পঞ্চদশ সংশোধনী : শাসকগোষ্ঠীর দক্ষিণে মোড় by হায়দার আকবর খান রনো

বাংলাদেশ সম্ভবত এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মতাদর্শের পশ্চাদপসরণ এক গভীর আশঙ্কারও সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা বলতে আমি সেই সব প্রধান রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি, যারা রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে এখনো প্রভাব বিস্তার করে আছে।
দুই দশক ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাক্রমে আসছে বা যাচ্ছে দুটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুটি দলের মধ্যে অর্থনৈতিক নীতির বিষয়ে কখনো কোনো পার্থক্য না থাকলেও এবং শ্রেণীগতভাবে তারা উভয়েই একই লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করলেও, সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে উভয়ের একই রকম নীতি থাকলেও দুই দলের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা করে থাকেন। পার্থক্যের কিছুটা ছিল ইতিহাস সংক্রান্ত, যা অতীতের বিষয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল অন্যত্র। আওয়ামী লীগ নিজেকে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে পরিচয় দেয় এবং মুখে হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। অন্যদিকে বিএনপির রাজনীতির একটা মৌল বিষয় হলো ভারতবিরোধিতা এবং মৌলবাদী ইসলামপছন্দ দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যে কারণে তারা খুব সহজেই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন ও সরকার গঠন করতে পেরেছে। আওয়ামী লীগও যে সেক্যুলারিজম প্রশ্নে সব সময় খুব নীতিনিষ্ঠ থাকতে পেরেছে, তা নয়। বরং মৌলবাদের সঙ্গে আপস করা, নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া, এমনকি সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার একাধিক দৃষ্টান্ত আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাসে পাওয়া যাবে।
একটু ইতিহাসের পাতা নেড়েচেড়ে দেখার চেষ্টা করা যাক। এ কথা ভুললে চলবে না যে একদা মুসলিম লীগের গর্ভ থেকেই আওয়ামী লীগের জন্ম। অবশ্য দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই দলের রূপান্তরও হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এমনকি তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, সবাই ছিলেন মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানী গঠন করলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ! তখনো পর্যন্ত আদর্শগতভাবে মুসলিম লীগের ধারা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি, যদিও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়ার ফলে দলটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র পেয়েছিল। কিন্তু তার এক বছরের মধ্যেই দলটিতে বিভেদ এসেছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সিয়াটো-সেন্টো, পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে দাঁড়ালেন। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনেরও বিরোধিতা করছিলেন। সেদিন মওলানা ভাসানী ও কমিউনিস্টরা গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল 'ন্যাপ'। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অবস্থান নিয়েছিল চরম দক্ষিণে। সেই আওয়ামী লীগ ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। তারা ভারত বিদ্বেষীও ছিল। তারা প্রচার করেছিল ঘঅচ মানে হলো ঘবযবৎঁ অরফবফ চধৎঃু।
যাই হোক এক দশক পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সেই পুরনো চরিত্র পাল্টে ফেলে রাডিক্যাল জাতীয়তাবাদী চরিত্র লাভ করেছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। অবশ্য এটাও সত্য যে মুক্তিযুদ্ধে অন্যান্য বামশক্তিরও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা, যা বুর্জোয়া লেখক ও ইতিহাসবিদরা প্রায়ই উপেক্ষা করে থাকেন।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের যে সংবিধান রচিত হয়েছিল, তা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংবিধান হিসেবে ছিল চমৎকার, যদিও তার কয়েকটি দুর্বল দিক ছিল, যা তখনই বামপন্থী শিবিরের পক্ষ থেকে আপত্তি করা হয়েছিল। আপত্তির বিষয়গুলোর দুটি প্রধান_১. ১৯৭২-এর সংবিধানে সংখ্যালঘু জাতি ও আদিবাসীদের সংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না এবং ২. অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হিসেবে বর্ণিত হলেও তা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। অর্থাৎ ওসব কথার কথা হিসেবে ছিল মাত্র। যে সংবিধানে 'সমাজতন্ত্র' রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত, সেই সংবিধানে সব নাগরিকের এসব মৌলিক চাহিদা পূরণের কোনো সুযোগ না থাকা আসলে ছিল সমাজতন্ত্রের নামে প্রতারণা মাত্র।
রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যে স্থান পেয়েছিল, তা ছিল পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও '৭১-এর সশস্ত্র যুদ্ধেরই ফসল। এটাকে কোনো দল বা ব্যক্তির দান মনে করা ঠিক হবে না। অবশ্য এ কথা বলে রাখা দরকার যে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হলেও সমাজতান্ত্রিক নীতি কখনোই গ্রহণ করা হয়নি।
স্বাধীনতাপরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ শাসনামলেই এই সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। প্রথম ও তৃতীয় সংশোধনী ছিল প্রয়োজনীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের মতে, এই দুটি ছাড়া আর মাত্র আরেকটি সংশোধনী, ১৯৯১ সালে যার দ্বারা প্রেসিডেন্সিয়ালব্যবস্থার বদলে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো_এই তিনটি ছাড়া আর সব সংশোধনী আনা হয়েছিল বিশেষ ব্যক্তি, দলের স্বার্থে বা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার প্রয়োজনে, জনস্বার্থে নয়। দ্বিতীয় সংশোধনী দ্বারা প্রথম জনগণের অধিকারকে সঙ্কুচিত করা হলো। জরুরি আইনের বিধান তখুনি সংযুক্ত হলো। এর পর বহুল আলোচিত চতুর্থ সংশোধনী সংবিধানের মূল স্পিরিটকেই বদলে দিয়েছিল। তারপর থেকে সংবিধান নিয়ে কাটাছেঁড়া চলতেই থাকে।
পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর লক্ষ্য ছিল দুটি সামরিক শাসন আমলকে বৈধতা দান করা। জেনারেল জিয়া সামরিক শাসনের ফরমান দ্বারা সংবিধানেও বেশ কিছু সংশোধনী এনেছিলেন। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে পরিবর্তন। 'ধর্মনিরপেক্ষতা' ও 'সমাজতন্ত্র' এই দুটি কথা মূলনীতির জায়গা থেকে অপসারিত হলো। তা ছাড়া সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' শব্দটি যুক্ত হলো। জিয়াউর রহমান সংবিধানে ইসলামীকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, এরশাদ তাকে আরো জোরদার করেছিলেন সংবিধানে 'ইসলাম'কে 'রাষ্ট্রধর্ম' হিসেবে ঘোষণা দিয়ে।
প্রগতিশীল মহলের বহুদিনের দাবি ছিল, '৭২-এর সংবিধানে বিবৃত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ফিরিয়ে আনা। কিন্তু রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে তা অর্জিত হওয়ার আগেই হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের এক রায় সেই কাজটি করে দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। ফলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই ফিরে গিয়েছিলাম '৭২-এর সংবিধানের জায়গায়। কারণ কোর্টের রায়ে বলা ছিল যে পঞ্চম সংশোধনীতে যে চতুর্থ সংশোধনী (বাকশাল ব্যবস্থা) বাতিল করা হয়েছিল, তা যথাযথ ছিল। অর্থাৎ তৃতীয় সংশোধনী পর্যন্ত '৭২-এর সংবিধান বহাল হয়ে গেল। তবে পঞ্চম সংশোধনী পরবর্তী সংশোধনীগুলো (সপ্তম সংশোধনী বাদে) অপরিবর্তিত থাকছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের খোলনলচে পাল্টে ফেলে একেবারে নতুন একটা সংবিধান হাজির করা হয়েছে, যা বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে পাস হয়েছে। একজন মাত্র স্বতন্ত্র সদস্য বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ নেতারা প্রথমে অনেক হুঙ্কার দিলেও শেষ পর্যন্ত এই সংশোধনীর পক্ষেই ভোট দিয়েছেন।
এটা দেখানো সম্ভব যে এই সংশোধনীতে জিয়া প্রবর্তিত বিধানগুলোর একটা বড় অংশ রাখা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো,
১. জিয়া প্রবর্তিত 'বিসমিল্লাহ'কে রেখে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে আসলে বাতিল করা হয়েছে। ২. এরশাদ প্রবর্তিত 'অষ্টম সংশোধনী' অর্থাৎ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিধান অপরিবর্তিত রেখে প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের সেক্যুলার চরিত্র ধ্বংস করা হয়েছে। ৩. পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত '৭২-এর সংবিধানের যে ধারাগুলো কার্যকর ছিল, তাতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। এবার সেটা উঠিয়ে দিয়ে সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে বৈধ করা হলো। ৪. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হলো। ৫. সংবিধানে নতুন করে সংযোজিত ৭(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে সংবিধানের একটা বড় অংশ (প্রায় অর্ধশত ধারা-উপধারা) কখনোই পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি পার্লামেন্টের সব সদস্য একমত হলেও তা অপরিবর্তনীয়। ৬. সংবিধানের যে ৭(ক) ধারা সংযোজিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ওই সব ধারায় আপত্তি জানিয়ে বক্তব্য দিলেও তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য হবে।
শেষোক্ত দুটি পয়েন্ট খুবই বিপজ্জনক এবং ফ্যাসিবাদী প্রবণতার প্রকাশ মাত্র। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিলের বিষয়টিও হাইকোর্টের রায়ের পরিপন্থী (কারণ হাইকোর্ট পরবর্তী দুটি নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রাখার পরামর্শ দিয়েছেন) এবং তা রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী সংখ্যায় কিছু বক্তব্য রাখব বলে আশা রাখি। এই সংখ্যায় ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত বিষয়ে আওয়ামী লীগের পশ্চাদপসরণের প্রসঙ্গে আমার অভিমত তুলে ধরছি।
এই নিবন্ধের শুরুর দিকে কিছু ইতিহাসের উল্লেখ করেছিলাম। ১৯৫৬-৫৭ সালের দিকে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দক্ষিণে মোড় নিয়েছিল। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার প্রশ্নে সেদিন তাদের অবস্থান ছিল প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরে। ১৯৬৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ র‌্যাডিক্যাল জাতীয়তাবাদী চরিত্র ধারণ করেছিল এবং বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন নতুন করে জেগে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক, ইতিহাসের মহানায়ক। এর পর রয়েছে ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগ ও বামশক্তির মিলিত প্রয়াস ও সমঝোতার ভিত্তিতে ১১ দফা প্রণয়ন, ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের বিজয়। ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা। একের পর এক প্রগতির জয়যাত্রা। তারপর শুরু হলো উল্টো স্রোত। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ কেবল সামরিক শাসক ছিলেন না, তাঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন, লালন করেছেন। ধীরে ধীরে পাকিস্তানি ভাবধারা শক্তিশালী হতে থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে সে ক্ষেত্রে আওয়ামী নেতৃত্বের ভূমিকাও সমালোচনা বা প্রশ্নের ঊধর্ে্ব ছিল না। তাঁরা বারবার মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে আপস করেছেন, আত্মসমর্পণ করেছেন। ১৯৯৬ সালে তাঁরা জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনের জোট করেছিলেন। তবে বিএনপির মতো নির্বাচনী জোট করেননি। তবে ২০০৬ সালে এই আওয়ামী নেতৃত্ব অধিকতর প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি ও নির্বাচনে সিট সমঝোতা করেছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁরা অবশ্য এরশাদকে সঙ্গে নিলেও কোনো ইসলামী দলকে নেননি। জনগণ তাঁদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল। প্রগতিশীল মহলের অনেকের আশা ছিল বিরাট। '৭২-এর সংবিধান যখন হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে ফিরে এল তখন এই আশা আরো বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হায়! এ যে দুরাশা মাত্র! কারণ আজকের আওয়ামী লীগ যে অনেক পেছনে ফিরে গেছে। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রায়ই বলেন, 'এই আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নয়, এটা এখন সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগে পরিণত হয়েছে।' কথাটার যথার্থতা আছে। বর্তমান সরকার সংবিধানে কোনো হাত না দিলেও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে থাকত ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। নিষিদ্ধ থাকত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। বিশেষ ধর্মের বাণী হিসেবে 'বিসমিল্লাহ' থাকত না। তারা কেবল এরশাদ প্রবর্তিত অষ্টম সংশোধনী (ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা) বাতিল করলেই পারতেন, তাতে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হতো।
না, তা তাঁরা করেননি। করবেন না। বরং তাঁরা আত্মসমর্পণ করেছেন মৌলবাদের কাছে ভোট পাওয়ার আশায়। আর ভেবেছেন, সংখ্যালঘুরা অসন্তুষ্ট হলেও তারা আর কোথাও যাবেন? সেগুলো তো তাঁদের রিজার্ভ ভোট, কেনা ভোট। তবে এই বিবেচনা যে সবসময় সঠিক নাও হতে পারে, সেই ধারণা কি তাঁদের আছে? তা ছাড়া স্টেটসম্যানশিপ যাকে বলে, তা কেবল পরবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবে না, পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবে। হায়! কার কাছ থেকে কী আশা করছি!
তবে আওয়ামী লীগের এই ভূমিকা, এই পঞ্চদশ সংশোধনী যে কেবল দেশকে বহু দূর পিছিয়ে নিয়ে গেল, তাই-ই নয়, তা বর্তমান সরকারের জন্যও কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। একে একে পঞ্চদশ সংশোধনী, নারীনীতি, ফতোয়া প্রসঙ্গে সরকারি নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য ইত্যাদি যে ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে উৎসাহিত করছে, তার ছোবল থেকে বর্তমানের শাসকরাও যে রক্ষা পাবেন, তা মনে হয় না। এই উপলব্ধি শাসকদের কয়জনের মধ্যে আছে তা অবশ্য আমি নিশ্চিতভাবে জানি না।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.