চালচিত্র-ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট ।। ভাবমূর্তি ও ক্যাঙ্গারু কোর্ট সমাচার by শুভ রহমান

ইতিহাসের আরেক মোড় পরিবর্তন ঘটল। সূচিত হলো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নবতর পর্যায়। ইতিহাসের পায়ে এখন ঝড়ের গতি। ইতিহাস তার লক্ষ্যপথে অবিচল রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীর বিচার অনুষ্ঠানের মতো বাংলাদেশ তার আরেক ঐতিহাসিক দায় শোধ করল।
নবজাগ্রত দেশগুলোকে নিয়ে এ উপমহাদেশ হবে শান্তির আবাসভূমি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বাস্তবে মূর্ত করে তুলতে একাত্তরে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর সর্বশক্তি নিয়ে সারা বিশ্ব তোলপাড় করার পেছনে স্পষ্টত সেই প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও স্বপ্নও কাজ করেছিল। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সে ঐতিহাসিক উপলব্ধিরই প্রকাশ ঘটল গত সোমবার বঙ্গভবনে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, বিদেশিদের জন্য স্বাধীনতা সম্মাননা পদক (মরণোত্তর) প্রদানের মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের বর্তমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সোনিয়া গান্ধীর হাতে এ সম্মাননা পদক তুলে দেন। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্বাত্মক সমর্থন জোগানোর পেছনে ইন্দিরা গান্ধীর শুধু শান্তিনিকেতনে অধ্যয়ন, বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি জাতিকে ভালোবাসাই নয়; তার চেয়েও বেশি কিছু ছিল বলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দানের অনুষ্ঠানে প্রদত্ত আবেগপূর্ণ ভাষণে সোনিয়া গান্ধী সংগতভাবেই উল্লেখ করেন। একই সময়ে ঢাকায় প্রথম আন্তর্জাতিক অটিজম সম্মেলনে শেখ হাসিনা-সোনিয়া বৈঠকে জঙ্গিবাদ দমনে দুই দেশের সম্মিলিত প্রয়াসের মতৈক্য ঘোষণা তাৎপর্যপূর্ণ।
ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মাননা জানানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সুপ্রতিবেশীসুলভ সহযোগিতার সম্পর্কের নতুন স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় সূচিত হলো। দুই দেশের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক শক্ত ভিতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। বাংলাদেশ যে ভারত ও প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর ঋণ বিস্মৃত হয়নি, বাঙালি জাতি যে অকৃতজ্ঞ নয়, আজ ইতিহাসের দায় শোধ করে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বকে তা জানিয়ে দিলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি জাতির, ভারত ও ভারতের জনগণের ভাবমূর্তিকে সর্বকালের জন্য গৌরবমণ্ডিত করে তুললেন। কোনোভাবেই আজকে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বাইরের কোনো বৈরী শক্তির পক্ষেই আর সে ভাবমূর্তিকে এতটুকু ম্লান বা ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা কখনো সফল হবে না। সম্মাননা গ্রহণ অনুষ্ঠানে সোনিয়া গান্ধী বলেছেন, এ সম্মান শুধু ইন্দিরা গান্ধীর একার নয়, সমগ্র ভারতের।
প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা গ্রহণের জন্য তাঁর পুত্রবধূ ও বর্তমানে ভারতে ক্ষমতাসীন শাসকজোট সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যাল্যায়েন্স বা ইউপিএ) ও জাতীয় কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধীকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ জ্ঞাপন, তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা জানানোর ঐতিহাসিক সঠিক পদক্ষেপ দেশের জনগণকে তো সন্তুষ্ট করেছেই, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বৈরিতাকেও তা জয় করতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপি-নেতৃত্ব শুধু সোনিয়া গান্ধীকে আন্তরিকভাবে স্বাগতই জানাননি, অত্যন্ত গঠনমূলক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়ে দুই দেশের মধ্যকার সব বিরোধ, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও সীমান্ত সমস্যাসহ যাবতীয় সমস্যা শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে মীমাংসার সঠিক আহ্বানও জানিয়েছেন। বিএনপি-নেতৃত্ব অন্তত এই একটি উপলক্ষে অতীতের অকারণ ভারতবিদ্বেষের পথ পরিহার করে, দীর্ঘ সময়ের নেতিবাচক রাজনীতির ভ্রান্ত পথ ছেড়ে সত্যিকার সংসদীয় রাজনীতির রীতি মেনে ইতিবাচক ও গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। সচেতন দেশবাসী মাত্রই তাঁদের এই ইতিবাচক ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়ে এরপর সব সময়ের জন্য সব ক্ষেত্রেই সে ভূমিকার যৌক্তিক প্রসারণ কামনা করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সর্বাংশে সফল ও জনকল্যাণকর করে তোলার ঐকান্তিক প্রত্যাশাই পোষণ করছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইতিপূর্বে দেশের আইনশৃঙ্খলা, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক অধিকার ও ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে শাসক মহাজোটের সঙ্গে বিরোধী দলের ঘটে যাওয়া কিছু আপাতবিরোধকে কেন্দ্র করে লাগাতার সংসদ বর্জন, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, গণ-অনশন প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দেশের রাজনীতি এক অনাকাঙ্ক্ষিত ও নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আগামী দিনে আর তার জের টানা হবে না এবং আন্দোলনের নামে সংসদবহির্ভূত বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক ও বৈরী কার্যকলাপ বাতিল করে দিয়ে বিরোধী দল সংসদে ফিরবে_এটাই দেশের নতুন ও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশবাসী সংগতভাবেই কামনা করছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নিজেও তার শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়ে এই কঠিন বাস্তবতাকেই প্রত্যক্ষ ও উপলব্ধি করেছে যে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের ওপর ভর করে এবং স্বাধীনতার স্থপতির অমর্যাদা ও অবমাননা করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করে এ দেশে রাজনীতি করা কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিই সমর্থন করে না। সোনিয়া গান্ধীকে স্বাগত জানানোসহ সব ব্যাপারেই তাদের নতুন বোধোদয়ের পরিচয় দিয়ে বিএনপি ইতিহাসের বর্তমান মোড় পরিবর্তনে শরিক হয়ে ইতিহাসের গতিপথের সঙ্গেই থাকবে_জনগণের মনে এ প্রত্যাশা জন্মেছে। আমরাও আশা করি, এবার বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি সঠিক রাজনৈতিক পথ অবলম্বন করে এ দেশের আগামী দিনের রাজনীতিতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তির বলিষ্ঠ স্বাক্ষর রাখবে এবং ভারতসহ দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শাসক মহাজোটের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক দৃঢ়তর করার উদ্যোগ এবং জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ দমনের যৌথ প্রয়াসকে সর্বতোভাবে সফল করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রাখবে।
প্রসঙ্গত, আমরা শাসক মহাজোটকেও তাদের বর্তমান মেয়াদকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণেরও আহ্বান জানাব, অসাধু ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করে জনগণের দুর্ভোগ দূর করে ত্বরিত চিনি, ভোজ্য তেলসহ বিভিন্ন পণ্যমূল্য বৃদ্ধি তাৎক্ষণিকভাবে রোধ করার ক্ষেত্রে ক্ষমাহীন গাফিলতির আর পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না। বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সীমান্তহত্যা, অনিয়ন্ত্রিত সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যা, বিচারবহির্ভূত 'হত্যা', গণপিটুনিতে করুণ ও বীভৎস ছাত্রহত্যা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কলঙ্কস্বরূপ হত্যা-সন্ত্রাসের আর পুনরাবৃত্তি দেশবাসী দেখতে চায় না। ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, মুজিব-ইন্দিরা গান্ধী চুক্তির বিভিন্ন শর্তের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, প্রবাসীদের স্বার্থরক্ষা, বিভিন্ন সাংবিধানিক ক্ষমতা ও মর্যাদাকে অতীতের দোহাই দিয়ে একইভাবে নিজেদের বিতর্কিত করে তোলা, নিজেরাই নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া_এসবেরও দেশবাসী এবার পরিসমাপ্তি দেখতে চায়। মিথ্যাচার, অনভিপ্রেত ক্যাঙ্গারু কোর্ট ও ক্যাঙ্গারু বা জংলি শাসন তথা সামরিক শাসনের প্রসঙ্গ নিয়ে সুস্থ রাজনীতির পথকে কর্দমাক্ত করে তোলা, মহাজোট সরকার এসবও চিরতরে বন্ধের বাস্তব পদক্ষেপ নেবে, জনগণের এমন প্রত্যাশা পূরণ করবে_এটাই সর্বতোভাবে কাম্য। পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ দেশে বাস্তবেই আর ক্যাঙ্গারু শাসন, ক্যাঙ্গারু কোর্টের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে দেশকে অন্ধকার অতীতে নিক্ষেপ করার পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছেন। কাজেই ক্যাঙ্গারু কোর্টের প্রসঙ্গ আনা এখন সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ও আত্মঘাতী এবং নিজেদের সুবিধামতো তা ব্যবহার কার্যত অপরাজনৈতিক বা অনৈতিকও।
মনে রাখা দরকার, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলে ব্যক্তির বা তার সীমিত গণ্ডির কিছু ক্ষতি হতে পারে মাত্র, কিন্তু প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি মসিলিপ্ত করার প্রক্রিয়া দেশ ও জাতির সমূহ ভাবমূর্তিকে মসিলিপ্ত করে দেশের গণতন্ত্র, জনস্বার্থ ও দেশের স্বার্থের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে থাকে। আমরা যেন ভুলেও আর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ও ভ্রান্ত পথ অবলম্বন না করি, শাসক মহাজোট ও বিরোধী দল_সবার কাছেই সমভাবে দেশবাসীর এই প্রত্যাশা।
বস্তুত, ইতিহাসের আজকের নতুন পর্ব সমগ্র জাতির জন্য সব ক্ষেত্রে এক নতুন দিকনির্দেশ এনে দিয়েছে। সব ক্ষেত্রেই সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে শান্তির আবাসভূমিতে পরিণত করাই আজকের দিনে সর্বোচ্চ দেশপ্রেম হিসেবে পরিগণিত হোক_এটাই আমাদের ঐকান্তিক কামনা।
২৬.৭.২০১১

No comments

Powered by Blogger.