_ব্রিটেনে মূল্যবোধের দারুণ অবক্ষয় হয়েছে। ক্যামেরন অবশ্য বলেছেন, ব্রিটিশ সমাজের কোনো কোনো অংশে তা হয়েছে। কিন্তু সমাজকর্মীদের অনেকে বলছেন যে বহু যুবক পিতাবিহীন ঘরে বড় হয়েছে, তারা কারো কাছ থেকে শৃঙ্খলা শেখেনি; তদুপরি তারা নিজেদের পরিবারের রক্ষক পুরুষ মনে করে। এতে তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা দেয়। একই সঙ্গে ব্রিটেনে ব্যবসায়ীরা কিশোরদেরও এত ভোগবাদী বানিয়েছে যে হাঙ্গামার সময় তারা কেবল কোনো একটা শখের পণ্য পাবে এই লোভেই লুটতরাজে অংশ নিয়েছে।
সত্য ও সুশৃঙ্খল সমাজের ভাবমূর্তি হারিয়ে ব্রিটেন এখন খুব নাজুক অবস্থায় আছে। তবে সমাজকর্মীদের অনেকে বলছেন যে ব্রিটেনের সমস্যাগুলোকে গোড়া থেকে সারিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। শুধু কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপে চলবে না, ব্রিটেনে সমাজ-শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ এখন খুবই ঢিলেঢালা। তাই সবাইকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার সময় তাদের দায়িত্ববান হওয়ার কথাও বলতে হবে।
ব্রিটেনে গত সপ্তাহের হাঙ্গামায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে দেশের বীমা সমিতি অনুমান করছে তার আর্থিক মূল্য হবে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং। বীমা সমিতি বলেছে, ক্ষতিগ্রস্তরা যেন দুই সপ্তাহ থেকে ৪২ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন, তাহলে তারা তাড়াতাড়ি টাকা দিতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ঘোষণা করেছেন, যাদের বীমা নেই তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে সরকারি অনুদান পাবেন। তিনি বলেন, 'আমরা জানাতে চাই যে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছি।'
ব্রিটেনের হাঙ্গামার সময় দাঙ্গাকারীরা ফেইসবুক, টুইটার ও ব্ল্যাকবেরির মাধ্যমে তাদের পরিচিতদের লুটতরাজে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ব্রিটিশ সরকার তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে আপৎকালে এই সামাজিক যোগাযোগ সুবিধা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না সে ব্যাপারে। এতে অনেক বিশেষজ্ঞ আপত্তি জানাচ্ছেন। কারণ, এ কথাও ভোলা যাবে না যে ওই একই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে লাখ লাখ ব্রিটেনবাসী নিজেদের হাঙ্গামার বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেছিলেন। এ সম্পর্কে চীনের গণমাধ্যমের মন্তব্য হচ্ছে, 'ব্রিটেনের এখন কেমন লাগে?' চীন এসব যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে বলে পশ্চিমা জগতের সমালোচনার মুখে আছে।
জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে মন্তব্য করেছেন, 'শুনলাম ব্রিটেনে আগুন লেগেছে। তারা তাদের আগুন নেভাক আর আমাদের একলা থাকতে দিক।' জাতিসংঘে সিরিয়ার দূত বলেছেন, 'সিরিয়ার হাঙ্গামা ব্রিটেনের মতোই। আলাদা কিছু নয়।' ইসরায়েলে প্রথম দিকে একটি মাত্র পত্রিকা ছাড়া আর কোনো মাধ্যমে ব্রিটেনের দাঙ্গার খবর প্রচার হয়নি। ইরান ও লিবিয়ার গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, এ দাঙ্গা ব্রিটেনে মানবাধিকার হরণের ফল। লিবিয়ার টেলিভিশনে ব্রিটিশদের তাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। (সূত্র : রয়টার্স) অর্থাৎ বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গন যার যেমন সুবিধা তেমনভাবে দেখছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা এবং কাজকর্ম ও লেখাপড়া করতে পারা। বাণিজ্যিক ব্যপারগুলোও আছে। তবে দেশের ভেতরে বাংলাদেশকেও জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এবং দারিদ্র্য ও ধনবৈষম্য দূর করার বিষয়গুলো সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করতে হবে। মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনের প্রশ্নগুলোও বিবেচনার বাইরে রাখা যাবে না। 'মধ্যপ্রাচ্যের ট্রেন' যদি ফ্রান্স ও ব্রিটেনে যেতে পারে, তাহলে তা বাংলাদেশেও আসতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.