আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ-হাক্কানি নেটওয়ার্কের অন্দরমহলে by হামিদ মির

পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার টানাপোড়েন কমে এসেছে; কিন্তু সবকিছুই যে ঠিক হয়ে গেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তালেবান যদি কাবুলে আরেকটা হামলা চালায়, তাহলে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই গত শনিবার কাবুলে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা স্থগিত করে দিয়েছেন।
এর মধ্য দিয়ে তিনি ইসলামাবাদে সর্বদলীয় সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবটি খাটো করার চেষ্টা করেছেন। সর্বদলীয় সম্মেলন সুপারিশ করেছে, পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকাগুলোর জনগণের সঙ্গে আলোচনা করার একটি নতুন প্রক্রিয়া শুরু করা হোক বৃহস্পতিবার থেকে। পাকিস্তানের অনেক নেতা এমন প্রশ্নও তুলেছেন—যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের সরকার যদি তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে, পাকিস্তান কেন নিজের জনগণের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারবে না? কাবুলের ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো দাবি করছে, প্রেসিডেন্ট কারজাই আফগান তালেবানের সঙ্গে আলোচনা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্ভাব্য যেকোনো আলোচনা পণ্ড করতে। কারণ, কারজাই মনে করেন, তাঁর নিজের দেশের তালেবানকে মোকাবিলার প্রয়াস ইসলামাবাদ ভণ্ডুল করেছে।
জানা গেছে, হামিদ কারজাই ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা শুধু মোল্লা ওমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেননি, অনেকবার সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেছেন সিরাজুদ্দিন হাক্কানির সঙ্গেও। সিরাজ আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে খলিফা হিসেবেও পরিচিত। হাক্কানি নেটওয়ার্কের অপারেশনাল কমান্ডার এই খলিফা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি গত এক বছরে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে সাক্ষাৎ দিতে একবার নয়, তিনবার অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এমনকি এ বছরের জুনে তিনি আফগানিস্তানের বাইরে কোনো স্থানে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেও অস্বীকৃতি জানান। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও প্রয়াত প্রেসিডেন্ট বোরহানউদ্দিন রব্বানি অনেকবার খলিফা সিরাজের সাক্ষাৎ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন সিরাজের চাচা হাজি ইব্রাহিম হাক্কানির মাধ্যমে। তাঁরা সিরাজকে শান্তি আলোচনায় অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। কারজাই একপর্যায়ে খলিফা সিরাজকে পাকতিয়া প্রদেশের গভর্নর হওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন; কিন্তু সিরাজ সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। হাজি ইব্রাহিম হচ্ছেন জালালউদ্দিন হাক্কানির ছোট ভাই। মার্কিন কর্মকর্তারা ২০০২ সালে হাজি ইব্রাহিম হাক্কানিকে পাকতিয়া প্রদেশের গভর্নর বানানোর লোভ দেখিয়ে বড় ভাই জালালউদ্দিন হাক্কানির সঙ্গে সম্পর্কে ভাঙন সৃষ্টি করেন। কিন্তু মার্কিনরা সিরাজকে পাকতিয়ার গভর্নর করেনি।
পরে, ২০০২ সালে খোস্ত প্রদেশের গভর্নর বাদশা খান জারদানের সঙ্গে হাজি ইব্রাহিমের বিরোধ সৃষ্টি হলে কারজাই হাজি ইব্রাহিম হাক্কানিকে পাকতিয়া প্রদেশের সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। বাদশা খান জারদান পাকতিয়া প্রদেশে বেশ হস্তক্ষেপ করতেন। বাদশা ও ইব্রাহিম একই জারদান গোত্রের মানুষ, কিন্তু তাঁরা পরস্পরের বিরোধী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ইব্রাহিম হাক্কানি সরকারি পদ ছেড়ে দেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন এ আশায় যে, কোনো একদিন তাঁকে কাবুল সরকারের একজন মন্ত্রী বানানো হবে। প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের পক্ষ থেকে তিনি তাঁর ভাতিজা খলিফা সিরাজের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু জালালউদ্দিন হাক্কানি তাঁর ছেলে সিরাজকে তালেবানের সঙ্গে বেইমানি না করার পরামর্শ দেন।
খলিফা সিরাজ তাঁর চাচাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, মোল্লা ওমরের অনুমতি ছাড়া তিনি প্রেসিডেন্ট কারজাই বা বোরহানউদ্দিন রব্বানি বা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। চাচা ইব্রাহিম হাক্কানি ও ভাতিজা খলিফা সিরাজুদ্দিন হাক্কানির মধ্যে শেষ বৈঠক হয় পেশোয়ারে। সেখানে ইব্রাহিম তাঁর ভাতিজাকে বলেন, তালেবান তাইয়াব আগার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে, তাহলে তুমি কেন কাবুল আর ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি নও? চাচার এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য খলিফা সিরাজ কিছু সময় চেয়ে নেন। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তিনি চলে যান আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলে, তিনি তাঁর চাচার সঙ্গে এসব আলোচনার পুরো বিষয়টি সম্পর্কে তালেবান-নেতা মোল্লা ওমরকে জানিয়েছিলেন একজন বার্তাবাহকের মারফতে।
মোল্লা ওমর খলিফা সিরাজকে নিশ্চিত করেন যে তালেবান কাবুল বা ওয়াশিংটন সরকারের সঙ্গে কোনো রকম আলাপ-আলোচনায় যায়নি। মোল্লা ওমর খলিফা সিরাজকে জানান, তালেবান আমেরিকানদের পরীক্ষা করার জন্য তাদের সঙ্গে দুই পক্ষের বন্দীদের কিছু তালিকা বিনিময় করেছে। তিনি সিরাজকে আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার মাধ্যমে তালেবানের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা করছে, এ ব্যাপারে তালেবান নিশ্চিত। মোল্লা ওমর তিন মাস আগেই তাইয়াব আগাকে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বন্ধ করে দিতে বলেন। আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, খলিফা সিরাজ এখন মুক্তভাবে গারদেজ ও পাকতিয়ার মধ্যে আসা-যাওয়া করছেন; আর তাঁর বাবা জালালউদ্দিন হাক্কানি পাকিস্তানের ভেতরে কোথাও লুকিয়ে আছেন। কারণ, তিনি অসুস্থ। সূত্রগুলো বলছে, শান্তি পরিষদের প্রধান বোরহানউদ্দিন রব্বানির হত্যাকাণ্ড ছিল একটি পরিষ্কার ইঙ্গিত যে তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় বসতে আগ্রহী নয়।
বোরহানউদ্দিন রব্বানি খুন হওয়ার পর পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ে। এই চাপের ফলেই খলিফা সিরাজের সামনে পাকিস্তানের তালেবানকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা বন্ধ করতে বলার সুযোগ আসে। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের পাকিস্তানি তালেবানের কমান্ডার ওয়ালিউর রেহমান মেসহুদকে পাঠানো এক বার্তায় খলিফা সিরাজ লেখেন, ‘আইএসআই ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমেরিকার অভিযোগগুলো খেয়াল করো। পাকিস্তানের ওপর আমেরিকান কোনো আস্থা নেই। মাইক মুলেন কথা বলছে পাকিস্তানের শত্রুর মতো। কারণ, আমি মোল্লা ওমরকে বিপদে ফেলতে রাজি হইনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মাইক মুলেনের অভিযোগগুলোর প্রতি হোয়াইট হাউস সায় দিচ্ছে, তাহলে তোমরা কেন তোমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছ?’
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
হামিদ মির: পাকিস্তানের বেসরকারি টেলিভিশন জিয়ো টিভির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.