সহজিয়া কড়চা-রাজনীতির যূপকাষ্ঠে ঢাকার গর্দান by সৈয়দ আবুল মকসুদ

অসামরিক-সামরিক আমাদের সব শাসকই যেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো খেয়ালি, যাঁরা সদম্ভে বলতে পারেন, ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,/ করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা।’ কোনো ব্যাপারে তাঁদের মর্জি হলে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা কালবিলম্ব করেন না।


কুড়ি-বাইশ বছর আগে যাঁর বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাঁর সঙ্গে গলাগলি করতে দ্বিধা করেন না। ওই সময় যাঁর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছেন, তাঁর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া তো বটেই, কুস্তি লড়তেও কার্পণ্য করেন না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে অথবা স্বার্থসিদ্ধি করতে যেকোনো দূরত্বে যেতেও তাঁদের বিবেকে বাধে না।
বহুদিন থেকে যেসব বিষয় নিয়ে আমার বইপত্র লেখার পরিকল্পনা রয়েছে তার মধ্যে একটি: ঢাকা। ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার পুরোনো ঐতিহাসিক নগরগুলোর একটি। ঢাকার বয়স কলকাতার দ্বিগুণ—দিল্লির প্রায় সমবয়সী। নব্বইয়ের দশকে দিল্লিতে লাইব্রেরিতে কাজ করার সময় আমি একজন ঢাকা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কয়েক দিন আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁর থেকে সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশে দু-একজন ঢাকা নিয়ে কাজ করেছেন, তবে তাঁর ঋণ স্বীকার করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেননি। সেই ঢাকা বিশেষজ্ঞের নাম আজিমুশ শান হায়দার। তিনি উর্দুভাষী, স্বাধীনতার আগে ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন। পরে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। গবেষণার কাজে মাঝেমধ্যে ভারত ও পাকিস্তানে আসতেন।
ঢাকা নিয়ে আমার আরেক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ হয় ইসলামাবাদে। তিনি শুধু উপমহাদেশের নন, এশিয়ার একজন বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ। তিনি হলেন আহমদ হাসান দানী। বছর দুই আগে তিনি মারা গেছেন। ভারতের পুরাতত্ত্ববিদেরাও তাঁকে খুব মর্যাদা দিতেন। আমি যখন দিল্লিতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্ট্রিক্যাল রিসার্স, নেহরু মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি বা ন্যাশনাল গান্ধী মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরিতে কাজ করতে যেতাম, সেখানে কারও কারও কাছে ড. দানীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনি। আমি উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে যে কয়জন অসাম্প্রদায়িক, উদার, সংস্কারমুুক্ত ও উঁচু মাপের মানুষ দেখেছি, তাঁদের একজন ড. দানী। ইসলামাবাদে আমি দিন দুই তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করে ধন্য হয়েছি। আমি ও আমার স্ত্রী তক্ষশীলা দেখতে যাব, তাঁকে বললাম। তিনি বললেন, ‘আপনি একা হলে এক কথা ছিল। বেগম সাহেবাকে নিয়ে যাবেন। আমি একটি বিশেষ দূরত্ব পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।’ তখন তাঁর বয়স আশির মতো। ওই বয়সে নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে শ খানেক মাইল দূরে পৌঁছে দেন। সেখান থেকে তক্ষশীলা কর্তৃপক্ষকে আমাকে আতিথেয়তা দিতে নির্দেশ দেন। তাঁর থেকে ঢাকা বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারি। ইসলামাবাদ আর্কাইভসেও তাঁর মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পাই। আজকে যে ঢাকা জাদুঘর আমরা দেখছি, তার জন্য আমরা দুজন মানুষের কাছে অশেষ ঋণী। তাঁরা হলেন নলিনীকান্ত ভট্টশালী এবং আহমদ হাসান দানী।
ঢাকা জাদুঘরের ব্যাপারে আর যে দুজনের কাছে আমাদের অশেষ ঋণ তাঁরা হলেন হাকিম হাবিবুর রহমান ও সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর। আমার বিরল সৌভাগ্য তাঁদের দুজনের পুরোনো কাগজপত্র দেখারও সুযোগ পেয়েছি তাঁদের সহূদয় বংশধরদের দয়ায়। চকবাজারে হাকিম হাবিবুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে তাঁর কাগজপত্র ঘাঁটার সুযোগ পেয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি বহু অমূল্য বই দান করে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুগ্রহে তাঁর আলমারিগুলো খুলে দেখার সুযোগ হয়েছিল। সব বই-ই আরবি-ফারসি বা উর্দু। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করবেন, তাঁদের এই তিন ভাষায় অধিকার থাকা অপরিহার্য। আমাদের অনেকেরই তা নেই। সে জন্য আমাদের প্রকৃত ইতিহাস লেখা হচ্ছে না, তবে ‘ইতিহাস’ শব্দটি বাংলার আকাশে বাতাসে অবিরাম ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আমাদের মতো অলস মানুষের ভিড়ে আরেক কাজ-পাগল ইতিহাসবিদ হলেন প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম, এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশের কর্ণধার। এ দেশে কর্মীর ও যোগ্য সহকর্মীর অত্যন্ত অভাব। তার মধ্যেও তিনি বহু মানুষকে দিয়ে বড় বড় কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। আমার তিনি অবিচল অনুরাগী ও হিতার্থী। তিন খণ্ডে বাংলা ও ইংরেজিতে বাংলাদেশের ইতিহাস (১৭০৪-১৯৭১) রচনার যে প্রকল্প তিনি গ্রহণ করেন, তার একজন লেখক আমাকেও বানালেন। অন্যান্য বড় প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত করেন। কিন্তু আমি কিছু কাজ আর বেশির ভাগ অকাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর সব অনুরোধ রক্ষা করতে পারি না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর ড. সিরাজুল ইসলামের মতো কাজ আর কোনো বাঙালি ইতিহাসবিদ করেননি।
এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে ঢাকার ৪০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০০৮ থেকে উদ্যাপিত হয়েছে। যদিও আমার কাছে যে তথ্য আছে, তাতে ঢাকার বয়স ৭০০ বছরের নিচে নয়। হাকিম হাবিবুর রহমানের জং ধরা স্যুটকেসে আমি কিছু উর্দু কাগজ পেয়েছিলাম, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ও উর্দু বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহকে দিয়ে অনুবাদ করাই। তাতে জানা যায়, সচিবালয়ের দক্ষিণ দিকে মহান সুফি আবদুল মালেক ইয়ামেনী মারা যান ১২২১ খ্রিষ্টাব্দে, হিজরি ৬৪২ সালে। অর্থাৎ আজ থেকে ৭৯০ বছর আগে। তাঁর চারিত্রিক মাহাত্ম্যে মুগ্ধ হয়ে ঢাকার বহু অমুসলমান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ঢাকার হিন্দুরাও ছিলেন তাঁর ভক্ত। পীর ইয়ামেনী সম্পর্কে গবেষণায় হাত দিয়েছিলেন আরেক মহান বাঙালি লেখক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, যাকে মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে মৌলবি গিরিশ সেন বলে সম্বোধন করতেন। হাকিম হাবিবুর রহমানের কাগজপত্র থেকে আরও জানা যায় যে, ঢাকেশ্বরী মন্দিরও ঢাকায় মোগল রাজধানী স্থাপনের কয়েক শ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। মতিঝিলে রাজউক ভবনের পাশে শাহ নিয়ামতউল্লাহ বুৎশিখনের মাজারসংলগ্ন মূল মসজিদ ও সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরও মোগল যুগের আগের।
পৃথিবীর সব জাতির সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতা থাকে না। যেমন মালয়েশিয়ার নেই। বাংলাদেশের আছে, বাঙালির আছে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মতো এমন হতভাগ্য জাতি আর দুনিয়ায় একটিও নেই যে তার সোনার অক্ষরে লেখা ইতিহাসকে কুটি কুটি করে ছিঁড়তে পছন্দ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কর্মকর্তা বিদগ্ধ ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এবং পূর্ববঙ্গ বিশেষজ্ঞ এইচ ই স্টেপলটনের কিছু লেখা নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম আমাদের দুজন বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ মমতাজুর রহমান তরফদার এবং চট্টগ্রামের আবদুল করিমের সঙ্গে। তাঁরা ছিলেন মধ্যযুগের বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ। ড. মজিফুল্লাহ কবীরকে প্রধান এবং হাসান হাফিজুর রহমানকে সম্পাদক করে যখন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়, তখন তাঁদের দুজনের অনুরোধে দলিলপত্র সংগ্রহে কিছু কাজ করি। তখন শুধু ঢাকা নয়, এক নতুন পূর্ব বাংলার ইতিহাসের সন্ধান পাই।
১৮৭৯ সালে প্রকাশিত ‘Lower provinces of Bengal’-এর কিছু রিপোর্ট তাঁদের দেখাই। তাতে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের ঐতিহাসিক তথ্য ছিল। ওই রিপোর্টে ঢাকা সম্পর্কে অমূল্য তথ্য পাই। সেখানে লালবাগ কেল্লা, আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র সুলতান মোহাম্মদ আজিম, পরী বানুু, শায়েস্তা খাঁ, চক (বাজার), মীর আবুল কাশেম প্রতিষ্ঠিত ঈদগা, মীর মুরাদ প্রতিষ্ঠিত হুসেনি দালান, ঢাকেশ্বরী মন্দির, আর্মেনিয়ান চার্চ, কদম রসুল, পাঁচ পীরের দরগা প্রভৃতি বিষয়ে তথ্যপূর্ণ রচনা ছিল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মাঝে ‘পাগলা ব্রিজ’-এর সম্পর্কে বলা হয়েছিল এটি ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে মীরজুমলা তৈরি করেন। আরেকটিতে বলা হয়েছিল ঢাকা-ময়মনসিংহের মাঝে রয়েছে টঙ্গী ব্রিজ। ব্রিজটি সিপাহি বিদ্রোহের সময় এক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হলে আবার মেরামতও করা হয়। এই ব্রিজের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছিল it is impending the flood of the river.
বাংলার রাজধানী রাজা মানসিংহ রাজমহলে স্থানান্তরিত করেন ১৫৯৫ সালে। ১৬০৮ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ইসলাম খান চিশতি বাংলার সুবেদার হয়ে আসেন। তিনি রাজমহল থেকে রাজধানী সরিয়ে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য মাঝামাঝি জায়গা ঢাকায় নিয়ে আসেন। সম্রাটের নামে এর নামকরণ হয় জাহাঙ্গীরনগর। কিন্তু ঢাকার মানুষ সব সময় একে ঢাকা বলেই ডাকত। এরপর সুবা বাংলার রাজধানী ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেওয়া হয়। রাজধানী সরিয়ে নিলে ঢাকার রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে গেলেও তার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব কমেনি। সারা ভারতের বড় ব্যবসায়ীরা ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন।
অদূরদর্শী শাসকদের খামখেয়ালিতে বারবার ঢাকার ওপর আঘাত এসেছে, আবার ঢাকা ফিরে পেয়েছে তার মর্যাদা। ১৯০৫ সালে ঢাকা হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী। ১৯১১-তে সেটা বানচাল হলে আবার ঢাকা গুরুত্ব হারায়। ১৯৪৭-এ ঢাকা হয় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। বিকশিত হতে থাকে অতি দ্রুত। জনসংখ্যা বাড়তে থাকে দ্রুততর গতিতে। পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা।’
জেনারেল এরশাদ যখন ঢাকার বানান Dacca থেকে Dhaka করেন, তখন তা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। ধ্বনিগত দিক থেকে এই বানানই হওয়া উচিত। কয়েক মাস পরে আমার মনে হলো, এরশাদ সাহেব ক্ষমতা জবরদখল করে যেমন সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, ঢাকার বানান পরিবর্তন করে ডবল লঙ্ঘন করলেন। তখন তাঁর বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করছিলাম। যুগপৎ নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। মিটিং-মিছিল প্রায়ই হতো। তখন আওয়ামী-বিএনপি বা আমেরিকাপন্থী, ভারতপন্থী, চীনপন্থীদের মধ্যে এত মেরুকরণ হয়নি। একদিন এক মিছিলে হাঁটছিলাম। পাশে ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন। তাঁকে বললাম, সংবিধানে লেখা আছে Dacca, এরশাদ সাহেব করলেন Dhaka, একি সংবিধান লঙ্ঘন নয়। মাননীয় বিচারপতি বললেন, ‘নিশ্চয়ই। সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’ তারপর ঢাকার বানান নিয়ে আমি লিখলাম, সভা-সমাবেশে প্রতিবাদ করলাম এবং রাষ্ট্রপতির কাছে সংবিধান লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে চিঠি দিলাম। রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি আমাকে জানালেন, ভুল হয়েছে, শিগগিরই সংশোধন করা হবে। অনেক দিন পরে ১৯৮৮-তে সংবিধান সংশোধন করে Dhaka করা হয়।
এখন শুনছি ঢাকা নগর ভাগ হবে। একটি চাল কুমড়াকে ফালা দিয়ে যেভাবে দুই টুকরা করা হয়, সেভাবে পূর্ব-পশ্চিমে ফালা দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা হয়ে যাবে দ্বিখণ্ডিত। একটি উত্তর ঢাকা, অন্যটি দক্ষিণ ঢাকা। দুই সৎভাই বা বোন যেমন বাপের বাড়িটিকে মাঝখানে খুঁটি পুঁতে ভাগ করে নেয়, রাজধানী ঢাকাকে সেভাবে ভাগ করে নেওয়া হবে। কিন্তু ভাগ তো হবে, রাজধানী হবে কোনটি? সংবিধান বলছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা।’ দক্ষিণ ঢাকার লোকেরা বলবে, আমরা রাজধানী চাই, রাষ্ট্রপতির ভবন পড়ছে আমাদের ভাগে। উত্তরপাড়ার নাগরিকেরা দাবি ছাড়বেন কেন? তাঁরা বলবেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আমাদের এলাকায়, বাংলাদেশের রাজধানী হবে উত্তর ঢাকা। সংবিধানে কোনটা লিখবেন। সমস্যার সমাধান বেরিয়ে যাবে। কারণ, সংবিধান সংশোধন করা তো ডালভাত। নতুন সংশোধিত সংবিধানে লেখা থাকবে: বাংলাদেশের রাজধানী শীতকালে থাকবে দক্ষিণে, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় থাকবে উত্তর ঢাকায়।
বলা হয়েছে, ঢাকায় লোকজন বেশি, একে সামাল দেওয়া এক মেয়রের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই যুক্তিতে চট্টগ্রামকে ভাগ করতে হবে। সিলেটের লোক কম কি? রাজশাহী ও খুলনাও এক মেয়রের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। দ্বিখণ্ডিত ঢাকাও তো কম বড় হবে না। কোনো দিন যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকে, অন্য কোনো দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসে, তারা যদি দুই ঢাকাকে নাগরিক সুবিধা বাড়াতে চার ভাগ করে, আওয়ামী লীগের নেতারা প্রতিবাদ করবেন কোন মুখে?
গুজবটির কোনো ভিত্তি আছে কি না জানি না। নিজের কানে শুনেছি ঢাকার নামও নাকি বদলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সরকারঘনিষ্ঠদের কোনো কোনো গোত্র। তাঁরা বলছেন, সায়গন যদি হো চি মিন সিটি হতে পারে, ঢাকার সাদামাটা অর্থহীন নাম রাখার যুক্তি কোথায়? তবে ঢাকা তো দুটি। কোনটির নাম কী হবে? দক্ষিণ ঢাকার লোক যদি ‘জাহাঙ্গীরনগর’ পুনর্বহাল করতে চান, উত্তর ঢাকার নতুন নামকরণের কোনো সমস্যাই হবে না।
ঢাকা পৌরসভার ইতিহাস দেড় শ বছরের। আনন্দচন্দ্র রায়, খাজা ইউসুফ, খাজা নাজিমউদ্দিন প্রমুখ এর নগরপিতা ছিলেন। ঢাকার একটি অখণ্ড সত্তা রয়েছে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাংকক, বেইজিং, তেহরান, প্যারিস, বার্লিন, লন্ডন, টোকিওর মতো। যে দেশে বিভেদ ও মতপার্থক্যের শেষ নেই, সেখানে একটি নতুন বিরোধের জন্ম দেওয়ার যুক্তি কোথায়? আমলাদের কাছে নগরের দায়িত্ব অর্পণ করবেন কেন? না হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের একজন নির্বাচিত হোন, তাও ভালো, কিন্তু দোহাই আপনাদের, তরমুজ বা কুমড়ার মতো নগরকে ফালা ফালা করবেন না। প্রত্যেক নগরের এবং রাজধানীর একটি অখণ্ড সত্তা ও চারিত্র আছে। একটি কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকা ছাড়া তার উন্নতির দ্বিতীয় পথ নেই।
অন্নদাশঙ্কর রায় আগের মতো এখনো খুব বেশি পঠিত লেখক নন। কিন্তু তাঁর একটি ছড়া বহু উচ্চারিত। সেই ছড়াটির দুটি শব্দ বদলে আমরা গাইতে পারি:
তেলের শিশি ভাঙলে পরে
খুকুর পরে রাগ করো,
তোমরা যারা ধেড়ে খুকি
ঢাকা ভেঙে ভাগ করো—
তারবেলা তারবেলা তারবেলা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.