সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ

আর কত প্রাণ গেলে টনক নড়বে? আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। একই সঙ্গে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও। ২৯ জুলাই কালের কণ্ঠে প্রকাশ, বগুড়ায় বাস-ট্রাক সংঘর্ষে ঝরে গেছে ১৮টি প্রাণ। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে আরো ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সড়ক-নৈরাজ্যের যে উদ্বেগজনক চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে, এর নিরসন কেন সম্ভব হচ্ছে না_এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার।


গত দুই দশকে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলেও সড়ক-মহাসড়কে মানুষের যাতায়াত মোটেই নিরাপদ কিংবা নির্বিঘ্ন করা যায়নি। উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলা সড়ক দুর্ঘটনার পেছনের কারণগুলো অচিহ্নিত না হলেও প্রতিকারচিত্র বড় বেশি বিবর্ণ। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কিংবা নিরাপদ সড়কের দাবিতে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি প্রদান, আন্দোলন ইত্যাদি অব্যাহত থাকলেও সড়ক মৃত্যুফাঁদ হয়েই আছে!
সড়কপথে বিদ্যমান হতাশাজনক পরিস্থিতির অবসানে সরকারের তরফে কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। একে একটি মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটার পর সরকারি তরফে প্রতিকারের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হচ্ছে বটে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৃশ্যত উদ্যোগ-আয়োজনও কম নয়, কিন্তু কার্যত ফল শূন্য! মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে এমন উদাসীনতা বিস্ময়কর, যুগপৎ প্রশ্নবোধক। সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো সম্পর্কে প্রায় নিত্য আলোচনা হচ্ছে। এর পুনরুল্লেখ চর্বিতচর্বণ মাত্র। এ ক্ষেত্রে দুর্বল আইনের কারণেও বিদ্যমান চিত্র ক্রমেই মর্মন্তুদ হচ্ছে। উন্নত বিশ্বেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে; কিন্তু বাংলাদেশের মতো এ হার এত উদ্বেগজনক তো নয়ই, পাশাপাশি প্রতিকারচিত্রও এত বিবর্ণ নয়। এযাবৎ এসব নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে কিন্তু দুঃখজনকভাবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আর কত প্রাণ ঝরে গেলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল তথা সরকারের টনক নড়বে_এ প্রশ্নও উঠছে। আধুনিক, সভ্য, প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে এমনভাবে মানুষের প্রাণ ঝরে যাবে, তা অচিন্তনীয়, অকল্পনীয় এবং কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। সময় এসেছে সড়কপথ নিরাপদ-নির্বিঘ্ন করার দায়-দায়িত্ব যাদের অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ জন্য কঠোর জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতার শিকলে বাঁধা ও প্রতিরোধে কঠোর কার্যকর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া। সেই সঙ্গে জরুরি হয়ে পড়েছে বিদ্যমান আইন সংশোধন। সরকারকে অবশ্যই কালবিলম্ব না করে এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটাতে হবে। কাজটি মোটেই দুরূহ নয়। প্রয়োজন শুধু ট্রাফিক আইন মেনে চলা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া, চালকের আসনে প্রশিক্ষিত-দক্ষদের নিয়োগ দেওয়া, হাইওয়ে পুলিশসহ সব আইনি সংস্থার সদস্যদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিষ্ঠাবান হওয়া, ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং সবার সচেতনতাসহ প্রয়োজনীয় আরো কিছু বিষয় নিশ্চিত করা।
দুর্ঘটনা যেহেতু মানুষের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ এবং বোধগম্য কারণ ছাড়াই অকস্মাৎ ঘটতে পারে, সেহেতু অনেক সময় দুর্ঘটনাকে অসহায়ভাবে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি তা নয়। এ দেশে প্রায় প্রতিটি (সড়ক দুর্ঘটনা তো বটেই) দুর্ঘটনার পেছনে কিছু মানুষের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ক্রমেই নগ্নভাবে ধরা পড়ছে। ফলে সহিষ্ণুতার সীমা ভেঙে সমাজে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সংগতই বাড়ছে ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ। আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে এবং এও মনে রাখতে হবে, কঠোর আইন প্রণয়নই শেষ কথা নয়_এর যথাযথ বাস্তবায়নই হলো মূল কথা। সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে এ দেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হচ্ছে, যার পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং ক্রমেই তা বাড়ছে। এ ক্ষতি আমাদের সবার। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। আমরা নিরাপদ সড়ক চাই, চাই নিরাপদে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা।

No comments

Powered by Blogger.