ইতিউতি-অভিজাত এলাকায় নীরব বাড়িগুলো by আতাউস সামাদ

ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার যানজট বেশ দশাসই হয়। একবার বেঁধে গেলে খুলতে সময় লাগে। তাই গুলশান এভিনিউয়ে ট্রাফিক জ্যাম হলে পাশের অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তাগুলোতে ঢুকে পড়ি। অত নম্বর, তত নম্বর রোড ধরে বাঁক নিয়ে দুই নম্বর গোল চক্কর এলাকা থেকে এক নম্বর চক্করের কাছাকাছি এসে সেটা এড়িয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকার রাস্তায় পেঁৗছানোার চেষ্টা করি।


তখন দেখতে পাই, গুলশানে নির্মীয়মাণ বহুতল ভবনগুলোর কংক্রিট কাঠামোর ফাঁকে ফাঁকে এখনো কিছু শৌখিন বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোর সুপ্রশস্ত আঙিনায় আজও রয়েছে বৃক্ষের সমারোহ। কোনো কোনো দোতলা, এমনকি তেতলা বাড়ির বেশির ভাগটাই ঢাকা পড়ে আছে গাছের আড়ালে। মন খারাপ হয়। হিংসায় নয়, দুঃখে। এসব চমৎকার বাড়ি আর ঘন গাছপালা কত দিনই বা টিকবে! পেটমোটা ও আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক অথবা অভিজাত, চাই কি এঙ্ক্লুসিভ শপিং মলের জন্য জায়গা করে দিয়ে এই সুন্দর বাড়িগুলো আর গাছগাছালির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে যে শুধু 'আবাসন' ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী অতি তৎপরতার জন্য তা নয়, তা বেশ কিছুটা বাড়ির মালিকদের অন্তিম যাত্রায় যাওয়া বা কালের কালস্রোতের ঘষায় শরীর ক্ষয় হওয়া এবং উত্তরাধিকারীরা স্থায়ীভাবেই প্রবাসী হয়ে যাওয়ার কারণেও।
গুলশান-বনানী-বারিধারায় এমন বেশ কিছু বাড়ি পাওয়া যাবে, যেখানে আছেন কেবল বৃদ্ধ-বৃদ্ধা স্বামী-স্ত্রী। কোনো কোনোটাতে আছেন তাঁদের মাত্র একজন। ভেবেছিলেন বাড়ি বড় করে বানালে তা ভরে রাখবে পুত্র-পৌত্ররা। কিন্তু তা হয়নি। ছেলেমেয়েদের 'ভালো পড়ানোর' জন্য যে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন, তারা সেই বিদেশেই থেকে গেছে। তারা দেশে ফিরবেই বা কেন? কষ্ট করে বিদেশে যে নামি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ডিগ্রি নিল, তার তুল্য চাকরি কই বাংলাদেশে! তারা যে মানের উচ্চতর বিদ্যার্জন করল, তা প্রয়োগ করার মতো কাজ কই এ দেশে? তাই কাজের মতো কাজ করতে অথবা বেকারত্ব ঘোচাতে বা পেট চালাতে তারা বিদেশে থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এ কথাই তো তারা বলে আর এখানে আমরা তার সদুত্তর দিতে পারি না। সরকারি, আধাসরকারি দপ্তর বা সরকারনিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাকরি পেতে হয় লাগবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলীয় পরিচয়, না হয় ক্ষমতাধর কোনো ব্যক্তির সুপারিশ। ব্যক্তিগত মালিকানার বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উঁচু পদ মালিক অথবা মালিকানায় অংশীদারদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এখানকার শাখার উচ্চতম পদে হয় মালিক-দেশের লোক না হলে প্রধানত ভারতীয়দেরই দেখা যায়। উচ্চ-মাঝারি (উচ্চ-মধ্যবিত্তের মতো আর কি) পদে যেতে পারেন কিছু বাংলাদেশি। আর নিজের উদ্যোগে ব্যবসাতে, উৎকোচ-পন্থা ব্যবহার না করে কজন বাংলাদেশিই বা সফল হতে পেরেছেন। ওই পথে চলা সবাই অভ্যাস করতে পারেন না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'আদালত-নির্দেশিত' (অর্ধেক বস্তুনিষ্ঠ দাবি) পথে চলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার উচ্ছেদ অভিযান চলার সময় ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) বর্তমান সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সেই সিদ্ধান্তের সমর্থন করে বলেছিলেন, আবার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে তাহলে সব ব্যবসায়ী (ভয়ে) দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। যথাযথ সৌজন্য জানিয়ে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করছি। খুব ধনী ও বেশ ধনী ব্যবসায়ীদের পরিবার বা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে একজন-দুজন সব সময়ই বিদেশে অবস্থান করেন বলেই আমাদের ধারণা। আর অনেকেরই যে বিদেশে স্থায়ী ঠিকানা আছে, তাও ঠিক। কাজেই সিঁদুরে মেঘ দেখলে বাকিরা যাতে সরে যেতে পারেন তার ব্যবস্থা হয়ে রয়েছে বলে মনে হয়। তবে বাংলাদেশি কোনো বড় ব্যবসায়ী যদি তাঁর ব্যবসাকে সীমানা ছাড়িয়ে প্রসারিত করেন, যেমন করছেন ভারতের টাটা ও আম্বানিরা, তা হবে আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। অবশ্য কোনো কোনো ধনী মানুষের ছেলেমেয়েরা নিজেদের সিদ্ধান্তেই বিদেশে ব্যবসা বা কাজ করছেন সেখানকার সুযোগ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মানার বাধ্যবাধকতার ফলে সৃষ্ট সুবিধার দরুন, তেমনও শুনতে পাই। মোট কথা, যাদের উত্তরাধিকারীরা দেশ না ছাড়লেও চলত, তাদের মধ্যেও অনেকে প্রবাসে স্থায়ী হওয়ার পথে। সব ধরন প্রবাসযাত্রায় মিলিয়ে। ফলাফল, গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমণ্ডি ও ইস্কাটনের অনেক বাড়ি প্রায় বিরান হয়ে আসা।
যে ছেলেমেয়েরা বিদেশে চলে যাচ্ছে, তারা যে তাদের মা-বাবাকে ভুলে যায়, তা নয়। তাদের অনেকেই মা-বাবাকে নিজেদের কাছে নিয়ে যায়। এমন হয় যে, ছেলের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চার-পাঁচ মাস কাটিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দেশে ফিরে এক মাস বা বড়জোর দুই মাস থেকে যাত্রা করলেন কানাডায় আরেক ছেলে বা মেয়েকে সঙ্গ দিতে। এখন যদি কোনো বৃদ্ধ ফোন করে বলেন, 'ভাই, আপনার অমুক আমাদের কাছে আপনার জন্য কিছু পাঠিয়েছে, প্লিজ তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবেন, কারণ দুই সপ্তাহ পরেই আবার আরেক সন্তানের কাছে যেতে হবে,' তাহলে আর এমন চিন্তা করি না যে তিনি এসব গায়ে পড়ে শোনাচ্ছেন। বরঞ্চ কৃতজ্ঞ হই যে আমাদের সন্তানের সঙ্গেও তিনি মেশেন এবং আমাদের জন্য তার দেওয়া উপহার, এমনকি ওষুধ বয়ে নিয়ে এসেছেন। এই যে তাঁদের ফিরে যাওয়ার তাগিদ, তার মধ্যে কিছু কর্তব্য পালনও থাকে। হয়তোবা তাঁদের ছেলে ও তার বউ অথবা মেয়ে এবং তার স্বামী দুজনই চাকরি করেন। বুড়ো-বুড়ি তাঁদের সঙ্গে কিছুদিন থেকে নাতি-নাতনি সামাল দিয়ে আসেন। সন্ধ্যাবেলায় সদ্য রাঁধা গরম ভাত খান সবাই মিলে। রোজ টাটকা ভাত-তরকারি খেতে পারা প্রবাসে কর্মরতদের জন্য একটা বিরাট ব্যাপার। তবে আমরা যে বিষয়টি নিয়ে ভাবছি তা হলো, বিদেশে বেড়ে ওঠা নাতি-নাতনিরা কিন্তু সেই দেশেরই হয়ে যায়, তারা বাপ-দাদার দেশে স্থায়ীভাবে ফিরতে চায় না। চেনা পরিবেশ, চেনা সংস্কৃতির মাঝেই নিরাপদ ও স্বস্তি বোধ করে।
এভাবে শৌখিন বাড়ির মালিকরা যখন দেশে নিঃসঙ্গ হয়ে যান তখন তাঁরা জমি ও সেই গৃহটি আবাসন কম্পানির হাতে তুলে দেন ফ্ল্যাট বানানোর জন্য। নিজে চলে যান ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে। এক প্রজন্ম তখন শেষ হওয়ার পথে। সেই সঙ্গে দেশের সঙ্গে বন্ধন ক্ষয় হয়ে নিঃশেষ প্রায়। আমরা এমন ঘটনার কথা জানি যে প্রবাসী ছেলেমেয়েরা বৃদ্ধ ও অসুস্থ বিধবা মা অথবা মৃতদার বাবাকে নিজেদের কাছে নিয়ে গেছে। তিনি সেখানে ইন্তেকাল করেছেন। অভিভাবকহীন ছেলেমেয়েরা তখন ঢাকার বাড়িটি বহুতল আবাসন প্রকল্পের জন্য কোনো নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিয়েছে। সেই ইমারত তৈরি হওয়ার পর বড়জোর একটা-দুটো অ্যাপার্টমেন্ট রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিয়েছে। এমনকি মা-বাবার অ্যাপার্টমেন্টটাও তাঁরা গত হওয়ার পর থেকে খালি পড়ে আছে এমনও দেখছি। প্রবাসী সন্তানরা তবু ফিরে আসতে পারছে না, কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা তো সেই পরভূমে বড় হচ্ছে। তাদের লালন-পালন করার জন্য হলেও তাদের পক্ষে সে দেশ ছেড়ে নিজের দেশে ফিরে আসা সম্ভব নয়। এভাবে নীরবে একটা অভিবাসন প্রক্রিয়া চলছে।
এখন চিন্তা করার বিষয়, এভাবে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশ স্থায়ীভাবে প্রবাসী হয়ে ছিন্নসূত্র হয়ে গেল, তারা কি দেশে কোনো টাকা পাঠাবে? কার কাছেই বা পাঠাবে, কার জন্য পাঠাবে। টাকা পাঠানোর তাগিদ নেই, ঠিকানা নেই, তাই তারা টাকা পাঠাবে না। তাহলে এই সূত্রে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ হলো। এখন রপ্তানি আয় বাদ দিয়ে রেমিট্যান্স আসার ভরসা থাকল প্রবাসে বাংলাদেশে নিম্ন বেতনের শ্রমজীবীরা, কারণ তাঁরা পরিবার-পরিজনের জন্য টাকা পাঠাবেনই। সোজা কথায় শ্রমিকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তারা সর্বশেষ মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বলেছেন, তাঁদের পাঠানো অর্থের ওপর এবার বেশ নির্ভর করতে হবে। তাঁরা যদি বেশি করে টাকা পাঠান তাহলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল ভালো থাকবে। না হলে এর ওপর চাপ পড়বে এবং ডলার সংগ্রহ করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আমাদের ধারণা, প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা আরো বহু বছর দেশে টাকা পাঠাবেন। যেহেতু দেশে কর্মসংস্থান প্রয়োজনের তুলনায় কম, তাই বেকারত্ব ঘোচাতে অনেকেই বিদেশে পাড়ি দেবেন আরো বহু বছর। প্রবাসী কর্মজীবীরা এ বিষয়ে নিজ পরিবারের সদস্যদের বা আত্মীয়স্বজনদের সহায়তাও করবেন।
এখন দেখা দরকার, এই প্রবাসী শ্রমজীবীদের পরিবারের কী হচ্ছে নিজ দেশে। মনে হয়, প্রথমে তাঁরা ঋণ শোধ করেন, তারপর ঘরবাড়ি গোছান এবং তৃতীয় ধাপে ছেলেমেয়েদের ভালো করে লেখাপড়া শেখাতে চান। এই তৃতীয় পর্যায়ে যাঁরা আছেন বা পেঁৗছাবেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রথমে উপজেলা শহরে, তারপর জেলা সদরে, অতঃপর রাজধানী ঢাকায় আসতে চাইবেন। অর্থাৎ বাংলাদেশেও অল্প বিত্তধারীদেরও গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন লক্ষণীয়ভাবে আরম্ভ হবে। কিছু কিছু ইতিমধ্যেই হচ্ছে। গ্রাম থেকে শাখা-প্রশাখা নিয়ে পুরো পরিবার ঢাকায় এসে বসবাস করছে, আয়-রোজগার করছে, ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে_এ রকম উদাহরণ এখন অঢেল। বিত্তবান বা আর্থিকভাবে সক্ষম সবাই যদি শহরে চলে আসে, তাহলে পল্লী অঞ্চলের কী হবে? আমাদের মনে হয়, গ্রামে লেখাপড়াসহ আধুনিক জীবনের কিছু সুবিধা, উপজেলা শহরে শিক্ষা, চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা এবং জেলা শহরগুলোতে সব রকম নাগরিক ও ব্যবসায়িক সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। সরকার যদি এ বিষয়ে ঢিমেতালে চলে তাহলে রাজধানীর সঙ্গে দেশের অন্য এলাকার বৈষম্য ও শ্রেণীবৈষম্য খুব প্রকট হয়ে দেখা দেবে।
আমাদের আরো মনে হয়, বিদেশ থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর অনাদিকাল পর্যন্ত নির্ভর করা যাবে না। কারণ, দুঃখজনক হলেও বেশ কিছু দেশে অন্যদেশ থেকে আসা শ্রমিকদের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। তা শুধু বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি সীমাবদ্ধ নয়। এক দেশের লোক তার নিজের দেশে বিদেশিদের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে চায় না বা বিদেশিদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে যাওয়া ভালো চোখে দেখে না। আমাদের জনশক্তিকে অদূর ভবিষ্যতে দেশেই কাজ দিতে পারার কথা এখন আন্তরিকভাবে ও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতেই হবে। আর শিক্ষিত বাংলাদেশিরা যাঁরা বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন, তাঁদের অর্জিত জ্ঞান ও স্ব-স্ব ক্ষেত্রের পারদর্শিতা বাংলাদেশের উন্নতির কাজে লাগানোর উপায় বের করতে হবে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন, হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন এবং প্রকৌশলী হিসেবে বিভিন্ন শিল্পে কর্মরত আছেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সুযোগ পেলে তাঁরা তাঁদের মেধা ও জ্ঞান দেশের কাজে লাগাবেন নিশ্চয়ই। তবে এ জন্য সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ও কাজের পরিবেশ দুয়েরই প্রয়োজন আছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.