বান্দরবানের পর্যটনশিল্প: অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় রুণেরাই ভরসা by আহমেদ মুনির ও বুদ্ধ জ্যোতি চাকমা

নীলাচল পর্যটনকেন্দ্রের রেলিং ঘেঁষে সেলফি তোলায় ব্যস্ত পাঁচ তরুণ। নিচে ছবির মতো পাহাড় সারির মাঝ দিয়ে এঁকে-বেঁকে গেছে সাঙ্গু নদী। সবার পিঠে ব্যাগ, পরনে জিনস প্যান্ট ও টি-শার্ট। কাছে গিয়ে আলাপ জমানোর পর দলের একজন বললেন, ‘সুযোগ পেলেই বান্দরবান ছুটে আসি।’
১৯ অক্টোবর বেলা ১১টা। নীলাচল পর্যটনকেন্দ্রে আসা তরুণদের সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে। দলটির একজন মো. শাকিল পড়েন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, তাই পাঁচ সহপাঠী বন্ধু মিলে কক্সবাজার ও বান্দরবান ভ্রমণে বেরিয়েছেন। বান্দরবানের দুর্গম বন্য এলাকায় ট্রেকিংয়ের হাতছানি তাঁদের এখানে টেনে আনে।
১৮ ও ১৯ অক্টোবর বান্দরবান ঘুরে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে শাকিলের মতো পর্যটকেরা সংখ্যাই বেশি দেখা গেছে। থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি যাওয়ার স্টপেজে গিয়ে দেখা গেল মাহেন্দ্র জিপ এবং বাসেও তরুণদের ভিড়।
বান্দরবানের হোটেল-মোটেল ও পর্যটন–সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা বছর বান্দরবানে আসা পর্যটকদের একটা বড় অংশই তরুণ। তাঁদের কথার সঙ্গে মিল পাওয়া গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা প্রতিবেদনের সঙ্গেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট িবভাগের অধ্যাপক সৈয়দ রাশিদুল হাসানের নেতৃত্বে পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, বান্দরবানে প্রতিবছর প্রায় সাত লাখের মতো দেশি–বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। এসব পর্যটকের সিংহভাগই দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটক, যঁাদের ৯০ ভাগের বয়স ৩৪ বছরের নিচে।
২০১৩ সালের নভেম্বরে শেষ হওয়া এই গবেষণা চলেছিল ছয় মাস ধরে। তিনজন গবেষক এবং আটজন গবেষণা সহকারী বান্দরবানের হোটেল মালিক, পর্যটক, যানবাহন চালক, দোকানদার, রেস্তোরাঁর কর্মী ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজনের ওপর জরিপ চালিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। নেপালের কাঠমান্ডুভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইসিমোড এ গবেষণা কার্যক্রমে তহবিল জুগিয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বান্দরবানের পর্যটন খাত থেকে বছরে আয় হয় ১০০ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে অবকাঠামো তৈরি হলে এই আয় কয়েক গুণ বাড়বে বলে মনে করেন গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া সৈয়দ রাশিদুল হাসান।
বান্দরবানের শৈল প্রপাত ঝরনায় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছেন পর্যটকেরা। ছবিটি ১৯ অক্টোবর সকালে তোলা l সুপ্রিয় চাকমা
গবেষণা প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মুঠোফোনে সৈয়দ রাশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বান্দরবানের তিন্দু-রেমাক্রি, কেওক্রাডাং, বগা লেকের মতো দুর্গম স্থানে ইকো টু্যরিজম জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশের অ্যাডভেঞ্চার–প্রিয় তরুণেরা এসব স্থানে ভ্রমণ করছেন। এঁদের কথা মাথায় রেখে বান্দরবানের পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।’
তবে পর্যটন খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হলে সরকারি, বেসরকারি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতি না করে পরিবেশবান্ধব ইকো টু্যরিজম গড়ে তোলার দিকে মন দিতে হবে বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পরিচালক (বাণিজ্যিক) নাসির উদ্দিন বলেন, কক্সবাজার ও সুন্দরবনের পরই বান্দরবান বাংলাদেশের সবচেয়ে পর্যটক–প্রিয় স্থান। বান্দরবানের পর্যটন খাত উন্নয়নে সরকার সচেষ্ট।
গত সপ্তাহে দুর্গাপূজা ও পবিত্র আশুরার ছুটিতে বান্দরবান জেলা শহরের ৪৬টি হোটেল-মোটেল পর্যটকে পরিপূর্ণ ছিল। ২১ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটকদের আগমন অব্যাহত ছিল। বান্দরবানের হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম জানান, শহরের সব হোটেল–মোটেলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পর্যটকের আবাসনের ব্যবস্থা আছে। এই চার দিন হোটেল-মোটেলের সব শয্যাই পরিপূর্ণ ছিল। কেবল তা–ই নয়, নানা রকম শঙ্কা সত্ত্বেও গত এক মাসে ৫৭ জন বিদেশি নাগরিক বান্দরবান ঘুরে গেছেন বলে জাানালে বান্দরবানের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান। এঁদের অধিকাংশই পর্যটক বলে তিনি জানান।
বান্দরবানের বিভিন্ন রিসোর্ট ও অবকাশ যাপনকেন্দ্রগুলোতেও ছিল পর্যটকদের ভিড়। বান্দরবান পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান জানান, ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটন করপোরেশনের সব কক্ষই বুকিং দিয়েছেন পর্যটকেরা। হলিডে ইন এবং গ্রিন হিল রিসোর্টেও ২৪ ও ২৫ অক্টোবর সব কক্ষে বুকিং ছিল। বান্দরবানের মিলনছড়ি এলাকার হিলসাইড রিসোর্টে ২৫টি কক্ষের সব কটিই পর্যটকেরা অবস্থান করছেন দুর্গাপূজা ও আশুরার ছুটিতে।
চিম্বুক সড়কে ছুটছে পর্যটকবাহী গাড়ি l প্রথম আলো

পর্যটন করপোরেশনের মেঘলা ও নীলাচল পর্যটনকেন্দ্রেও নিয়মিতই যাচ্ছেন পর্যটকেরা। মেঘলা পর্যটনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক সাধন প্রসাদ চাকমা জানান, মেঘলায় ছুটির দিনগুলো ছাড়া দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ লোক টিকিট কেটে ঢোকেন। তবে ছুটির দিনগুলোতে এ সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি থাকে। কখনো হাজার ছাড়িয়ে যায়। পর্যটকদের আগমন বেশি হয় নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে। তবে ডিসেম্বরে বিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
শহরের স্বর্ণজাদি প্যাগোডা, শহরের বাইরে শৈল প্রপাত, চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরিতে প্রায় সব বয়সের পর্যটক ভ্রমণ করেন। তবে এর বাইরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বগা লেক, কেওক্রাডাং, তাজিংডং, নাফাকুম ঝরনাসহ বিভিন্ন স্থান তরুণ ট্র্যাকারদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান।
হলিডে ইন িরসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেনও দেশি পর্যটকদের ওপরই জোর দিচ্ছেন। ১৫ বছর ধরে পর্যটন ব্যবসায় আছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর রিসোর্টে বেশ কিছু বুকিং বাতিল হলেও পর্যটকদের আগমন অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, ‘বান্দরবানে বিদেশিদের আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। তঁারা না এলে আমাদের করার কিছু নেই। তবে আমাদের পর্যটনশিল্প দেশি পর্যটক দিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে।’
বান্দরবানের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান ১৯ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, বান্দরবান পর্যটকবান্ধব এলাকা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বান্দরবান ভ্রমণে কোনো বিধি-নিষেধ জারি করা হয়নি। কেবল জেলার রুমা, থানচি, রোয়াংছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলা সদরের বাইরে ভ্রমণকারী পর্যটকদের জন্য কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেমন দুর্গম এলাকায় ভ্রমণের সময় পর্যটকদের নিরাপত্তা সংস্থার কাছে নাম–ঠিকানা দিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাঁদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই। কারণ, যেকোনো জায়গায় গিয়ে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন বা বিপদ হতে পারে।
পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে বান্দরবান ভ্রমণ করেছেন ৫৭ জন বিদেশি নাগরিক। এ ছাড়া ৩ অক্টোবর দুজন পর্যটকসহ চারজন অপহরণের ঘটনার পরও পর্যটকেরা বান্দরবানের দুর্গম এলাকাগুলো ভ্রমণ করেছেন। নিরাপত্তা সংস্থার কাছে নাম লিপিবদ্ধ করে ১২ থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত থানচি সদরের বাইরে দুর্গম এলাকাগুলোতে ভ্রমণ করেছেন ৩০ জন পর্যটক। অন্যদিকে, রুমা সদরের বাইরে বগা লেক ও কেওক্রাডাং এলাকায় গেছেন ৯০ জন। ১৯ অক্টোবর ৫২ জন রুমা সদরের বাইরে অবস্থান করছিলেন।
বান্দরবানের পর্যটকদের জন্য কোনো বিধি-নিষেধ নেই বলে জানান জেলা প্রশাসক মিজানুল হক চৌধুরী। যেকোনো পর্যটক যেকোনো স্থানে প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীকে অবহিত করে যেতে পারেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বান্দরবানের মেঘলা, নীলাচল, স্বর্ণজাদি, শৈল প্রপাত, চিম্বুক, বগা লেক, প্রান্তিক লেক সরকার–ঘোষিত পর্যটন স্পট। এসব এলাকাসহ জনপ্রিয় পর্যটন স্পটগুলোর নিরাপাত্তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।
সাঙ্গু নদ দিয়ে রুমা–থানচি যাওয়ার পথে মন ভরাবে এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য l প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.