সময়ের প্রেক্ষিত-এই ঘোষণা পরাধীনতার by মনজুরুল হক

আমরা যারা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বড় হয়ে উঠেছি, তাদের সবাই প্রায় স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে সুপরিচিত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশককে আখ্যায়িত করা হয় বিশ্বজুড়ে সেই সময়ে চলতে থাকা বিভিন্ন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিজয়ের দুই দশক হিসেবে।


এশিয়া মহাদেশজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সেই সময়ে আবির্ভাব হয় সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী অনেক দেশের, যে তালিকায় আমাদের অঞ্চলের অন্তত চারটি দেশ—ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও তৎকালীন বর্মা অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে একমাত্র আফ্রিকা মহাদেশেই তখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নিজ পরিচয় ঘোষণা করে আত্মপ্রকাশ করেছে অন্তত ৫০টি নতুন দেশ, যে দলে লিবিয়াও অন্তর্ভুক্ত।
১৯১১ সালে ইতালির দখলাধীন হওয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি পরাজিত হলে ১৯৫১ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স লিগ অব নেশনসের ম্যান্ডেটের আওতায় লিবিয়ার রাষ্ট্র পরিচালনার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছিল। পশ্চিমের সেই দুটি দেশ পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ সালে বাদশাহ ইদ্রিসের নেতৃত্বে লিবিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার জাতিসংঘের একটি পরিকল্পনা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরও তিনি দেশের সমৃদ্ধ তেল সম্পদের অধিকারের ওপর ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পরবর্তী সময় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য মেনে নিয়েছিলেন। পশ্চিমের এই আধিপত্যের প্রকাশ হিসেবে দেশটিতে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটিও নির্মাণ করা হয়েছিল—আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে কীভাবে পথভ্রষ্ট করা যায়, তার নানা রকম ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আঁকা ও সেসবের বাস্তবায়নে যেসব ঘাঁটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে। তবে ১৯৬৯ সালে সামরিক বাহিনীর ২৭ বছর বয়সী যুবক অফিসার মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির নেতৃত্বে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে বাদশাহ ইদ্রিস ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক বছরের মাথায় নতুন সরকারের দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করার গৃহীত নীতিমালার অধীনে লিবিয়া থেকে পশ্চিমের সব রকম সামরিক ঘাঁটি গুটিয়ে নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে তখন সেই অপমান অনিচ্ছা সত্ত্বেও হজম করতে হলেও পরবর্তী সময় প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা থেকে পশ্চিম কখনোই পিছপা হয়নি।
সেই যে সামরিক অভ্যুত্থানে পশ্চিমের তাঁবেদার এক বাদশাহর ক্ষমতাচ্যুতির মধ্যে দিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতার পথে লিবিয়া যাত্রা করেছিল, তখনো কিন্তু নতুন করে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের কোনো প্রয়োজন দেশটির হয়নি। কেননা, লিবিয়া যে এর আগে থেকেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা বজায় রেখে আসছিল, নতুন নেতৃত্ব যুক্তিসংগত সেই বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রয়োজনীয়তা আদৌ অনুভব করেনি এবং তা অনুভব করার প্রয়োজনও তখন ছিল না। ১৯৬৯ সালের সেই অভ্যুত্থানের পর চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে ক্ষমতার সব রকম কলকবজা নিজের হাতে আটকে রেখেছিলেন কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি। শাসক হিসেবে অনুকরণীয় কোনো ঐতিহ্য তিনি একেবারেই রেখে যেতে পারেননি, যদিও সে রকম এক সম্ভাবনা তাঁর সামনে সূচনার দিনগুলোতে উন্মুক্ত ছিল। কেন তিনি তা পারেননি বা কেনই বা তিনি তা করেননি, সেটা অবশ্য হচ্ছে ভিন্ন এক প্রসঙ্গ, যার অবতারণা এখনো প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হবে না।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গাদ্দাফির বড় অবদান মনে হয় তেল রপ্তানিকারী রাষ্ট্রগুলোর জোট ওপেককে শক্তিশালী এক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া, যার মধ্যে দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ বিভিন্ন দেশ তাদের তেল সম্পদের ওপর নিজস্ব অধিকার নিশ্চিত করে নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মতো অবস্থানে চলে এসেছিল। এটাও ছিল গাদ্দাফিকে নিয়ে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের মধ্যে দেখা দেওয়া গাত্রদাহের অন্যতম এক কারণ, যা কিনা লিবিয়ার খামখেয়ালি সেই নেতাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার জায়গায় তাঁবেদার কাউকে ক্ষমতায় বসানোর ঘৃণ্য তৎপরতায় তাদের বরাবর নিয়োজিত রেখেছে।
অন্যদিকে তেলসম্পদের মালিকানা লাভ করার পর তেল বিক্রির অফুরান অর্থ হাতে এলে গাদ্দাফিও নিজেকে বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চের একজন হোমড়াচোমড়া মনে করে নিয়ে বিশ্বজুড়ে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের অপরিণামদর্শী নানা রকম খেলায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। কখনো তিনি অর্থের জোগান দিয়েছেন সেই সুদূর লাতিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বামপন্থী গেরিলাদের, কখনো আবার অস্ত্রের চালান পাঠিয়েছেন আরেক দূরের দেশ ফিলিপাইনের মরো গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের খুনি-বদমাশদের জন্যও এই ভেবে নিজের দুয়ার রেখেছেন উন্মুক্ত যে সে রকম করুণা প্রদর্শন এদেরকে তার চিরদিনের দাসে পরিণত করবে এবং সম্ভাব্য দুর্দিনে এরা তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। তবে খুনে-বদমাশদের যে নীতিবোধ বলে কোনো কিছু নেই, সেই বাস্তব শিক্ষা তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। এ কারণেই আমরা দেখি, সব রকম সৌজন্যবোধকে উপেক্ষা করে বছরের পর বছর ধরে তিনি পুষেছেন আমাদের দেশের কিছু খুনে-বদমাশকে, যারা কিনা নেতার দুর্দিন যে আগত তা উপলব্ধি করতে পেরে অনেক আগেই সেখান থেকে সটকে গিয়ে ভিন্ন কোনো নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে থেকেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বামপন্থী গেরিলা আন্দোলনের জন্য অস্ত্র আর অর্থের চালান দিয়ে যাওয়ায় এ রকম ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হতে পারে যে গাদ্দাফি হয়তো ছিলেন বামপন্থী কোনো এক নেতা, বিশ্বরাজনীতিতে নিজের উপস্থিতির ছাপ যিনি রেখে যেতে চেয়েছিলেন। তবে এর চেয়ে ভ্রান্ত আর বিভ্রান্তিকর আর কোনো ধারণা হতে পারে না। বিশ্বরাজনীতিতে বাম-ডানের বিভাজন তাঁর জন্য ছিল সে রকম বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে নিজের সম্পর্কে মোহাচ্ছন্ন এক ধারণা মূলত আরব বিশ্বের জনতার সামনে তুলে ধরা। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে সুদানে ঘটা এক ব্যর্থ অভ্যুত্থান ও সেই অভ্যুত্থান দমনে গাদ্দাফির গ্রহণ করা অমানবিক অবস্থান পরিষ্কার বলে দেয় বাম রাজনীতির কত বড় শত্রু প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন।
সুদানের সেই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন সামরিক বাহিনীর বামঘেঁষা কিছু তরুণ অফিসার, অভ্যুত্থানের পর নেতৃত্বের আসন গ্রহণের জন্য ইউরোপে নির্বাসিত এক বাম রাজনীতিককে তাঁরা আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশে নিয়ে এসেছিলেন। সেই নেতা ও তাঁর কয়েকজন অনুসারীকে বহনকারী বিমান লিবিয়ার আকাশসীমায় অবস্থান করার সময় অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার খবর পাওয়া যায় এবং বিমানের পাইলট ঘুরিয়ে অন্য গন্তব্যে চলে যেতে চাইলে গাদ্দাফির নির্দেশে তার বিমানবাহিনী যাত্রীবাহী সেই বিমানকে মধ্যাকাশ থেকে নামিয়ে এনে সেই সুদানি আরোহীদের ওই দেশের তৎকালীন নেতা গাফ্ফার আল নুমেরির কাছে তাঁদের হস্তান্তর করেন। আমরা জানি, নুমেরির নির্দেশে এদের বহনকারী একটি লিবীয় বিমান খার্তুমে অবতরণ করার পর বিমানের সেই আরোহীদের সরাসরি ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এ রকম নানা রকম নৃশংসতা সত্ত্বেও লিবিয়া যে পরাধীন কোনো রাষ্ট্র, সে কথা কিন্তু কেউ কখনো বলেনি। তবে কেন এই ২০১১ সালের অক্টোবর মাসের শেষ প্রান্তে এসে লিবিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার এই পাঁয়তারা? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে লিবিয়ায় চলতে থাকা নৃশংসতার সর্বশেষ এই খেলা এবং এর খেলুড়েদের তৎপরতার দিকে আমাদের একটু নজর দেওয়া দরকার।
গাদ্দাফির দুর্ভাগ্যের সূচনা বলা যায় তিউনিসিয়ায় জয়নাল আবেদিন বেন আলীর একনায়কতান্ত্রিক সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে। আরব বিশ্বে বসন্তের সুবাতাস হিসেবে যেটাকে এখন আখ্যায়িত করা হচ্ছে, সেই বাতাস কতটা সুগন্ধময় এবং কতটাই বা এর সঙ্গে মানুষের পচন ধরা মৃতদেহসহ অন্য অনেক দুর্গন্ধের মিশ্রণ তিউনিসিয়ার সেই দিনগুলো থেকে ইতিমধ্যে ঘটেছে, সেই প্রশ্ন মনে হয় এখন এ কারণে দেখা দিতে শুরু করেছে যে, স্বৈরশাসকের পতনে মদদ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যেন নিজস্ব লাভক্ষতির হিসাব-নিকাশ ঢুকে পড়েছে।
লিবিয়ায় দীর্ঘ সাত মাস ধরে বিরতিহীন বিমান হামলা চালিয়ে এক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সেই দেশের নিপীড়িত জনতাকে রক্ষা করা নৈতিক দায়িত্ব হয়ে উঠলেও বাহরাইন কিংবা সৌদি আরবের জনগণের বেলায় সে রকম কোনো পদক্ষেপ নয়, বরং উল্টো অবস্থান গ্রহণ করা হয়তো এ কারণেই পশ্চিমের দরকার যে, একই রকমের তেলসম্পদের মালিক সেই সব দেশ হচ্ছে পশ্চিমের করদ রাজ্যবিশেষ, যার অঙ্গুলি হেলেনে সেই সব দেশের রাজা-বাদশাহরা পরিচালিত হন। অর্থাৎ, আমরা ধরে নিতে পারি যে সার্বভৌম স্বাধীন কোনো দেশ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করার যা হচ্ছে আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত, রাষ্ট্রের সব রকম বিষয়ে সে রকম আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে সেই সব দেশের রাজা-বাদশাহরা বঞ্চিত।
অন্যদিকে লিবিয়ার বেলায় হিসাব ঠিক অন্য রকম ছিল বলেই তাঁবেদারের আবির্ভাবের অপেক্ষায় পশ্চিমকে থাকতে হয়েছে। সে রকম কিছু তাঁবেদার ও তাদের অনুসারীরা আরব বসন্তের সুযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে নেমে এলে এদেরকে অত্যাধুনিক সব রকম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়। দেশের নিয়ন্ত্রণ যেন এরা গ্রহণ করতে পারে, তা নিশ্চিত করে নিতে দেশটির বিদ্যমান সামরিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দিতে সাত মাস ধরে নির্বিচার বিমান হামলা চালিয়ে যেতে কোনো রকম কুণ্ঠাবোধ পশ্চিমের ‘মানবাধিকার প্রেমী’ শাসককুলের মধ্যে দেখা দেয়নি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।
তবে সবচেয়ে লজ্জাজনক দিকটি মনে হয় গাদ্দাফির করুণ মৃত্যুতে এদের মধ্যে বয়ে যাওয়া অফুরান আনন্দের বন্যা। হিলারি ক্লিনটনকে গাদ্দাফি বধের ছবি সেলফোনের পর্দায় দেখানো হলে আনন্দের সেই হলিউডি অভিব্যক্তি, ‘ওয়াও’ বলে চিৎকার করে ওঠা তিনি থামিয়ে রাখতে পারেননি। কেননা, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি ভালোভাবেই জেনে গেছেন যে লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের একচ্ছত্র দখল নিরঙ্কুশ করে নিতে কোনো রকম বিরোধিতার মুখোমুখি এখন আর হতে হবে না। ফলে দেশটির বশংবদ মেরুদণ্ডহীন নতুন নেতৃত্বকে নতুন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করায় উদ্বুদ্ধ করা কেন? কেননা, আমরা জানি, এবারের এই স্বাধীনতা ঘোষণার অর্থ তো প্রকৃত অর্থে হচ্ছে পরাধীনতার ঘোষণা, যে ঘোষণার মধ্য দিয়ে লিবিয়ার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অনাগত দিনগুলোর জন্য হয়ে থাকবে পশ্চিমের পদভারে পিষ্ট।
টোকিও, ২৩ অক্টোবর ২০১১
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.