শিক্ষা-শিল্পায়নের নবক্ষেত্র এবং অর্থনীতির জন্য সুবার্তা by সৈয়দ ফখরুল হাসান মুরাদ

গত মার্চে প্রধানমন্ত্রী ঢাকার তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেঙ্টাইলসের (ইটঞ) শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। শুরু হয় শিল্পায়নের নবদিগন্তের অভিযাত্রা। উন্নয়নের পথে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার প্রত্যয়ে পথচলা শুরু হলো দীর্ঘদিনের স্বপ্নের একটি ব্যতিক্রমধর্মী উচ্চতর বিদ্যাপীঠের। দাবির বাস্তবায়ন হলো বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।


বাংলাদেশে বস্ত্র ও পাট শিল্পের ইতিহাস যেমন প্রাচীন, অর্থনীতিতে এই শিল্প দুটির অবদান তেমনি অনেক বেশি। পাট শিল্পের আগে থেকেই বস্ত্র শিল্প এ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপ যে পরিমাণ বস্ত্র আমদানি করত, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ বস্ত্র ও তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিতে ২০১০ সাল থেকে দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে চিহ্নিত হয়েছে। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বস্ত্র ও তৈরি পোশাক আমদানিকারক দেশ। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারকের মর্যাদা লাভ করেছে। এখানে আরো বলে রাখা ভালো, বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক মূলত ওভেন ও নিট (ননওভেন বাদ দিলে) খাতে বিভক্ত। নিট বস্ত্র ও পোশাক উৎপাদনে চীনের পরই বাংলাদেশের স্থান। চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি দ্রুততর হওয়ার কারণে বাংলাদেশের এ খাতে প্রথম হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে অতিশ্রমনির্ভর বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্প সে দেশ থেকে স্থানান্তরিত হয়। তাই চীন থেকে সে শিল্প বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনাম ইত্যাদি স্থানে চলে যাচ্ছে। সে কারণেই বাংলাদেশের সমগ্র বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পের অবস্থার প্রভূত উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিপুল প্রস্তুতির প্রয়োজন। বাংলাদেশ টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় সে প্রস্তুতির পথে অন্যতম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। টেঙ্টাইল শিক্ষার নবযাত্রা শুভ হবে, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছে যাবে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-গবেষকরা দেশের সুনাম পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবেন বলেই সবাই আশা করছে।
জন্মরহস্য আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে পাটের নবদিগন্ত উন্মোচিত হতে চলেছে। এ আবিষ্কারের ফলে পাটের শক্তভাব দূর করা, নরম পাটতন্তুর আবিষ্কার এখন সময়ের ব্যাপার। সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন পাট দিয়ে ডেনিম বস্ত্রের সুতা প্রস্তুত হবে। আর ডেনিমই হচ্ছে বর্তমান সময়ের পোশাক শিল্পে সর্বাধিক ব্যবহৃত কাপড়। পাট প্রকৃতিবান্ধব, তাই কৃত্রিম আঁশের পরিবর্তে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। প্যাকেজিং টেঙ্টাইল হিসেবে পাটের ব্যবহার আরো অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে। এসব বিষয়ে শিল্প ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ প্রয়াসে দেশের শিল্পের অবস্থার যেমন অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশে পেঁৗছা সহজতর হবে। বাংলাদেশে বস্ত্র শিল্পের ইতিহাস প্রাচীন হলেও টেঙ্টাইল শিক্ষার ইতিহাস ততটা প্রাচীন নয়। প্রাচীনকালে এই শিল্পের প্রসার ঘটেছে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় দক্ষ অথচ অশিক্ষিত তাঁতিদের কর্মদক্ষতায়। কার্পাস থেকে মিহি সুতার আবিষ্কার এবং উৎপাদন তেমনি শিক্ষার আলো হতে দূরে থাকা সুবিধাবঞ্চিত তাঁতিরাই করেছিলেন। ১৯২১ সালে ইস্ট বেঙ্গল উইভিং স্কুলের যাত্রা শুরু হয় ঢাকার নারিন্দায়। এই স্কুলে আর্টিসান কোর্স করানো হতো। শোনা যায়, খুলনায় ১৯১১ সালে উইভিং স্কুল চালু হয়েছিল। তখন পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে তেমনি একটি স্কুল ছিল। যার উন্নতি হয়েছিল অনেক বেশি। ৪০ দশকে শ্রীরামপুর থেকে ডিপ্লোমা দেওয়া হতো। অনেক বাংলাদেশি ওই স্কুল থেকে ডিপ্লোমা নিয়ে নারিন্দায় শিক্ষকতা করতেন। ১৯৫০ সালে ইস্ট পাকিস্তান টেঙ্টাইল ইনস্টিটিউট নামকরণের মাধ্যমে ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয় এবং তেজগাঁও শিল্প এলাকার যে স্থানটিতে বর্তমানে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট রয়েছে, সেখানে টেঙ্টাইল ইনস্টিটিউট চালুর সিদ্ধান্ত হয়। সে সময় কলম্বো প্ল্যানের আওতায় ঢাকা পলিটেকনিকের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় ইনস্টিটিউটের জন্য স্থান নির্ধারণ ও নির্মাণ করা হয়নি। ইস্ট পাকিস্তান টেঙ্টাইল ইনস্টিটিউটের জন্য নির্মিত ভবনে ওইসব যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয় এবং সেখানে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ইতিমধ্যে পাট ও বস্ত্র শিল্পের বিপুল বিকাশ ঘটে। বলা নিষ্প্রয়োজন, স্বাধীনতাপূর্বকালে পাটই ছিল পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান শিল্প খাত এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের শতকরা ৮০ শতাংশ আসত কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি থেকে। দেশের অন্য প্রধান শিল্পখাত বস্ত্রখাত। আর ওই শিল্প দুটির মূল চালিকাশক্তি ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান টেঙ্টাইল ইনস্টিটিউটের পাস করা প্রযুক্তিবিদরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই ইনস্টিটিউটের নাম হয় বাংলাদেশ টেঙ্টাইল ইনস্টিটিউট। ইতিমধ্যে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। ফলে উচ্চতর প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন টেঙ্টাইল প্রযুক্তিবিদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৭৭ সালে টেঙ্টাইল ইসস্টিটিউটে তীব্র ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিষয়টি অনুধাবন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি-ইন-টেঙ্টাইল টেকনোলজি ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশ টেঙ্টাইল ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তিন করে কলেজ অব টেঙ্টাইল টেকনোলজি করা হয়। অতিসম্প্রতি তা কলেজ অব টেঙ্টাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে রূপান্তরিত হয়। যদিও কলেজ অব টেঙ্টাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নামে এই প্রতিষ্ঠানটি সমধিক খ্যাত হয়। ১৯৮০ শিক্ষাবর্ষে প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি গ্রহণ করেন।
শিল্পের বিকাশ এবং বিশ্ববাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার ফলে উচ্চশিক্ষিত প্রকৌশলীর সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র শিল্পের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা, কারিগরি বিষয় নিয়ে গবেষণা ও আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে ১৯৯৭ সাল থেকেই টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং এমএসসি কোর্স ও পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর দাবি ওঠে। তখন থেকেই টেঙ্টাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী ও পেশাজীবী সংগঠন আইটিইটি টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি বিভিন্ন পর্যায়ে উত্থাপন করে আসছিল। দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল ইনস্টিটিউট বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলেও টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিলম্বিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে।
২০০৬ সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের স্বাক্ষরে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। বুয়েটের তৎকালীন ভিসি প্রফেসর আনোয়ারুল আজিমকে আহ্বায়ক, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি প্রফেসর আবুল বাশারকে সদস্য-সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রতিবেদন প্রদান করে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যাবে না_এ সন্দেহে টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি আটকে যাওয়ার অবস্থার উদ্ভব ঘটে। তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুরকে কলেজ অব টেঙ্টাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক সভায় যখন বোঝানো হয়, পৃথিবীর সর্বত্র বিশেষায়িত শিক্ষায় উচ্চতর কোর্স প্রবর্তনে এমনতর বাধাবিপত্তি থাকেই। বাংলাদেশেও টেঙ্টাইলে ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তনের সময় শিক্ষকের এই সংকট ছিল। কিন্তু ডিগ্রি কোর্স বন্ধ থাকেনি। স্নাতকোত্তর কোর্সও সেভাবেই চলবে। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বিষয়টির সপক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন। এভাবেই কাজ এগিয়ে চলছিল। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালে সময় যেতে থাকে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর আগ্রহে বিষয়টি দ্রুত এগিয়ে যায়। গত ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১০ বাংলাদেশ টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ সংসদে গৃহীত হয়। বাংলাদেশ টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী ২২ জিসেম্বর, ২০১০ থেকে কার্যকর হয়েছে। গত ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেকের নিরলস প্রচেষ্টার পর বাংলাদেশ টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ দরকার। শুধু দেশি শিক্ষার্থী নন, বিদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষকরা গবেষণার জন্য এখানে আসবেন। জিএসপি প্রদানের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কান্ট্রি অব অরিজিনের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এনেছে, তাতে প্রাইমারি টেঙ্টাইল শিল্প যে হুমকির মুখে পড়েছে, তা থেকে উদ্ধারের জন্য উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, উৎপাদনের মান উন্নয়নে গবেষণা একান্ত জরুরি। স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন সামগ্রী উৎপাদন করে রপ্তানি করতে হবে। নতুন নতুন বাজার দখল করতে হবে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে সবাই আশাবাদী।

লেখক : অধ্যাপক, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি ও টেঙ্টাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.