চারদিক-টোকাই বলে ডেকো না, কষ্ট পাব

পপির ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে দেওয়ার পর নতুন আবদার করল, তাকে নেইল পলিশও দিয়ে দিতে হবে। হাসিমুখে সে কাজটি করে দিলেন লতা। এবার হাসি ফুটে উঠল পপির মুখে। হাসতে হাসতেই তার আরও এক বন্ধুকে দেখিয়ে লতাকে বলল, ‘আপা এরেও লাল জামা দ্যান।’ তার বন্ধুকে লাল জামা দেওয়ার পর যথারীতি সাজুগুজুর পালা। বন্ধুকে সাজানো পর্যন্ত অপেক্ষা করল পপি। শেষ হলে রওনা দিল ছবি আঁকার ঘরে।


চেয়ে নিল ছবি আঁকার পেপার আর রং-পেনসিল। কিছু একটা আঁকতে বসে গেল পপি ও তার বন্ধু।
গত ৯ সেপ্টেম্বর নটর ডেম কলেজের লিটার‌্যাসি স্কুলের পাশের দৃশ্য এটি। তবে পপি ও তার বন্ধুকে হয়তো অনেকেই দেখলে চিনবেন। মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে সে প্রায়ই পেপার ও চকলেট বিক্রি করে। নটর ডেম কলেজে সেদিন যেসব শিশু হাজির হয়েছিল অন্য রকম একটা দিন উপভোগ করতে, তারা সবাই পথশিশু। বসবাস এই শহরেই। এসব শিশুকে নিয়ে অন্য রকম একটি উৎসবের আয়োজন করে পথশিশু সেবা সংগঠন নামের একটি সংগঠন। তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছিল একমাত্রা নামের আরও একটি সংগঠন। সব মিলিয়ে এদিন প্রায় ১৩০ জন পথশিশু পালন করে একটি অন্য রকম দিন।
শিশুদের হাত ধোয়া এবং ধোয়ানোর মাধ্যমে শুরু হয় শিশু ও স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যস্ততা। হাত ধোয়ানোর পরপরই তাদের সামনে নাশতা চলে আসে। সেটা শেষ না হতেই হাতে দেওয়া হয় টোকেন। যে টোকেনগুলো দেখালেই তারা বিভিন্ন ধরনের সেবা গ্রহণ করতে পারবে সারা দিনের জন্য স্থাপন করা বিভিন্ন বুথ থেকে।
সাভার থেকে পাঁচজন নাপিত এসেছেন। যাঁরা সবার কাছে ডাচ শাহ আলম ফ্যামিলি বলে পরিচিত। তাঁদের কাছে মাথা নিচু করা অর্থাৎ চুল কাটানোর মাধ্যমে শুরু হয় শিশুদের সেবা গ্রহণ। এরপর টোকেন নিয়ে শিশুরা রওনা দেয় চিকিৎসাসেবা ক্যাম্পে। এখানে দুজন চিকিৎসক ও একজন ইন্টার্নি চিকিৎসক শিশুদের প্রাথমিক ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছেন। কথা হলো উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজের মেডিকেল অফিসার রুমানা কবীরের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘এখানে যেসব শিশু আসছে, তাদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা ও পেটে ব্যথা বেশি। তাদের প্রাথমিকভাবে দেখে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।’ কথা বলতে বলতেই চিকিৎসা নিতে আসে কারওয়ান বাজারের পথশিশু দুখু মিয়া। কিন্তু তার চিকিৎসা নেওয়ার চেয়ে গান শোনানোর আগ্রহ বেশি। চিকিৎসকেরা গাইতে বলতেই গান শুরু করে দিল দুখু মিয়া। গানের কথা, ‘টোকাই বলে ডেকো না, কষ্ট পাব/ লাত্তি গুঁতা মেরো না, দুঃখ পাব।’ গান শেষে হাততালি যেমন পেল দুখু মিয়া, তেমনি অনুরোধ এল আরও একটা গান শোনানোর।
চুল কাটা ও চিকিৎসা শেষে শিশুরা যাচ্ছে নতুন পোশাক নেওয়ার কক্ষে। শরীরের সঙ্গে মানানসই এবং সাইজ অনুযায়ী নতুন পোশাক দেওয়া হচ্ছে শিশুদের। পোশাক নিয়েই সবাই দৌড় দিচ্ছে গোসলখানায়। গোসল শেষে সাজসজ্জার পালা। সাজা শেষে মজা করতে করতেই শিশুরা চলে যায় তাদের নিয়ে আয়োজিত ওয়ার্কশপ কক্ষে। ওয়ার্কশপ বলতে শিশুদের মন যা চায় তা-ই করতে দেওয়া। কেউ ছবি আঁকছে, কেউ কাগজ কেটে ফুল বানাচ্ছে। কেউ হাতে রং ভরিয়ে আর্ট পেপারে নিজের হাতের ছাপ রাখছে।
আঁকাআঁকি করতে করতেই দুপুর হয়ে যায়। এ সময় শিশুদের নটর ডেম কলেজের মাঠে প্রবেশ করেন পথশিশু সেবা সংগঠনের প্রাণপুরুষ লুসিও বেনিনাত্তি। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মতো ইতালীয় নাগরিক এই মানুষটির ডাক যেন ফেলতে পারে না শিশুরা। শিশুদের কাছে যিনি লুসিও ভাই বলে পরিচিত। শিশুদের মতোই আরেক মধ্যবয়স্ক শিশু লুসিও যখন শিশুদের নিয়ে মাঠে প্রবেশ করেন তখন দূর থেকে দেখে মনে হয়, ঠিক হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা মাঠে প্রবেশ করছেন। খুব স্পষ্ট করে বাংলা বলছেন শিশুদের সঙ্গে। তাই শিশুদের ভাষা বুঝতে এবং বোঝাতে কোনো অসুবিধা হয় না তাঁর। তিনি শিশুদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে দেন খেলার জন্য। যারা ফুটবল খেলতে আগ্রহী তারা মাঠের এক পাশে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফুটবল নিয়ে। অন্য পাশে দৌড় প্রতিযোগিতা, বস্তা দৌড়, ডিব্বা দৌড়, রুমাল চোর, রিং নিক্ষেপসহ বিভিন্ন ধরনের খেলা চলতে থাকে। খেলা শেষে দুপুরের খাবারের আয়োজন। এরই মধ্যে এখানে সস্ত্রীক হাজির হন ইতালিয়ান রাষ্ট্রদূত জার্জিও গুলিমিনি। সবশেষে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও জাদু প্রদর্শনীর। জাদুশিল্পী উলফাৎ কবীর, যিনি শিশুদের কাছে ম্যাজিক আঙ্কেল বলে পরিচিত তিনি ও তাঁর স্ত্রী রুখসানা কবির মিলে একের পর এক জাদু দেখিয়ে মুগ্ধ করেন শিশুদের। শিশুসুলভ এসব জাদু দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে যায়। এরই ফাঁকে বিতরণ করা হয় শিশুদের হাতে তৈরি ঈদকার্ড, ফুলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র। এ ছাড়া শিশুদের হাতে তৈরি বিভিন্ন জিনিস প্রদর্শন করা হয়। একমাত্রার পরিবেশনায় থাকে গান, নাচ ও কবিতা আবৃত্তি। সবশেষে সব স্বেচ্ছাসেবককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যার কিছু আগে সব শিশুর হাতে জুস, পেস্ট, ব্রাশ ও চকলেট তুলে দেওয়া হয়। সেসব নিয়ে হাসিমুখে গাড়িতে ওঠে প্রতিটি শিশু।
রুবেল হাবিব
aopuৎno@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.