কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-জন্মের সময় বয়স আমার বেশি ছিল by রণজিৎ বিশ্বাস

আপনি তো টেলিভিশনের পোকা। : আপনাকে কে বলল?! : আমাদের স্টাইলে একটা পর্যবেক্ষণ আমরা চালিয়ে দেখেছি। প্রমাণ এ রকমই মিলেছে। এটি পুরো সত্য নয়। আমি সারা দিন টেলিভিশন দেখতেই পারি না। আমার শ্রমের জায়গার দাবি খুব বেশি। এত বেশি যে শুক্র-শনিবারেও আমি সময় জোটাতে পারি না।


তবে আপনাদের পর্যবেক্ষণ যদি রাত ১২টার পরে চালানো হয়, আমি কবুল করব- আপনি মিথ্যে বলেননি। রাত ১২টা থেকে দেড় ঘণ্টা আমি টেলিভিশনের সঙ্গে গ্লুসাঁটা অবস্থায় থাকি। তখন টেলিভিশনের সামনে বসে থাকার বিষয়টা আমি নিয়মে পরিণত করেছি।
: কী দেখেন তখন আপনি?
: টক শো। তখন মনে হয়, দেশটা টক শোর আন্ডারে চলে যায়। মনে হয়, এই শোগুলোতে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা দেশের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে বসেন।
: আপনার অভিজ্ঞতার কথা কিছু শুনতে চাই।
: কতটা কিভাবে বলতে পারব আমি জানি না। আমি যতটুকু বলতে পারব তো পারব, বাকিটা আপনি বুঝে নেবেন।
যাঁরা টক করেন, বিভিন্ন শোতে। তাঁরা তাঁদের যোগ্যতায়, উপযোগিতায়, বাগ্মিতায় ও বহুমাত্রিক পারঙ্গমতায় বিষয়টিকে অসামান্য এক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তাঁদের আলোচনা, বিশ্লেষণ ও বাক্যবিতরণের মধ্যে একটা উৎকর্ষমণ্ডিত প্রফেশনাল টাচ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রমাণ পাওয়া যায়, ভালোমতো লেখাপড়া করা এক কথা, কোনো বিষয় গভীরভাবে ও ভালোভাবে জানা এক কথা, আর দেশের মাপে ভালো একজন টক শো স্পেশালিস্ট হওয়া আরেক কথা। বলতে পারেন, পুরোপুরি ভিন্ন কথা।
এদের মধ্যে কেউ কেউ এই বিশ্বাসও জাগিয়ে বসেন, জগৎ-সংসারে হেন বিশ্বাস নেই, যে সম্পর্কে তাঁদের নলেজ ঈর্ষণীয়ভাবে থরো নয়। তাঁরা তাঁদের স্টাইলে, কৌশলে, টেকনিকে শব্দ প্রক্ষেপণে, বাক্য বিনির্মাণে, অঙ্গসঞ্চালনে ও বিবাদ-বিতর্ক সৃজনে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে ছাড়েন যে প্রতিভা থাকলে অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু টক শোর স্পেশালিস্ট হওয়া যায় না।
আমি যখন তাঁদের বাক্য শ্রবণ করি, বিস্ময়ে ভাবি- একটি সীমাবদ্ধ ও খর্ব মানুষ সংসারের সব বিষয়ে এমন গভীর জ্ঞানের অধিকারী কিভাবে হতে পারেন! তিনি কি মানুষ! না অন্য কিছু! তিনি কি হিউম্যান বিঈঙ, না সুপার হিউম্যান! আমি তাঁদের কারো কারো দিকে তাকাই, আর ভাবি- যদি তাঁদের ওয়ান পারসেন্টও হতে পারতাম! যদি তাঁদের পদরেণু অঙ্গে মেখে নিতে পারতাম! এঁদের মধ্যে সাংবাদিক আছেন, অধ্যাপক আছেন, কলাম লেখক আছেন এবং কী নেই!
: এই শোগুলোতে আর কী কী বৈশিষ্ট্য আপনি লক্ষ করেছেন।
: কোনো কোনোটিতে দেখেছি, যার কথা বলার কথা সবচেয়ে কম, তিনিই বলে চলেছেন ও বকে চলেছেন সবচেয়ে বেশি। সুইচ অন করার পর যদি তেমন কাউকে ভাষণরত পান, আপনাকে দুই মিনিট অপেক্ষা করতে হবে অতিথি আলোচকের কথা শোনার জন্য।
: সঞ্চালকের কথা থাক। তেমন দু-একজন সব সময় থাকেনই, যাঁরা থামতে জানেন না। ওজন বুঝে ভোজনের প্রয়োজন যাঁরা একেবারেই মানেন না। আপনি স্পেশালিস্টদের কথা বলুন।
: বলব। তার আগে সঞ্চালকদের বিষয়ে শেষ কথাটি বলি। তাঁদের কেউ কেউ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের পক্ষের প্রকাশ্য ও ছদ্মবেশী বক্তাদের এমনভাবে উসকে দেন, বিশ্বাসই হতে চায় না যে এই সেদিনও তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে ছিলেন ও কালপ্রিটদের পক্ষে কথা বলতেন।
টকিং স্পেশালিস্টদের মধ্যে কাউকে কাউকে যাঁরা অবনস্কাসলি টকেটিভ বলে ডিসকার্ড করতে চান, তাঁদের পক্ষে আমারও থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি থাকি না। প্রথমত তাঁরা একটি পেশাজীবী শ্রেণী তৈরিতে অবদান রাখছেন। দ্বিতীয়ত তাঁরা আমাদের মধ্যরাতের বিনোদন ও কৌতুকের উপাদান-উপকরণ নিবিড় শ্রম ও অকৃত্রিম আন্তরিকতায় সরবরাহ করে চলেছেন। তাঁরা বিশ্বাস জাগাচ্ছেন, দুটি বা তিনটি লাইভ শো-তে যদি একই সময়ে থাকা সম্ভব হতো, তাঁরা তা-ই করতেন। সবচেয়ে আনন্দ পাই তখন, যখন কোনো টকিং স্পেশালিস্ট বুঝতে পারেন না যে তাঁদের নিরপেক্ষতার ভড়ং আমি বুঝে যাচ্ছি, নিরপেক্ষতার অভিনয় করলেও তাঁদের কথা যে যুদ্ধাপরাধী ও তাঁদের সাপোর্টারদের পক্ষে যাচ্ছে, বোকাসোকা জনগণও তা বুঝে ফেলছে।
: এমন কয়জনকে আপনি চিহ্নিত করেছেন?
: দুজনকে। একেবারে নির্ভুলভাবে।
: পেশায় এরা কী হন?
: একজন সাংবাদিক, একজন শিক্ষক।
: তাঁরা কি আপনাকে চেনেন?
: একসময় চিনতেন। দেখাসাক্ষাৎও হতো। ভালোভাবেই চিনতেন।
: বয়স কত হবে তাঁদের?
: আমার চেয়ে কম।
: কত কম হবে?
: আপনি যত ভাবছেন, তার চেয়ে অনেক কম।
: আপনার বয়স কত?
: নাইনটি টু। বিরানব্বই।
: অনেক দিন ধরে তো তা-ই বলছেন!
: বলছি। আরো অনেক দিন বলব। ভদ্রলোকরা কখনো দুই কথা বলেন না।
: কিন্তু আপনাকে তো অত বৃদ্ধ মনে হয় না!
: সেটি যদি সত্য হয়, আমার জন্য আনন্দের। তবে সত্য আমাকে বলতেই হবে। জন্মের সময় আমার বয়স অনেক বেশি ছিল। তখনই আমি প্রৌঢ়ত্বের কোঠায় ঢুকে পড়েছিলাম। তখনই আমার বাণপ্রস্থের বয়স।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.