অবৈধ পণ্যের আমদানি বেড়েছেঃ বন্দর ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো দরকার

দেশের আমদানি-রফতানির প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অবৈধ পণ্য আমদানি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও তেমন কোনো ফলোদয় হয়নি। বালির বাঁধে রোধ করা যায়নি বানের পানি।

ফলে বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ পণ্যের আমদানি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা। কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তা, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকরা এই কুকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। অথচ সেই পুরনো ভাষায়ই কর্তৃপক্ষ বলছে, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে, শুল্ক ফাঁকির ব্যাপারেও কড়া নজরদারির ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এসব হম্বিতম্বি স্রেফ লোকদেখানো।
কিছুদিন আগে প্রকাশিত খবর অনুসারে, মংলা, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কনটেইনার বোঝাই করে আনা হয়েছে শত-কোটি টাকার মদের চালান। এতে সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব হারালেও কাস্টমস কর্মকর্তারা ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। শুধু মদ-বিয়ারের ক্ষেত্রেই একশ্রেণীর ধুরন্ধর কাস্টমস কর্মকর্তা অবৈধ আমদানিকারকদের নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে না, অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও চলছে বিপুল পরিমাণ ঘুষ লেনদেন। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম বন্দরে আটক হয়েছে আমদানি-নিষিদ্ধ পুরনো ফটোস্ট্যাট মেশিন ও এর বিভিন্ন উপকরণের পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের দুটি বিশাল চালান। এছাড়া আটক হয়েছে ফ্রিজ ও ফটোকপি মেশিনসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশের অবৈধ চালান। কম মূল্য দেখিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটছে অহরহ। কয়েকমাস আগে চিনি আমদানির ক্ষেত্রে ১২ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়েছে। স্বয়ং চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কালেক্টর (আমদানি) বন্দর দিয়ে অবৈধ পণ্যের আমদানি এবং শুল্ক ফাঁকির কথা স্বীকার করেছেন।
গত কিছুদিন ধরে বন্দর ও বিভিন্ন কাস্টম হাউসের দুর্নীতি নিয়ে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। গোপন ক্যামেরায় তোলা ঘুষ লেনদেনের ছবিও প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়। এরপর আর সাক্ষী-সাবুদ খাড়া করে বন্দর ও কাস্টম হাউসে ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য প্রমাণ করার দরকার পড়ে না।
সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, কাস্টমসের ঘাটে ঘাটে প্রকাশ্যে ঘুষ-দুর্নীতির এ বহর বেড়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। এমনকি কাস্টমসে চাহিদামত ঘুষ না দেয়ায় শিল্প-কারখানার কাঁচামালের বৈধ চালান পর্যন্ত আটকে দেয়া হয়েছে। এতে ব্যাহত হয়েছে অনেক শিল্প-কারখানার স্বাভাবিক উত্পাদন। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে মংলা কাস্টম হাউসের অভিযুক্ত কমিশনারকে মদের চালান সংক্রান্ত অভিযোগে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হতে পারে। এ ঘটনার পর দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দু’চারটি অবৈধ পণ্যের চালান ধরা পড়ার পরই কেবল এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু গত কয়েক মাসে এভাবে বহু চালান অন্যায় সুবিধা নিয়ে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই খালাস করে দেয়া হয়েছে বলে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এতে সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ কাজে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চোরাচালান সিন্ডিকেটের সম্পর্ক আছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় দু’একজন কাস্টমস কমিশনারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেই কি এই চৌর্যবৃত্তি ও ঘুষ বাণিজ্যের অবসান হবে? এই জিজ্ঞাসার জবাব আপাতত নেতিবাচক। এর আগেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ ধরনের বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে স্থায়ী কোনো ফল লাভ হয়নি। সাময়িকভাবে দুর্নীতিবাজদের তত্পরতায় ভাটা দেখা দিলেও আবার তা শুরু হয়েছে নতুন উদ্যমে। অনেকে আবার রাজনৈতিক পালাবদলের সুযোগও নিয়েছে। কাজেই খোলনলচে পাল্টে ফেলা ছাড়া বন্দর তথা দেশের কাস্টম হাউসকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে—এমন ভাবার অবকাশ নেই। এজন্য বন্দর ব্যবস্থাপনা ও কাস্টম হাউসগুলোকে ঢেলে সাজানোর বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।

No comments

Powered by Blogger.