বিশ্ব বাঘ দিবস-ওদের বাঁচতে দিন by ইশতিয়াক হাসান

মৌলভীবাজারের জুড়ী রেঞ্জের রাগনার বনে বেড়াতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল অশীতিপর এক বৃদ্ধের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন যুবক বয়সে গরু চড়াতে গিয়ে এক লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর চোখের সামনে দলের সেরা কয়েকটি গরু মেরে রেখে গিয়েছিল বিশাল এক মর্দা বাঘ।


আবার চুনারুঘাটের কালেঙ্গার জঙ্গলে এক ত্রিপুরা হেডম্যান বলেছিলেন, স্বাধীনতার আগেও বিশালাকার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কান-ফাটানো গর্জনে কাঁপত গোটা বন। একসময় চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, মধুপুর, এমনকি ঢাকার আশপাশের এলাকায়ও পাওয়া যেত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ১৮৩৭ সালের দিকেও বাঘের হাতে গড়ে প্রতিবছর ঢাকায় একজন মানুষ মারা যেত। সার্জনের চাকরি নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন জেমস টেলর। ১৮৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর 'টপোগ্রাফি অব ঢাকা' বইয়ে সে সময়কার ঢাকার উত্তর দিকের জঙ্গলগুলোতে প্রচুর বাঘ-চিতাবাঘের উপস্থিতির কথা বলেছেন টেলর। তখন শিকারিদের বাঘ শিকারের জন্য পুরস্কৃত করা হতো। ১৮০৪ সালে শিকার করা ২৭০টি বাঘের চামড়া জমা পড়ে ঢাকার শাসকের অফিসে। ১৯০৭-১০ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০-এ। সুসংয়ের জমিদার ১৯৪৬ সালে শালবনে বাঘ মারেন। এমনকি বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কিংবা তার পরও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাঘ দেখা কিংবা শিকারের বর্ণনা পাওয়া গেছে। এনায়েত মওলার 'যখন শিকারি ছিলাম' বইয়ে ১৯৫০-এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাসালং রিজার্ভে বাঘ শিকারের কথা উঠে এসেছে। সিলেটের বনে বাঘ শিকারের গল্পও শুনিয়েছেন লেখক। কাসালং রিজার্ভে বাঘ দেখার কথা বলেছেন ইউসুফ এস আহমদ তাঁর 'উইথ দ্য ওয়াইল্ড এনিম্যালস অব বেঙ্গল' বইয়ে। এদিকে এরশাদউল্লা খানের 'চট্টগ্রামের শিকার কাহিনী' বইয়েও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় চুনতি অভয়ারণ্যসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বাঘ শিকারের প্রমাণ মেলে। প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী নওয়াজেশ আহমদ শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়ার বনে বাঘ দেখেছেন ১৯৬০-এর দশকে। এর কাছাকাছি সময়ে সেখানে বাঘ মারেন এক সেনা কর্মকর্তা। শিকারি আবদুর রহমান চৌধুরীর বইগুলোতেও একসময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের লাউড়ের জঙ্গলে প্রচুর বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ সব কিছুই এখন স্মৃতি। বাঘের দেখা এখন মেলে কেবল সুন্দরবনে। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘও কি খুব ভালো আছে? মনে হয় না। সুন্দরবনে শিকার করা বাঘের চামড়া ও মাথা উদ্ধার হতে দেখে মনে সংশয় দানা বাঁধতেই পারে। একে তো চোরা শিকারির উৎপাত, তার ওপর আবার আছে নানা ঝামেলা; বাঘ যাবে কোথায়? খাবারের সংকট, সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন গ্রাম আর বনের মাঝখানের নদী শুকিয়ে যাওয়া প্রভৃতি কারণে প্রায়ই লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বাঘ। আর একবার গ্রামে ঢুকে মানুষের নজরে পড়লে আর রেহাই নেই। পিটিয়ে তাদের মারে গ্রামবাসী। অথচ বাঘ আছে বলেই এখনো সুন্দরবন আছে। কিভাবে? বাঘের ভয় না থাকলে কবে এই বন উজাড় করে দিত কাঠচোররা! আর বন না থাকলে বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর কী অবস্থা হতো? আজ বিশ্ব বাঘ দিবস। চলুন, আজ থেকে যেন আর একটি বাঘও অস্বাভাবিকভাবে মারা না পড়ে, আমরা সেই চেষ্টা করি। মানুষের একটু আন্তরিকতা আর সরকারের কড়া নজরদারি থাকলে এটা তেমন কঠিন হবে না। আর যদি এটা করা না যায়, তাহলে অচিরেই হয়তো বাংলাদেশের আরো অনেক বনের মতো সুন্দরবন থেকেও হারিয়ে যাবে বাঘ। কারো কারো মতে, সাঙ্গু-মাতামুহুরী রিজার্ভসহ বাংলাদেশের ভারত-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কিছু বনে এখনো বাঘের দেখা মেলে। হয়তো এরা এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা নয়, আসে মাঝেমধ্যে। তার পরও এই বনগুলো চিহ্নিত করে এগুলোতে বাঘের থাকার পরিবেশ যেন নষ্ট না হয়, সে ব্যবস্থাও নেওয়া উচিত।
ইশতিয়াক হাসান

No comments

Powered by Blogger.