শিক্ষানীতি-শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে অবকাঠামোগত সমস্যা by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

এই প্রথম এত দ্রুততায় উঁচু নামের কমিশন নয়, একটি কমিটি ৭১ পৃষ্ঠার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। কমিটি শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, নানা বিষয়ের শিক্ষক, শিক্ষা প্রকাশক, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, শিক্ষক সমিতির নেতা, আইনজ্ঞ দিয়ে সমৃদ্ধ ছিল। সম্ভবত এই প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এই প্রতিবেদনটি সবার পাঠ করার জন্য উন্মুক্ত করা হয় এবং সর্বস্তরের জনগণের মূল্যবান প্রস্তাব, পরামর্শ সংযোজন করার সুযোগ গ্রহণ করা হয়।


এই শিক্ষানীতির প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে যে বিনিয়োগ ঘটাতে হবে, তা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রলম্বিত করা, শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত ১ ঃ ৩০, বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য কমিশন, উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত প্রলম্বিত করা এবং স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন স্থাপন করা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য সামনে রেখে এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার সচেতনতা থেকে শুরু করে সামাজিক মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক পরিবেশ, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা উৎসাহিত করা, শিক্ষার অনুকূল আনন্দময় পরিবেশ তৈরি এবং শিক্ষার সর্বস্তরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
শিক্ষার উন্নয়নে আমাদের অঙ্গীকার যতই প্রবল হোক না কেন, অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশের মতোই সীমিত সম্পদের সুবিশাল চাহিদার দেশে যোগ্য বিনিয়োগ ঘটানো নিঃসন্দেহে কঠিন বিষয়। সুযোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে ইতিমধ্যে বিদ্যালয়গুলোতে যথাসময়ে বিনা মূল্যে পুস্তক সরবরাহের কাজটি যে সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে, তা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১-০২ সালে শিক্ষায় জাতীয় বাজেটের শতকরা ৮ দশমিক ৩৪ ভাগ বরাদ্দ ছিল, অথচ তা ২০১০-১১ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪৩ ভাগে। এই তথ্যটি নতুন শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে আমাদের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বর্তমান শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের যে বিনিয়োগ ঘটাতে হবে, তা স্বাধীন বাংলাদেশ কখনো এর আগে প্রত্যক্ষ করেনি। এর মধ্যে যদি ১০ বছর আগের বরাদ্দের থেকেও জাতীয় বাজেটের ভগ্নাংশ হ্রাস পেতে থাকে, তাহলে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কিছুদিন আগে একটি পরিসংখ্যান নজরে পড়ল—প্রাথমিক শিক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু ব্যয় পাঁচ হাজার ডলারের বেশি, নেপাল ও ভারতে তা মাত্রই ১৩ ডলার, স্বাধীন বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আরও কম। সুতরাং, শুধু কথায় নয়, প্রকৃতপক্ষে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করার কোনো বিকল্প নেই।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় এক খবর এসেছে, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কমিটি-উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। উচ্চবিদ্যালয়সমূহে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী সংযোজিত হবে। নিম্ন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়কে একীভূত করা হবে, তারপর ক্রমান্বয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত চালু করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই যে পরিবর্তন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবং উচ্চবিদ্যালয়সমূহকে একাদশ-দ্বাদশ, তারপর একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর কলেজগুলোতেও পরিবর্তন। প্রায় ৭০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৫ হাজার উচ্চমাধ্যমিক এবং দুই হাজার কলেজে ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তন ও উন্নয়ন নিঃসন্দেহে আমাদের দুর্বল অর্থনীতির জন্য সুকঠিন কাজ। এখানে সম্পদের যে অপচয় হবে, তাও ভেবে দেখার বিষয়। আমরা জানি যে কোনো উন্নয়ন বাজেটের সদ্ব্যবহার করাও সহজ নয়—সকল স্তরেই লাইন লস হবে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে স্থাপিত ভৌত অবকাঠামোর শতভাগ ব্যবহার আমাদের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে যে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, এতে নিঃসন্দেহে অনেক সমস্যারও সৃষ্টি হবে। যেমন উচ্চবিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণীতে পড়াতেন, তাঁদের কী হবে; কলেজে যাঁরা উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে শিক্ষকতা করতেন, তাঁদের কীভাবে ব্যবহার করা যাবে। ভৌত অবকাঠামো, গবেষণাগার, তার ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত হবে? এসব জটিলতার দিকে না গিয়ে বরং বিদ্যালয়সমূহে যেসব শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে, তা-ই রাখা হোক। বরং শিক্ষানীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সমৃদ্ধি ঘটানো হোক গ্রন্থাগার কিংবা পরীক্ষাগারে, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত উন্নয়নে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রত্যয়কে মনে রেখে প্রতিটি পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সারা দেশের ছাত্রছাত্রীদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা উচিত। পাঠ্যপুস্তকের মানে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে ভাবার কোনো কারণ নেই। ভালো ভালো পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে আমাদের বিনিয়োগ ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। এখনো সরকারি স্কুল-কলেজে পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। এরও অবসান চাই।
আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিক্ষায় বড় বিনিয়োগ ঘটাতে পারব না। আমাদের তরুণ ছেলেমেয়েদের অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে শিক্ষা ও দক্ষতার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য শিক্ষার সকল পর্যায়ে অলিম্পিয়াডের মতো প্রতিযোগিতা চালু করা উচিত। যেকোনো বিষয়ে উৎকর্ষ অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতার থেকে অধিক ব্যয়সাশ্রয়ী কোনো পদ্ধতি নেই। সুতরাং আমাদের তরুণদের প্রাণশক্তিকে ব্যবহারের জন্য, সুপ্তশক্তিকে জাগ্রত করতে জনপ্রিয় প্রতিযোগিতার আয়োজন ও তার বহুল প্রচারে সারা দেশের মানুষকে আগ্রহী করা উচিত।
মুখস্থনির্ভর পরীক্ষার ফলে আমাদের ছেলেমেয়েদের সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে, এ কথাটি প্রায় সবাই বিশ্বাস করে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবং তার মূল্যায়নকে খুব গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্য একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়া যেতে পারে, যা সারা বছর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণা করবে। প্রতিবছরই ছাত্রদের সৃজনশীল প্রশ্ন ও সমস্যা দিয়ে তাদের সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করবে।
বিগত কয়েক বছর বোর্ড কর্তৃক এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার যে ফলাফল প্রকাশিত হচ্ছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগের। ৭০-৮০ হাজার ছাত্র যদি পারফেক্ট জিপিএ নিয়ে পাস করে তার অর্থ হলো ৭০-৮০ হাজার ছাত্রের মধ্যে জ্ঞানের ব্যবধান বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ণয় করতে পারে না। ছাত্রদের প্রাণশক্তি অফুরন্ত আরও কঠিন সমস্যা দিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। নিশ্চয়ই সেসব সমস্যাও তারা সমাধান করতে পারবে।
বোর্ডের পরীক্ষার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি অত্যন্ত জরুরি। ভারতে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ এই দায়িত্ব পালন করছে। আমাদেরও অনুরূপ প্রতিষ্ঠান গড়া দরকার। আশা করি, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ীভাবে শিক্ষানীতির কার্যকর বাস্তবায়নের কাজ দ্রুতই শুরু হবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.