বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩১৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. নূরুল হক, বীর প্রতীক অসীম সাহসী এক যোদ্ধার কথা দু-তিন দিনের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা অপারেশন করবেন। এই দলে আছেন মো. নূরুল হক।


অপারেশনের আগে নৌ-কমান্ডো কয়েকজন মিলে মানত করলেন, তাঁরা মহসিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করবেন। মানতের খাসি কিনতে একাই গেলেন মো. নূরুল হক। যাওয়ার পথে তাঁর চোখে পড়ল পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ। একটি রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। মো. নূরুল হক মনে মনে ভাবলেন, লোভনীয় শিকার। এ শিকার ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ভাবামাত্র আর দেরি করলেন না। নিজের কাছে থাকা গ্রেনেড বের করে দাঁতের কামড়ে সেফটি পিন খুলে ছুড়ে দিলেন জিপ লক্ষ্য করে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো সেটি।
লোকজন দিগিবদিক ছুটে পালাতে থাকল। গাড়িতে আগুন জ্বলছে, সামনের কাচ চূর্ণবিচূর্ণ। আরোহী সবাই আহত। একজনের এক হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। মো. নূরুল হক আর দেরি করলেন না; জনতার ভিড়ে মিশে গেলেন। এ ঘটনা চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটে। ১৯৭১ সালের মধ্য সেপ্টেম্বরে।
১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম নৌবন্দরে সফল অপারেশন শেষে মো. নূরুল হকসহ নৌ-কমান্ডোরা ফিরে গিয়েছিলেন ভারতে। কয়েক দিন পর তিনিসহ ১১ জন আবার চট্টগ্রামে আসেন। এবার কোনো সুনির্দিষ্ট টার্গেট নেই। কিন্তু তাঁরা চাইলেন, বন্দরে পুনরায় অপারেশন করতে। এদিকে অপারেশন জ্যাকপটের পর বন্দরে তুমুল কড়াকড়ি। তাঁদের পক্ষে সেখানে অপারেশন করা দুঃসাধ্য। এ অবস্থায় তাঁদের দলনেতা উৎসাহী হলেন বহির্নোঙরে অপারেশন করতে। এর আগে একদিন নূরুল হক একাই দুঃসাহসিকভাবে ওই অপারেশন করেন। পরে বহির্নোঙরে অপারেশনেও তিনি অংশ নেন। কিন্তু তাঁদের সেই অপারেশন ব্যর্থ হয় ট্র্যাজিক এক ঘটনার মধ্য দিয়ে।
নৌ-কমান্ডোরা রাতে ভাটার সময় সমুদ্রের পানিতে নেমে লক্ষ্যস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। অনেকক্ষণ সাঁতরেও তাঁরা সেখানে পৌঁছাতে পারেননি। পরে জোয়ারের ধাক্কায় তাঁরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় সমুদ্রের তীরে পৌঁছান। তখন তাঁদের কারও জ্ঞান ছিল না। ১১ জনের মধ্যে সাতজনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। তাঁরা সমুদ্রের যে কূলে অচেতন অবস্থায় পৌঁছান, সেখানে পাকিস্তানি সেনা বা তাদের সহযোগী কেউ ছিল না। গ্রামবাসীর চোখে পড়ে রক্ষা পান।
বাকি চারজনের ভাগ্যে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। তাঁদের একজন ছিলেন মো. নূরুল হক। তাঁরা মৃতপ্রায় অবস্থায় ভেসে ওঠেন মেরিন একাডেমির জেটির কাছে। সেখানে ছিল সশস্ত্র প্রহরা। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের আটক করে ব্যাপক নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। নির্যাতনে একজন (মোহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীক) শহীদ হন। মো. নূরুল হকসহ তিনজনকে পরে ঢাকা সেনানিবাসে পাঠানো হয়। সেখানেও তাঁদের ওপর চলে ব্যাপক নির্যাতন। স্বাধীনতার পর তাঁরা ছাড়া পান।
মো. নূরুল হক নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। ১৯৭১ সালে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো দলে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. নূরুল হককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৯৬।
মো. নূরুল হকের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম মহানগরের চাঁদগাঁওয়ের বাদামতলীর খাজা রোডে। তাঁর বাবার নাম শামসুল হুদা। মা মোস্তফা খাতুন। স্ত্রী হোসনে আরা বেগম। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১০ এবং মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডো, মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ, বীর প্রতীক। ছবি: রাশেদ মাহমুদ
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.