সড়ক দুর্ঘটনা-আন্দোলনে বাতি জ্বালাবেন জাফর ইকবাল by এ কে এম জাকারিয়া

একমুখী শিক্ষা নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন তিনি। সফলও হয়েছেন। শিক্ষা অবশ্য নিজের বিষয়, সড়ক দুর্ঘটনা কোনোভাবেই নয়। কিন্তু এ নিয়েও যে কিছু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কখন ও কীভাবে শুরু করবেন এই কাজ? ঠিক করলেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে মাঝে দেশে যে আলোড়ন উঠেছে, তা নিশ্চয় একসময় থিতিয়ে যাবে।
যখন এই ইস্যুটি মিইয়ে যেতে শুরু করবে, তখনই কাজ শুরু করবেন তিনি। আর শুরু করলে তা অব্যাহতভাবে চালিয়েই যেতে চান। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ প্রতিবছর একটি উৎসব করে ‘সিএসই কার্নিভ্যাল’ নামে। আলোচনা অনুষ্ঠান, সেমিনার. সফটওয়্যার প্রতিযোগিতা, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, জব ফেয়ার—নানা কিছুই হয় এই উৎসবে। এই উৎসবকে উপলক্ষ মেনেই নেওয়া হলো একটি গোলটেবিল আলোচনার উদ্যোগ (২৩ সেপ্টেম্বর)। ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধ: তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ নিয়ে তিনি জড়ো করেছিলেন বিভিন্ন পর্যায়ের সড়ক বিশেষজ্ঞদের। এর বাইরেও আমাদের মতো দু-একজনকে। ‘এ বিষয়ে সবার কাছ থেকে কিছু শোনা ও বিষয়টি সম্পর্কে একটি ধারণা নেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য’—মন্তব্য মুহম্মদ জাফর ইকবালের। ঠিকই তো, ধারণা না থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করবেন কীভাবে?
জাফর স্যার সবার কথা শুনলেন, মনে তাঁর যেসব প্রশ্ন জেগেছে তা-ও জিজ্ঞেস করে জেনে নিলেন। বোঝা গেল, তিনি সত্যিই এ নিয়ে এবার কিছু করতে চান। স্যারের সঙ্গে আমরাও শুনলাম, জানলাম ও শিখলামও বটে। আমরা মানে দুটি পত্রিকা থেকে দুজন। সঙ্গে ছিলেন দৈনিক সমকাল পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক নাসির আহমেদ। আমাদের কাছ থেকে জানার বিষয় ছিল, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গণমাধ্যম কী ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের সহজ জবাব ‘সচেতনতা সৃষ্টি’। আসলে গণমাধ্যম এটাই করতে পারে। তারা জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করতে পারে, নীতিনির্ধারকদের অনেক কিছু ধরিয়ে দিতে পারে, সাংবাদিকদের নিজেদের জ্ঞান বা জানা-বোঝার সীমাবদ্ধতা থাকলেও বিশেষজ্ঞদের নানা মত তুলে ধরে পরামর্শ দিতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা গণমাধ্যমের কথা কানে তোলেন তো! কয়েক দিন আগে যোগাযোগমন্ত্রীর মুখেই শুনলাম, ‘মিডিয়া শুধু শুধু গল্প ও অসত্য তথ্য প্রকাশের চেষ্টা করে।’ হতাশার কথা থাক। ছায়া যাতে আছে, তাতে আলোও আছে। জাফর স্যার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সামনে নিতে যাচ্ছেন, তা আমাদের তাই আশা জাগায়, অনেকটা ছায়ার মাঝে আলোর মতোই।
‘ধর্মমতে, মুসলমানদের কোনো অকালমৃত্যু নেই। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর তাঁদের নির্ধারিত সময়েই মারা গেছেন। এ জন্য দুঃখ লাগতে পারে। তবে এটাই বাস্তব’—একজন মন্ত্রীর এই মন্তব্য জাফর স্যারকে যে অনেক ভাবিয়েছে, তা বোঝা গেল সেদিনের গোলটেবিল আলোচনার শুরুতেই। আমাদের চালক ভাইয়েরা যদি ভাবতে থাকেন যে মানুষের মৃত্যু তো নির্ধারিত, যে যাত্রীদের নিয়ে তিনি গাড়ি চালান, তাঁরা তাঁদের নির্ধারিত সময়েই মারা যাবেন, এমনকি তিনি নিজেও নির্ধারিত সময়ে মারা যাবেন, তবে তিনি আইনকানুন মানবেন কেন? গাড়ি চালাতে গিয়ে সাবধান হওয়ারই বা দরকার কী! সে দিনের আলোচনা তাই তিনি শুরুই করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একজন শিক্ষককে দিয়ে, যিনি ধর্ম সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন। কোরআন-হাদিসের উদাহরণ দিয়েই পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক মো. এমদাদুল হক এ ধরনের ধারণার অসারতা প্রমাণ করলেন। উদ্ধৃত করলেন কোরআন থেকে, ‘কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন তাতে পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করল, আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন তাতে পৃথিবীর সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত ৩২)। বললেন, একজন চালকের কাছে তাঁর যাত্রীরা আমানতের মতো। চালকের দায়িত্ব এই আমানত রক্ষা করা।
সেদিনের আলোচনাটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বেলা আড়াইটায় শুরু হয়ে শেষ হয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার এই আলোচনায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, নতুন প্রযুক্তি; বিশেষ করে তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, আইনের ত্রুটি, বাস্তবায়নের সমস্যা, সড়কের ত্রুটি, চালকদের দক্ষতা-প্রশিক্ষণ—এমন নানা বিষয়ই উঠে এসেছে। দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত নীতিনির্ধারকেরা যে বিষয়গুলো জানেন না, এমন নয়। এর পরও জরুরি মনে হয়েছে এমন কিছু বিষয়ে তাঁদের আবারও মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে দোষ কোথায়! আর পাঠকদের সঙ্গে বিষয়গুলো ভাগাভাগি করাও হলো। নতুন কিছু নয়, বর্তমান আইন, বিধি বা ধারা কার্যকর করা ও সড়ক-মহাসড়কের কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমেই পরিস্থিতির চোখে পড়ার মতো উন্নতি ঘটানো যায়।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার এম এ জলিল উপস্থিত ছিলেন সেই আলোচনায়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নিজেদের সমস্যার যেসব দিক তুলে ধরলেন তার মধ্যে বাস্তবতা যে নেই, তা নয়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তার দৃশ্য ধারণ করা গেলে সহজেই ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহন বা চালককে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু পুলিশ বিভাগের পক্ষে এখন সেই কাজটি করা সম্ভব হয় না। লোকবল বা কারিগরি শক্তির যে ঘাটতি রয়েছে আমাদের পুলিশ বিভাগের, তাতে সন্দেহ নেই। তবে তিনি জানালেন দুর্ঘটনার পর যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে ছবি বা ভিডিও ধারণ করে, সেগুলো দুর্ঘটনার তদন্তে পুলিশ কাজে লাগাতে পারে, সেগুলো আদালতে আলামত হিসেবে উপাস্থাপন করা যাবে। এখন আমাদের হাতে হাতে যখন ভিডিও ক্যামেরাসহ মোবাইল ফোন, তখন আমরা সচেতন হয়ে তো এই কাজটি করতেই পারি।
সড়ক দুর্ঘটনায় যানবাহনের গতি একটি বড় বিষয়। বিশেষ করে, আমাদের মতো দেশে। এখানে পথচারীরা যেমন নিয়মকানুন কম জানে, তেমনি পথচারীদের জন্য সড়ক-মহাসড়কে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত, তাও নেই। এখানে একই রাস্তায় বাস-ট্রাকের মতো দ্রুত গতির যানের সঙ্গে চলে শরীরের শক্তিতে রিকশা, রিকশা-ভ্যান বা নছিমন-করিমনের মতো দেশে বানানো যন্ত্রযান। আর পুরো সড়ক-মহাসড়কেই তো রয়েছে হাট-বাজার। গতি নিয়ন্ত্রণ এ দেশেই সবচেয়ে বেশি জরুরি। কোন যানবাহন সবচেয়ে বেশি কত গতিতে চলতে পারবে, তার একটি সীমা নির্ধারিত থাকে। এই সীমাটি কত? ‘যুক্তরাষ্ট্রে মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসের সর্বোচ্চ গতিসীমা হচ্ছে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার, আর মালবাহী ট্রাকের ক্ষেত্রে তা ৮০ কিলোমিটার।’ জানালেন, আলোচনায় উপস্থিত নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো ওয়াসীম বারী। যুক্তরাষ্ট্রের মহাসড়কগুলোর সঙ্গে আমাদেরগুলোর তুলনার সুযোগ নেই। সেখানেই সর্বোচ্চ গতিসীমা হচ্ছে এই! আমাদের দেশের অধিকাংশ ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম না মেনে বানানো বা আঁকাবাঁকা মহাসড়কগুলোতে যাত্রীবাহী বাসগুলোতে অহরহ চলছে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে। বাংলাদেশে কি সর্বোচ্চ গতির কোনো সীমা নেই? ‘বাংলাদেশে যাত্রীবাহী বাসের সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে ৬০ কিলোমিটার, আর মালবাহী ট্রাকের ক্ষেত্রে ৪৫ কিলোমিটার।’ এই তথ্যটিও জানালেন তিনি। আমরা যারা মহাসড়ক ব্যবহার করে এখানে-ওখানে যাই, তাদের অভিজ্ঞতা কী বলে? আমাদের বাসগুলো কি এই গতি মেনে চলে? মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশ থাকে, বেশি গতির জন্য কোনো যাত্রীবাহী বাস আটকানো হয়েছে, এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি কখনো হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের এক বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতারা জানালেন, কীভাবে পণ্যবাহী ট্রাক আটকে সড়ক-মহাসড়ক থেকে পুলিশ নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। হাইওয়ে পুলিশ ট্রাক থামানোর কাজটিই করে, বাস থামায় না। বাস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পুলিশের এই যে ‘সুসম্পর্ক’ তার পেছনে ‘লেনদেন’ ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে!
ওয়াসীম বারী বললেন, ‘হাইওয়েতে চলার সময় আমরা বিভিন্ন স্থানে হাইওয়ে পুলিশ দেখি, তাঁরা যদি নিয়মিত স্পিড মাপার যন্ত্র হাতে নিয়ে তা মাপেন এবং কোনো বাস সীমা অতিক্রম করলে যদি সেটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে তবেই এই প্রবণতা কমে আসবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের হাইওয়ে পুলিশের কাছে কি এই জরুরি সরঞ্জামটি আছে? পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য নানা সরঞ্জাম কেনার পরিকল্পনার কথা শোনা যায়, কেনাও হয় নানা সরঞ্জাম, কিন্তু স্পিডমিটারের মতো একটি জরুরি ও স্বল্পমূল্যের যন্ত্র কেনার কথা শোনা যায়নি কখনো। এতে এটা বোঝা যায় যে সড়ক দুর্ঘটনার মতো এমন একটি গুরুতর বিষয় আমাদের সরকার ও নীতিনির্ধারকদের প্রাধান্যের বিষয়গুলোর মধ্যে নেই।
সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মারা যাওয়ার ঘটনায় যখন সবার মনোযোগ সড়ক দুর্ঘটনায় গিয়ে ঠেকেছে, তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক হাসিব মোহাম্মদ আহসানের কাছে গিয়েছিলাম বিষয়টি সম্পর্কে কিছু ধারণা নিতে। সে সময় তাঁর একটি লেখাও ছাপা হয়েছিল প্রথম আলো পত্রিকায়। তিনি তখন বলেছিলেন, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে ক্ষতি হয় আমাদের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। যারা মারা যায়, তাদের শতকরা ৫০ ভাগের বয়স ৩০-এর নিচে এবং তারা সবাই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ। প্রতিবছর আমরা হারাচ্ছি শ্রমশক্তির একটি বড় অংশকে। সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে সব পক্ষের সচেতনতার কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন তিনি। ‘সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সচেতনতার বিষয়টিকে আমরা খুবই গুরুত্ব দিতে চাই। সচেতনতার বিষয়টি সবার জন্য। সচেতনতা প্রয়োজন পথচারীদের, যাত্রীদের, যানবাহন-মালিকদের ও চালকদের। তবে গত দুই দশকে পরিস্থিতি যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি সচেতনতা প্রয়োজন দেশের নীতিনির্ধারকদের।’
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিনের দীর্ঘ আলোচনা শেষে প্রশ্ন উঠল, কীভাবে কাজটি শুরু করবেন জাফর ইকবাল স্যার? তিনি সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টিকেই জরুরি মানলেন। সিদ্ধান্ত হলো, শুরুটা হবে চালক, যাত্রী ও পথচারীদের সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। লিফলেট তৈরি করে, এসএমএসের মাধ্যমে ও গণসংযোগের মধ্য দিয়ে কাজটি শুরু হবে। জাফর ইকবাল স্যারের আশা, সচেতনতা সৃষ্টির কারণে যদি একটি প্রাণও বেঁচে যায়, সেটাই কম কী!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.