অধিকার-মৃতদের জবানবন্দি by অরুন্ধতী রায়

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১। ভোর তিনটায় নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে নামার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই মার্কিন রেডিও সাংবাদিক ডেভিড বারসামিয়ানকে বিতাড়িত করা হয়। স্বাধীন সাংবাদিক বারসামিয়ান এক মারাত্মক মানুষ; মুক্ত রেডিওর জন্য অনুষ্ঠান বানান ও প্রচার করেন।


গত ৪০ বছরে অজস্রবার ভারতে এসেছেন, করেছেন মারাত্মক সব কাজকারবার; যেমন, উর্দু ভাষা ও সেতার বাজানো শিখেছেন। জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার বই আকারে প্রকাশ করেছেন, এঁদের মধ্যে আছেন এডওয়ার্ড সাঈদ, নো’ম চমস্কি, হাওয়ার্ড জিন, আইজাজ আহমেদ ও তারিক আলী। আগের সফরগুলোতে তিনি ভারতের বিদ্বান, সংগঠক, চলচ্চিত্রনির্মাতা, সাংবাদিক ও লেখকদের রেডিও সাক্ষাৎকারের সিরিজ করেছিলেন। এ রকম কাজে তিনি তুরস্ক, ইরান, লেবানন ও পাকিস্তানেও গেছেন। এসব দেশের কোনোটাই তাঁকে বিতাড়িত করেনি।
কী কারণে তাহলে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এই একলা, সেতারপ্রিয়, উর্দু বলিয়ে, বামমনা রেডিও সাংবাদিককে এত ভয় পায়? বারসামিয়ান নিজেই বলছেন, ‘কাশ্মীরই হলো আসল কারণ। আমি ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ, নর্মদা বাঁধ, চাষিদের আত্মহত্যা, গুজরাট হত্যাযজ্ঞ ও বিনায়ক সেনের মামলা নিয়েও কাজ করেছি। কিন্তু কাশ্মীরই হলো ভারতীয় রাষ্ট্রের মূল দুশ্চিন্তার বিষয়। এ বিষয়ে সরকারি ভাষ্যকে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই।’
এই ফেরত পাঠানো সংবাদের মধ্যে সরকারি ‘সূত্রের’ বরাতে বলা হয়েছে, বারসামিয়ান নাকি ‘২০০৯-১০ সালে পর্যটক ভিসায় এসে ভিসা-বিধি অমান্য করে পেশাদারি কাজ চালিয়েছেন’। সরকারি উদ্বেগ ও চাওয়া চিনবার ফোকর হলো এই ভিসা-বিধি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বস্তাপচা ব্যানারের আড়ালে বসে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডিক্রি জারি করে সেমিনার ও সম্মেলনে আমন্ত্রিত লেখক-শিক্ষকদের ভিসার জন্য নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। অথচ করপোরেট হর্তাকর্তা ও ব্যবসায়ীদের বেলায় এসবের বালাই নেই। বিদেশি কারও এখানে বাঁধ বানাতে বা ইস্পাতকল খুলতে বা বক্সাইটের খনি কিনতে চাইলে ভিসা পেতে কষ্ট হয় না। বদ মতলবের দামি স্যুট পরা লোকেরাই বরং আসল সন্ত্রাসী।
ডেভিড ভারতে খনি কিনতে বা সম্মেলনে বক্তৃতা করতে আসেননি। তিনি এসেছিলেন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে। তাঁর বিরুদ্ধে ‘সরকারি অভিযোগ’, গতবার তিনি জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে কিছু ‘অবাস্তব’ প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। অথচ বারসামিয়ান তো প্রতিবেদক নন, তাঁর কাজই হলো মানুষের সঙ্গে কথা বলা। সেই সব মানুষ, যাঁরা মূলত তাঁদের সমাজ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। পর্যটকদের জন্যও কি মানুষের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ? ইউরোপ বা আমেরিকায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের ভিত্তিতে কিছু লেখা কি বেআইনি? এমনকি আমার লেখা যদি ‘বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে’ নাও হয়, কোন ‘ঘটনা’ ঠিক আর কোনটা বেঠিক, তা ঠিক করার মালিক কে? কাশ্মীরে বারসামিয়ান যেসব কথোপকথন রেকর্ড করেছেন, সেসব যদি বিশ্বের সবচেয়ে সৈন্যঘন দখলদারি বিষয়ে না হয়ে সেখানকার গত নির্বাচনের প্রশংসায় হতো, তাহলে কি তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হতো? (কাশ্মীরজুড়ে এক কোটি জনসংখ্যার জন্য ছয় লাখ সৈন্যের পাহারাদারি।) কিংবা তা যদি গত তিন গ্রীষ্মজুড়ে চলা অহিংস বিক্ষোভ নিয়ে না হয়ে ২০০৫ সালের ভূমিকম্পে সেনাবাহিনীর উদ্ধার-অভিযান নিয়ে হতো? অথচ সেই বিক্ষোভ (একজন আন্না হাজারের অনশনের মতো) ২৪ ঘণ্টার মিডিয়া-নজর পায়নি, কেউ তাকে বলেনি (আরব বিক্ষোভের মতো করে) ‘কাশ্মীরি বসন্ত’।
কাশ্মীর বিষয়ে ভারত সরকারের স্পর্শকাতরতার জন্য বিতাড়িতদের মধ্যে ডেভিড বারসামিয়ানই প্রথম নন। সানফ্রান্সিসকোর নৃবিজ্ঞানী অধ্যাপক রিচার্ড শাপিরোকে ২০১০-এর নভেম্বরে ফেরত পাঠানো হয়। আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস, এটা ছিল তাঁর স্ত্রী অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়কে শাস্তি দেওয়ার কৌশল। অঙ্গনা ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল পিপলস ট্রাইব্যুনাল অন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড জাস্টিজের যুগ্ম আহ্বায়ক। তাঁরাই প্রথম কাশ্মীরের অজস্র বেনামা গণকবরের দিকে বিশ্বের নজর টেনেছিলেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে কর্মরত সংগঠন এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেসের মে অ্যাকুইনোকেও ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এই সেপ্টেম্বরেই তাঁর কাশ্মীর সফরের কথা ছিল। এমনকি ভারতের সাহসী গণতান্ত্রিক অধিকারকর্মী গৌতম নবলক্ষ্যকেও শ্রীনগর বিমানবন্দরে নামামাত্রই দিল্লিতে ফেরত পাঠানো হয়। এসবের মাধ্যমে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন রাখার কলাকৌশল জারি আছে। দুটি নিবিড় সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ চক্র দিয়ে—দিল্লি ও শ্রীনগরে—কাশ্মীরকে বাদবাকি দুনিয়া থেকে আলাদা রাখা হচ্ছে। অথচ দেশের ভেতরে সরকার ও সেনাবাহিনীর জন্য সবকিছুই জায়েজ। ওদিকে কাশ্মীরের সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে ঘুষ, হুমকি, ব্ল্যাকমেইলসহ সতর্কভাবে তৈরি করা একগাদা অকহতব্য নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া, যা মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
সরকার যখন এভাবে জীবিতদের মুখ বন্ধ রাখতে নেমেছে, তখন মুখ খোলা শুরু করেছে মৃতরা। ভারতের মানবাধিকার কমিশন যখন চক্ষুলজ্জার মুখে পড়ে কাশ্মীরের তিনটি জেলায় ২৭ হাজার অচিহ্নিত কবরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে, ঠিক সে সময় কাশ্মীরে যেতে চাওয়া নিশ্চয়ই বারসামিয়ানের বাড়াবাড়ি। কাশ্মীরের অন্যান্য জেলা থেকেও এ রকম হাজার হাজার কবরের খবর আসছে। যে সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে ভারতের মানবাধিকার-পরিস্থিতির প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য পেশ করা হয়েছে, সে সময় ভারত সরকারকে জ্বালাতন করা ধৃষ্টতাই বটে।
তাহলে ডেভিড বারসামিয়ান ছাড়া আর কী কী ভয় পায় বিশ্বের বৃহত্তম এই গণতন্ত্র? ভয় পায় দান্তেওয়াদার আদিবাসী তরুণ লিঙ্গরাম কদপিকে। গত ৯ সেপ্টেম্বর তাঁকে মাওবাদীদের কাছে টাকা হস্তান্তরের অভিযোগে ‘হাতেনাতে’ গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ তাঁর খালা বলছেন, সাদা পোশাকের পুলিশ লিঙ্গরামকে পালনার গ্রামে তাঁর দাদাবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। এখন এই নারীও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, লিঙ্গরামকে আটক করার সময় মাওবাদীদের পালাতে দিয়েছে বলে স্বীকার করেছে পুলিশ। এ হলো পুলিশের বলা সেই সব কল্পিত অভিযোগের একটি, যা তারা নিজেরাই পরে তুলে নেয়। লিঙ্গরামের আসল অপরাধ হলো, তিনি গোন্দিভাষী একমাত্র সাংবাদিক, যিনি ভারতের আরেক যুদ্ধক্ষেত্র ছত্তিশগড় অরণ্যের হালচাল ভালো জানেন। যেখান থেকে কোনো খবরই বাইরে আসতে পারে না, তিনি তার সংবাদদাতা।
বিভিন্ন বহুজাতিক খনি কোম্পানি ও অবকাঠামো-নির্মাতা করপোরেশনগুলোর কাছে আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে গোপন সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে মধ্য ভারতের বিরাট আদিবাসী এলাকাকে তুলে দেওয়ার পর এখন সেই সব অঞ্চল নিরাপত্তা বাহিনীর লাখো সদস্য দিয়ে ভরিয়ে তুলছে ভারত সরকার। সশস্ত্র বা নিরস্ত্র যেকোনো প্রতিবাদকেই তারা নাম দিয়েছে ‘মাওবাদী’। কাশ্মীরে যেমন প্রতিবাদীদের ব্যাপারে তাদের পছন্দের নাম হলো ‘জিহাদি লোকজন’। ভারতের গৃহযুদ্ধ মারাত্মক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাজার হাজার আদিবাসী শরণার্থী হয়ে পালাচ্ছে পাশের রাজ্যগুলোতে। আরও হাজারে হাজার বনজঙ্গলের মধ্যে ত্রাসিত জীবনে লুকিয়ে থাকছে। বনের দখল নিয়ে নিয়েছে আধাসামরিক বাহিনী। গ্রামের বাজারগুলোতে ছোঁকছোঁক করছে পুলিশের ইনফরমারদের নেটওয়ার্ক। ভয়ে জরুরি জিনিসপত্র বা ওষুধপত্র নিতে আসে না কেউ সেখানে। অগণিত অনামা মানুষে ভরে উঠছে কারাগার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিদ্রোহের উসকানি কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। দুর্ভাগাদের পক্ষে সওয়াল-জবাবের জন্য নেই কোনো উকিল। ওই গহিন অরণ্যের কোনো খবর বাইরে আসে না, সেখানে লাশ গণনারও সুযোগ নেই কারও। এ রকম অবস্থায় লিঙ্গরাম গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে গ্রামবাসীর মুখের কথা ভিডিও করে ইউটিউবে ছেড়ে দিয়েছেন; সেখানে দেখা যায় গ্রামবাসী বলছে, কীভাবে পুলিশ তাদের গ্রাম পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। সুতরাং বোঝা কঠিন নয়, কেন লিঙ্গরামকে তারা হুমকি মনে করে।...
একদিন কাশ্মীরের মতো দান্তেওয়াদাতেও মৃতরা কথা বলা শুরু করবে। তখন কেবল মরা মানুষই নয়, কথা বলবে মরা জমি, মরা নদী, মরা পাহাড়। এবং মরা অরণ্যের মরা প্রাণীগুলোও দাবি করবে প্রকাশ্য শুনানির। তারাই দেবে জবানবন্দি।
ইতিমধ্যে জীবন বয়ে যাবে। চলবে নিশ্ছিদ্র নজরদারি, ইন্টারনেটে পুলিশগিরি, ফোনে আড়ি পাতা। এসবের পরও যারা কথা বলে উঠবে, তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য চলবে আরও নির্দয় দমন-পীড়ন। এ রকম অবস্থায় ভারতকে সাহিত্য সম্মেলনের স্বপ্নভূমি ভাবা বেখাপ্পা লাগে। তালিকায় আগামী কয়েক মাসে এ রকম অন্তত ১০টি সম্মেলন রয়েছে। এর অনেকগুলোই হচ্ছে সেই সব করপোরেশনের টাকায়, যাদের কল্যাণে চালানো হচ্ছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। আয়োজকেরা বলেন, সম্মেলনগুলো সম্পূর্ণ ‘অরাজনৈতিক’। কিন্তু তারা বলেন না, যে নিষ্ঠুর সামরিক শাসনে হাজার হাজার মানুষের জীবন গিয়েছে, স্বজনহারা হয়েছে হাজার হাজার নারী ও শিশু, যার নির্যাতন কুঠুরিতে পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছে আরও লাখো মানুষ, কীভাবে সেই শাসনের শাসক ও শাসিতরা ‘অরাজনৈতিক’ হবে? ভাবি, এসব আমন্ত্রিত সাহিত্যিক কি পর্যটক ভিসায় আসবেন? দিল্লি ও শ্রীনগরের জন্য আলাদা আলাদা ভিসা লাগবে না? তাদের কি নিরাপত্তা ছাড়পত্র লাগবে? এসব সম্মেলনে আগত কোনো কাশ্মীরিকে কি মুখ খোলার পর সোজাসুজি নির্যাতনকেন্দ্রে নেওয়া হবে, নাকি বাড়ি গিয়ে বিদায় নিয়ে আসতে দেওয়া হবে?
আমাদের ফুসফুসগুলো ক্রমশ অক্সিজেনশূন্য হয়ে যাচ্ছে। দেহে যতটা শ্বাস এখনো আছে, সবটুকু দিয়ে এখনই সময় দাবি তুলবার: খুলে দাও সব রক্তাক্ত দরজা।
ভারতের আউটলুক ম্যাগাজিন থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় কথাসাহিত্যিক ও প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী।

No comments

Powered by Blogger.