বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-সীমান্ত হাট : দিগন্তবিস্তৃত প্রত্যাশা এবং কিছু প্রতিকূলতা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

গত ২৩ জুলাই ২০১১ শনিবার বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান এবং ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার বালিয়ামাড়ী সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে প্রথম সীমান্ত হাটের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। ভারত বাংলাদেশের শুধু বৃহৎ প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রই নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় সুহৃদ, সহায়ক শক্তি এবং বন্ধুপ্রতিম দেশ। ভারতের সঙ্গে রয়েছে আমাদের বিস্তৃত সীমান্ত।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে বিভিন্ন সময় নানা রকম টানাপড়েন পরিলক্ষিত হয়েছে বটে, কিন্তু এসব কখনোই গভীর তিক্ততায় রূপ নেয়নি। তবে আস্থার সংকট কখনো কখনো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মহাজোট সরকার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত কিংবা ঝুলে থাকা কিছু বিষয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং উভয় দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ের সফল কিছু কার্যক্রম ইতিমধ্যে নতুন আশাও জাগিয়েছে। সৌহার্দ্য-মৈত্রী-সম্প্রীতির সেতুবন্ধ আরো দৃঢ় করতে নানা রকম প্রচেষ্টা উভয় দেশের তরফেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। সীমান্ত হাটের শুভযাত্রা এরই অংশ। আমাদের প্রত্যাশা, এই সীমান্ত হাটের শুভযাত্রা শুধু বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বন্ধুত্বেরও বড় প্রতীক হয়ে উঠবে। সত্য বটে, সীমান্ত হাটের বাস্তবতা যতটা ব্যবহারিক, এর চেয়ে ঢের বেশি প্রতীকী। সীমান্ত হাট উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে এবং জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো মজবুত করতে একটি সেতু হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কাজেই আনেকটা প্রতীকী হলেও বিষয়টি খাটো করে দেখার কোনোই অবকাশ নেই।
বিদ্যমান বিশ্ববাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আমরা এখন 'ভুবনগ্রাম'-এর বাসিন্দা বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকটি দেশ মিলে একেকটি জোটও গড়ে উঠেছে। যেমন_আসিয়ান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইত্যাদি এরই দৃষ্টান্ত। দক্ষিণ এশিয়ায়ও এমন একটি জোটের জন্ম হয়েছে অনেক আগে, যা সার্ক নামে পরিচিত। এমন জোট বা অঞ্চলভিত্তিক গোষ্ঠী আরো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে প্রায় সারা বিশ্বে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে এ ধরনের জোট বা অঞ্চলভিত্তিক গোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বসহকারেই বিবেচিত হয়। সার্ক যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল, তা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। কেন হয়নি, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ব্যাপক, যা এই নিবন্ধের ছোট্ট পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এ ক্ষেত্রেও আস্থার সংকট বড় একটি নেতিবাচক বিষয় হয়ে জিইয়ে আছে। আধুনিক বিশ্বে শান্তি-স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নের ক্ষেত্রে দেশে-দেশে সুসম্পর্কের কোনোই বিকল্প নেই। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পানি প্রায় প্রতিনিয়তই কোনো কোনো মহল থেকে ঘোলা করার চেষ্টা চলে। বিশেষ করে আমাদের জাতীয় নির্বাচনের সময় এ নিয়ে বড় বেশি নোংরা রাজনীতি পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। যাঁরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁরা প্রচণ্ড রকমভাবে স্ববিরোধী। যাক সে প্রসঙ্গেও এই ছোট্ট পরিসরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দুরূহ। তবে সব কিছু ছাপিয়ে নতুন করে উভয় দেশের সম্পর্কের ভিত আরো মজবুত করতে এবং বিদ্যমান সমস্যাবলির নিরসনকল্পে যে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে, তা নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের নীতিনির্ধারকরা তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিধি আরো বিস্তৃত করার পাশাপাশি উদার মনোভাবের ব্যাপক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবেন_এ প্রত্যাশা দিগন্তবিস্তৃত। 'বড় ভাই'সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন যেমন কঠিন হবে, তেমনি বিদ্যমান সমস্যাবলির নিরসনও অসম্ভব হয়েই থাকবে। দরকার প্রকৃতই ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাবের বিকাশ।
যেদিন প্রথম সীমান্ত হাটটি উদ্বোধন করা হয়, সেদিন টিভি চ্যানেলগুলোতে এই দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগকে উভয় দেশের সাধারণ মানুষের করতালি দিয়ে স্বাগত জানানোর দৃশ্য দেখা গেছে। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক নিবিড় হলে এমনিতেই যেকোনো সমস্যা সমাধানের পথ মসৃণ হয়। সীমান্ত হাটের বিষয়টি উভয় দেশের সচেতন এবং শান্তি ও প্রগতিবাদী মানুষ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার সার্বিক সুসম্পর্কের প্রতীক হিসেবে দেখছেন খুব যুক্তিযুক্ত কারণেই। উভয় দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী ওই অনুষ্ঠানে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তাও একেবারেই অমূলক নয়। এমন প্রশ্ন উঠতে পারে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণের নানা পথই তো খোলা আছে, কিন্তু সীমান্ত হাটকে এ ক্ষেত্রে একটি 'মাইলফলক' হিসেবে বর্ণনা করার এই প্রতীকী তাৎপর্যটা কেন? খুব সাদামাটাভাবে এ প্রশ্নের জবাব হলো, দুই দেশের সম্পর্কের সব ক্ষেত্র বিস্তৃত হলেই যথাযথভাবে উভয় দেশের মানুষ উপকৃত হতে পারে। এই সীমান্ত হাটের বিষয়টি গত বছরের জানুয়ারি মাসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় সমঝোতা হয়েছিল। এরপর কেটে গেছে দেড় বছর। এ ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি মুখ্য ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাকিস্তান আমলে এ ধরনের হাট বিভিন্ন সীমান্তে চালু ছিল এবং উভয় দেশের জনগণের কাছে তা ছিল কাঙ্ক্ষিতও। ১৯৭১ সালে যে সীমান্ত হাট বন্ধ হয়ে যায়, এর আবার শুভযাত্রা শুরু হলো চার দশক পর। এই সীমান্ত হাট ভারতের সঙ্গে আমাদের যে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, তা কমিয়ে আনতে মোটেই সহায়ক না হলেও স্থানীয়ভাবে উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশে তা যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং সীমান্তবাসীর জীবনযাপন সহজ হবে, জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষীণ হলেও এর শুভ প্রভাব পড়বে। আশা করা যায়, সবচেয়ে বড় কাজটি যা হবে তা হলো, আস্থার সংকট কাটিয়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকটাই আলো ফেলবে। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক নিয়মকানুন থাকে, সীমান্ত হাটের ক্ষেত্রে এর যেন কোনো বিরূপ ছায়া না পড়ে এবং প্রক্রিয়া যাতে সহজ-সাবলীল থাকে, হয়রানি-ঝামেলা না হয়_এসব বিষয় সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
যখন আমরা এমন প্রত্যাশা করছি, তখনই কিছু নেতিবাচক খবরও পাওয়া গেছে। ২৯ জুলাই কালের কণ্ঠে এবং ২৮ জুলাই মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশ, স্থানীয় প্রশাসনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের নানা রকম খবরদারির কারণে সীমান্ত হাটে যেতে মানুষের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। এই হাটে যেতে উৎসুক মানুষের সংখ্যা কম না হলেও নানা রকম কঠোর নিয়মনীতির কারণে পুরো প্রক্রিয়াই ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। অপমৃত্যু ঘটাতে পারে দিগন্তবিস্তৃত প্রত্যাশার। নিয়মকানুন শিথিল করার পাশাপাশি আইনি জটিলতার নিরসন ঘটাতে না পারলে সব কিছুই দুরাশায়ও রূপ নিতে পারে। আরো অভিযোগ উঠছে, এই সীমান্ত হাটের দোকানি ও ক্রেতা নির্বাচনে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা প্রভাব খাটাচ্ছেন। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা অংশগ্রহণের সুযোগবঞ্চিত থেকে গেছেন। এমন ঘটনা আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ভারতীয় হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির একগুঁয়ে মনোভাব, পণ্য কেনাবেচায় জটিলতা ইত্যাদি বিষয় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উভয় দেশের স্থানীয় প্রশাসনকে এসব ব্যাপারে দ্রুত স্বচ্ছ উদ্যোগ নিতে হবে এবং সাধারণের জন্য মানা সহজ কিংবা উৎসাহ জাগায় এমন এসব নিয়মকানুনের ভিত্তিতে প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে হবে। অভিযোগ আরো বেশ কিছু উঠেছে। সীমান্ত হাট ঘিরে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু সুরাহার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা অপরিহার্য। পাশাপাশি সীমান্তরক্ষীদের, বিশেষ করে বিএসএফের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সে দেশের ঊর্ধ্বতনদের তরফে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। 'অনুপ্রবেশ' মনে করে যখন-তখন প্রাণঘাতী গুলি ছোড়ার প্রবণতা তাদের ত্যাগ করতে হবে। 'সীমান্তে হত্যা' বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাবলির অন্যতম বড় সমস্যা, যা বিএসএফ কর্তৃক প্রায়ই ঘটে থাকে। সীমান্তে হত্যা বন্ধে নয়াদিলি্লর প্রতিশ্রুতিরও ইতিমধ্যে ব্যত্যয় ঘটিয়েছে বিএসএফ। ভারতের দায়িত্বশীল মহলগুলোর পক্ষ থেকে নিকট-অতীতে এ ব্যাপারে অধিকতর সংযম প্রদর্শনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এর পরও এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অবশ্যই মনে রাখা দরকার, সীমান্ত হাটের সাফল্য দুই দেশের আমলা এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সীমান্ত হাটের ধরন হওয়া উচিত 'ফ্রি ট্রেড'। তবে লক্ষ রাখতে হবে, এর মাধ্যমে যেন অস্ত্র বা মাদকের চোরাচালান না ঘটে। অপ্রয়োজীয় শর্তের বেড়াজাল ছিন্ন করতে হবে। পাশাপাশি দরকার এই হাট নিয়ে নিয়মিত যৌথ মনিটরিং। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং নিকট-ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সফরে আসছেন। উভয় দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশা, বিদ্যমান সমস্যাবলির নিরসনে তাঁর এই সফর ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর রেখা। সীমান্তবাসীর জন্য বিষয়টি সার্বক্ষণিক উদ্বেগের। আশা করি, সীমান্ত হাট দুই দেশের মানুষের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া, মেলানোর-মিলবার মানসিকতা উন্নত করতে সহায়ক হবে, বৈরিতার চিরনিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে, প্রীতি ও বন্ধুত্বের অনুভূতি পুষ্ট থেকে পুষ্টতর করবে। সীমান্ত হাট নিয়ে যাতে কোনো মহলই রাজনীতি করার সুযোগ নিতে না পারে উভয় দেশের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে সজাগ থাকা চাই। বালিয়ামাড়ীর হাটটি প্রতীকী কিংবা কলেবরে যতই সীমিত হোক, এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যাতে সফল হয়, তাও সতর্কতার সঙ্গেই পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা (চুক্তি অনুযায়ী নিয়মনীতি সংশোধন করে) বাড়ানোর মতো বাস্তব পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলে তাও আমলে নিতে হবে। আর সব কিছু, বিশেষ করে ছোটখাটো বিষয়ের ব্যাপারে দিলি্ল-ঢাকা পর্যায়ে সমাধানের অপেক্ষায় না থেকে উভয় দেশের স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যেতে পারে। সপ্তাহের এক দিন অর্থাৎ প্রতি বুধবার এই হাট বসার আপাতত কথা রয়েছে। এই হাটের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে বিভিন্ন স্থানে এমন হাট আরো বসানোর বিষয়টি আমলে নেওয়া দরকার। সীমান্তে শান্তির স্থায়ী বাতাবরণ সৃষ্টিতে এবং আখেরে উভয় দেশের কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যাবলির চিরনিরসনে এই প্রতীকী হাটের আলো সব কিছু আলোকিত করুক, প্রতিকূলতার সব দেয়াল ভেঙে দিক_ এ প্রত্যাশা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সবার।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.