চারদিক-হামিম নেই, আছে স্মৃতির হাতছানি

ছুটির পর স্কুল থেকে বের হয়েই টিফিন খেতে চায়। টিফিন বক্স খুলে পাউরুটি ও ডিম ভাজিতে এক কামড়ও দেয়। স্কুলের মাঠে হইচই, প্রচুর ধুলা। তাই ধমক দিয়ে বক্স বন্ধ করে রাখি। বলি, বাসায় গিয়ে খেয়ো। খাওয়া আর হয় নাই।’ এটুকু বলেই আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না সোনিয়া শেখ।


টিফিন বক্সটি ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের হামিম শেখের। গত বছর ৩ ফেব্রুয়ারি স্কুল ছুটির পর মায়ের হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার সময় মধুমতি পরিবহনের এক ঘাতক বাস ছোঁ মেরে নিয়ে যায় হামিমকে। কিছুক্ষণ আগে যে হামিম টিফিন খাওয়ার জন্য বায়না করছিল, সেই হামিমই কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনের সড়কে পড়ে আছে। মাথার মগজ বের হয়ে গেছে। সে চলে গেছে অজানা দেশে, যেখান থেকে আর কেউ ফেরে না।
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে কেজি শ্রেণীতে পড়ত হামিম। হামিমের স্পাইডারম্যান কার্টুনের ছবি আঁকা ব্যাগটি স্কুলেই ছিল। গত সপ্তাহে তা হাতে পেয়েছেন হামিমের বাবা-মা। ব্যাগটি আনলেও খুলে দেখার সাহস পাননি। প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও ফটোসাংবাদিক সেই ব্যাগটি দেখতে চাইলে হামিমের মা তা আনলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগটি খুললেন। তার পরই সেদিনের সব স্মৃতির ঝাপটা এসে লাগল চোখেমুখে। এতক্ষণ সোনিয়া শেখ ও হামিমের বাবা মোতালেব শেখ নিজেদের শান্ত রাখার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তা আর রক্ষা হলো না।
ব্যাগের ভেতর থেকে টিফিন বক্সটি বের হলো। বাসের আঘাতে বক্সের একটি কোনা ভেঙে গেছে। পাউরুটির টুকরোটি কালচে হয়ে বক্সের সঙ্গে লেগে আছে। সোনিয়া বলেন, ‘অ্যাই দেখেন কচুশাক, মারা যাওয়ার আগের দিন ও কচুশাক খাইতে চাইছিল। তাই শাক কিইন্যা ওর ব্যাগে রাখছিলাম।’ পলিথিনে মোড়ানো সেই কচুশাক শুকিয়ে লেপ্টে আছে। ব্যাগ থেকে মোচড়ানো অনেকগুলো বই ও খাতা বের হলো।
হামিম নেই। কিন্তু বাসের তলায় পিষ্ট হওয়ার আগে যখন মায়ের হাত থেকে ছোট হাতটি ছুটে যাচ্ছিল, তখন হামিম ‘আম্মু’ বলে চিৎকার করে ওঠে। হামিমের মা সেই ডাক এখনো স্পষ্ট শুনতে পান। সেই ডাক শুনেও তিনি কিছু করতে পারেননি। বাসটি প্রথমে সোনিয়া শেখকে আঘাত করে। এতে করে তিনি বাসের তলায় চলে যান। বাসটি না থেমে আবার চলতে শুরু করলে ছোট্ট হামিমও বাসের তলায় চলে যায়। মা যখন তাকালেন, তখন শুধু দেখলেন তাঁর হামিমের মাথা থেকে মগজ বের হয়ে গেছে। এ ঘটনায় সোনিয়া শেখও চোখে প্রচণ্ড আঘাত পান।
আজ শনিবার, ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। দিনের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় আর যেন কোনো হামিমকে এভাবে চলে যেতে না হয়, তা নিয়ে অনেক কথা হবে। কিন্তু তাতে হামিমের মা-বাবা কি কোনো সান্ত্বনা পাবেন?
পুরান ঢাকার আলুবাজারে হামিমদের বাসায় বসে কথা বলতে বলতে একসময় হামিমের বাবা ও মায়ের কান্না থামে। কণ্ঠে জমতে থাকে ক্ষোভ। সোনিয়া বলেন, ‘ছিনতাই করলে মানুষ ছিনতাইকারীকে পিটাইয়া মাইরা ফালায়। আর গাড়ির চালকেরা মানুষ মাইরা ফালাইলেও কেউ কিছু বলে না।’
হামিমদের বসার ঘরেই অনেক বড় করে হামিমের একটি ছবি বাঁধানো আছে। হামিমের প্রিয় খেলনা হেলিকপ্টার, তার জামাকাপড় সব গুছিয়ে রেখেছেন হামিমের মা। ছেলের জন্মের পরই ছেলের নামে মোতালেব শেখ তাঁর পোশাক কারখানার নামকরণ করেছিলেন।
মোতালেব শেখ বলেন, ‘হামিম চাইছিল বড় হইয়া হেলিকপ্টার চালাইব, আর আমি চাইছিলাম ওরে অনেক বড় মানুষ বানামু। বিদেশে পড়তে পাঠামু। কিছুই হইল না।’
হামিমের বাবা ও মা এখনো রাস্তায় বের হতে ভয় পান। রিকশার পেছনে বড় বাস দেখলেই আঁতকে ওঠেন। প্রিয়জন ঘরে না ফেরা পর্যন্ত মনে শান্তি পান না। নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্রথম দিকে বিভিন্ন আন্দোলন-কর্মসূচিতে যোগ দিলেও এখন আর খুব একটা উৎসাহ পান না।
সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারানো এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে প্রতিবাদ করে যাওয়া নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল আছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সড়ক দুর্ঘটনাবিষয়ক সেলও আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারি হিসাবে বছরে গড়ে প্রায় চার হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। বেসরকারি হিসাবে বছরে মারা যায় প্রায় ১২ হাজার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৭ সালের এক হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১২ দশমিক ৬ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
আবার হামিমের কথায় ফিরে আসি। হামিমের রেখে যাওয়া অসংখ্য স্মৃতি শুধু হাতছানি দিতেই থাকবে। হামিমের মা কাপড় দিয়ে ঢাকা রাস্তায় পড়ে থাকা হামিমের লাশের ছবিটি দেখালেন। ছবিতে ছোট দুটি পা ও দুটি হাত দেখা যাচ্ছে। মাথার কাছে রক্ত ও ছিটকানো মগজ। হামিমের মায়ের মুখে আবারও ক্ষোভের আগুন। লালচে হয়ে যাওয়া সে মুখে আর কোনো কথা বেরোল না।
মানসুরা হোসাইন

No comments

Powered by Blogger.